ঢাকা, ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার
মেনু |||

‘বন্ধ করুন লাইক ও শেয়ারের সংখ্যা বাড়ানোর এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা’

কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সরয়ার: ধর্ষণ, ধর্ষিতা আর ধর্ষককে পণ্য করে মিথ্যাচার আর তথ্য বাণিজ্যের অসুস্থ প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে ঘৃণা আর প্রতিবাদ।

 

পৃথিবীজুড়ে অধিকাংশ ধর্ষিতা মেয়েরা সমাজের কাছে তাদের ধর্ষণের ঘটনাকে প্রকাশ করার সাহস রাখে না। তারা “ধর্ষিতা মেয়ে”র অপবাদ বুকে চেপে বাঁচতে চায় না। তাদের কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। তাদের কারো কারো মা-বাবারা ধর্ষিতা মেয়েকে বোঝা হিসেবে মনে করেন। অথচ আমাদের বাংলাদেশের প্রাণপ্রিয় একটি ছোট্ট তরুণী ধর্ষিতা হওয়ার পর তার ধর্ষণের ঘটনা চেপে যাওয়ার নানা পরামর্শ, প্ররোচনা আসার পরেও সে ধর্ষণের কথা স্বীকার করার সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়। সাহসী সোনার টুকরো মেয়েটি মনে মনে ভাবে এভাবে ধর্ষণের ঘটনা চেপে গেলে সমাজে ধর্ষকরা হেঁটে বেড়াবে বুক ফুলিয়ে। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে সে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে র‍্যাবের গোয়েন্দা কর্মকর্তা কে বলে যে, “পৃথিবীর সব চেহারা ভুলে গেলেও আমি সেই ধর্ষকের চেহারা ভুলবো না”।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা সাদেকা হালিম তাকে দেখতে গেলে সে ধর্ষকের বর্ণনা দেয়। যা র‍্যাব কর্তৃক ধৃত ধর্ষণকারীর সাথে প্রায় হুবহু মিলে যায় বলে সম্মানিত অধ্যাপিকা তার টেলিভিশন টকশোতে মন্তব্য করেছেন। ধর্ষক মজনুর ছবি দেখানোর আগে মেয়েটিকে অপর আরেকজন সন্দেহভাজন ধর্ষকের ফটো দেখানো হলে সে সাথে সাথেই সময়ক্ষেপণ না করে বলে দেয় যে এটা সেই পাষণ্ড ধর্ষক নয়।

 

অথচ ধর্ষক মজনুর ছবি দেখার সাথে সাথেই মেয়েটি তাকে সনাক্ত করে। স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এমন একটি সাহসী সোনার টুকরো মেয়ে একটি হতদরিদ্র যুবককে ফাঁসিয়ে দেওয়ার জন্য মিথ্যে কথা বলবে এমন জঘন্য বিকৃত মানসিকতার চিন্তা আমাদের সমাজের কিছু কিছু মানুষের মনে কীভাবে আসে সেটা ভাবতেই লজ্জা হয়!

 

এমন একটি সাহসী মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে দেশের এবং পৃথিবীর সব ধর্ষিতা নারীদের পাশে দাঁড়ানোর সামাজিক আন্দোলনকে সংঘবদ্ধ না করে আমরা কেউ কেউ বলছি এই দরিদ্র ছেলেটি নাকি ধর্ষক নয়। তাহলে কি মেয়েটি মিথ্যা কথা বলছে? মজনু আসল ধর্ষক নয় এমন অদ্ভুত প্রচারণা করে আমরা আমাদের লাইক, স্ট্যাটাস,কমেন্ট বাড়াচ্ছি বটে। কিন্তু আমরা কি একবারও চিন্তা করছি যে আমরা সাথে সাথে আমাদের একটি ধর্ষিতা বোনকে, আমাদের একটি কোমলমতি হীরের টুকরো সন্তানকে মিথ্যেবাদী বানিয়ে দিচ্ছি?

 

ধর্ষক মজনু ধরা পড়ার পর র‍্যাবের কাছে স্বীকার করেছে যে সে ধর্ষণ করেছে। সেটা না হয় নাই বা বললাম। সেটা হয়তো কেউ বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু ধর্ষকের কাপড়-চোপড় এবং ধর্ষিতার মেডিকেল চেকআপের ডিএনএ টেস্ট থেকে কিছুদিনের মধ্যেই এই সূর্যের আলোর মত সত্য ঘটনা বের হয়ে আসবে যে এই দুর্বল দাঁতভাঙ্গা যুবকটিই ধর্ষণ ধর্ষক ছিল।

 

তখন হয়তো সোশ্যাল মিডিয়াতে অন্য কোনো ইস্যু চাউর হয়ে যাবে। তারপরও আমরা, কিছু সচেতন মানুষ অপেক্ষা করব। অপেক্ষা করব এই প্রত্যাশায় যে, যখন ধর্ষক আদালতের সামনে অবলীলায় স্বীকার করবে তার ধর্ষণের কথা, যখন ধর্ষিতা নিজে আইনজ্ঞ এবং বিচারকের সামনে ধর্ষককে শনাক্ত করবে, এবং যখন ডিএনএ টেস্ট এর রেজাল্ট বিচারকের হাতে পৌঁছে যাবে, তখন এসব সমালোচক, যারা বলছেন মজনু আসল ধর্ষক নয়, তারা কি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জাতির কাছে ক্ষমা চাইবেন? কিংবা ক্ষমা চাইবেন আমাদের এই কোমলমতি সাহসী মেয়েটির কাছে? যে সাহসী মেয়েটি কারো কারো স্ট্যাটাস জনপ্রিয় করার হাতিয়ার হল! আর সেই সাথে হয়ে গেল একটি মিথ্যাবাদী মেয়ে?

 

ছি! দয়া করে বন্ধ করুন আপনাদের এই স্ট্যাটাসে লাইক, কমেন্ট আর শেয়ারের সংখ্যা বাড়ানোর এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা। আপনাদের কাছে, আপনাদের বিবেকের কাছে করজোড়ে অনুরোধ করছি, দয়া করে বন্ধ করুন জঘন্য সমালোচনার এই অসুস্থ সংস্কৃতিকে।

 

র‍্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে যোগদানের পর একটি পেশাগত দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আমার দেওয়া এটা প্রথম স্ট্যাটাস। ধর্ষককে ধরতে পারার তৃপ্তির ঢেকুর তোলার জন্য আমি এই স্ট্যাটাস দেইনি। মনের মধ্যে কয়েকটি পংক্তি আমাকে আমাকে তাড়িত করছিল এই স্ট্যাটাস দিতে-

 

“হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা
তোমার আদেশে। যেন রসনায় মম
সত্যবাক্য ঝলি উঠে খরখড়গসম
তোমার ইঙ্গিতে।

 

………………………….

 

অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।”

 

তাই ঘৃণা ছুড়ে দিলাম পৃথিবীর সব ধর্ষকদের উদ্দেশ্যে, আর ঘৃণা ছুড়ে দিলাম ধর্ষণের মতো একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা নিয়ে যারা মনগড়া তথ্য বাণিজ্য করে তাদের উদ্দেশ্য করে!

 

লেখক: অতিরিক্ত মহাপরিচালক অপারেশন্স,
র‍্যাব ফোর্সেস।


ঢাকাওয়াচ/স

সম্পাদকঃ মোঃ শাখাওয়াত হোসেন সজীব
নিবন্ধন নং -১৬৬