
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ২৮ বছর পার হলেও কাঙ্ক্ষিত সমাধান আসেনি- এমন ক্ষোভই এখন পাহাড়জুড়ে প্রতিধ্বনিত। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) যে ঐতিহাসিক চুক্তি সই করেছিল, তার লক্ষ্য ছিল দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান ঘটিয়ে পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা। কিন্তু ভূমি বিরোধসহ চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো আজও বাস্তবায়ন না হওয়ায় পারস্পরিক অবিশ্বাস ও উত্তেজনা কমে না, বরং দিন দিন আরও জটিল হয়ে উঠছে পরিস্থিতি। এমন বাস্তবতায় চুক্তিকে সংবিধানসম্মতভাবে পুনর্মূল্যায়ন বা বাতিলের দাবি আবারও তুলেছে বিভিন্ন সংগঠন।
জেএসএস বর্ষপূর্তি বিবৃতিতে বলেছে, চুক্তি স্বাক্ষরের পর পাঁচটি রাজনৈতিক সরকার ও দুটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলেও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে কেউই চুক্তি বাস্তবায়নে দৃশ্যমান অগ্রগতি আনতে পারেনি। আওয়ামী লীগও গুরুত্বপূর্ণ সময় হাতে পেলেও “বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রক্রিয়াকে স্থবির করেছে” বলে অভিযোগ তাদের। ২৮ বছর পরও চুক্তির মৌলিক বিষয়সহ প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ধারা অকার্যকর রয়ে গেছে।
বিবৃতি অনুসারে যেসব গুরুত্বপূর্ণ ধারায় কোনো অগ্রগতি নেই, সেগুলো হলো—
পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ, আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে প্রশাসনিক ক্ষমতা হস্তান্তর, ভোটার তালিকা তৈরি করে পরিষদ নির্বাচন আয়োজন, স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে পার্বত্য পুলিশ বাহিনী গঠন, ভূমি কমিশনের মাধ্যমে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করে জুম্মদের বেহাত জমি ফিরিয়ে দেওয়া এবং কমিশনের বিধিমালা প্রণয়ন।
জেএসএস জানায়, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনকে দায়িত্ব দিয়েছে এবং ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যান করা হয়েছে বিচারপতি মুহাম্মদ আব্দুল হাফিজকে। পাঁচ মাসে কমিটির একটি সভা হলেও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পার্বত্যাঞ্চল শাখার সাধারণ সম্পাদক ইন্টুমনি তালুকদার বলেন, “পাহাড়ের মূল সমস্যা ভূমি। এক লাখের বেশি অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ও ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী এখনো জমি ফেরত পায়নি।”
জেএসএস সহসভাপতি ও সাবেক সাংসদ উষাতন তালুকদার বলেন, “আগামীর নির্বাচিত সরকারকে চুক্তি বাস্তবায়নে উদার মনে এগিয়ে আসতে হবে। চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে।”
পিসিএনপির দাবি: সবার সমান ভূমি অধিকার নিশ্চিত করতে হবে
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ (পিসিএনপি) সোমবার সংবাদ সম্মেলনে কয়েকটি দাবি তোলে। তাদের দাবিগুলো হলো—
সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাতিল বা সংবিধানসম্মতভাবে পুনর্মূল্যায়ন, পাহাড়ের সব নাগরিকের সমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ভূমি অধিকার নিশ্চিত করা, সক্রিয় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর অবৈধ অস্ত্র জব্দ করে নির্মূল করা, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে প্রত্যাহার করা সব নিরাপত্তা ক্যাম্প পুনরায় স্থাপন।
নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি তিন দফা দাবি
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে তিন দফা দাবি জানায়।
তাদের দাবি-
১.রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে চুক্তি বাস্তবায়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া,
২.জাতীয় সংলাপ আয়োজন করে বাস্তবায়নের কার্যকর রোডম্যাপ ঘোষণা,
৩.চুক্তি বাস্তবায়নে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া।
সংগঠনটি জানায়, ২৮ বছর পরও অসমাপ্ত প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ না হলে পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ আরও দীর্ঘ হয়ে যাবে।