ঢাকা, ৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার
মেনু |||

ছোট গল্প

কাব্য সুমীর ‘একটি ফুলের তোড়া’ 

 

– একটু তাড়াতাড়ি চলো না ভাই

– আফা এতো আতাফাতা করতাছুইন কে ?

– আরে ভাই, তোমাকে বললাম তাড়াতাড়ি যাও, তুমি পেছন ফিরে দাঁত বের করে হাসছো?
– খেপতাছুইন কে আফা?
– আরে ভাই তাড়াতাড়ি যাও দেখি

আজ শুক্রবার। সন্ধ্যায় রাস্তায় খুব ভীড়। হাসপাতালে থেকে বেরিয়ে সোজা চলে যাচ্ছি দাওয়াত খেতে। পোশাক দেখে মানুষ কি বলবে? বলুক। আমার তো আন্তরিকতার অভাব নাই। যাচ্ছি তো।
– আফা কোন দিকে যামু তা তো কইলেন না?
– ও আচ্ছা বলিনি বুঝি ! তুমি সোজা গিয়ে বামে একটু দাঁড়াবে। সেখানে ফুলের দোকান আছে, ফুল নিবো। তারপর পার্কের দিকে যাবে।
– আইচ্ছা আফা।

রিকশা থেকে নামলাম। এতো ভীড়ের মাঝে দরদাম করে একটা ফুলের তোড়া নিলাম। যদিও আজকের জন্য একটা ফুলের তোড়া কেনা খুব কঠিন ছিলো ব্যাপারটা।
– খালা ফুল কত দিয়া কিনলাইন?
– কত আর তিনশ টাকা নিলো।
–  তিনশো ট‍্যাহা?
– আর বলো না। এক বছর আগেও এ তোড়ার দাম ছিলো অর্ধেক। বাজারের সব জিনিসপত্রের  হুরহুরিয়ে বাড়ছে দাম। ফুলের তোড়ার আর কি দোষ বলো!
– হারাদিন রিস্কা চালাইয়া কত কষ্ট হইরা দুইশ ট্যাহা কামাই হরার পাইতাম না আর আনহেরা খালা ফুল কিনুইন তিনশ ট্যাহা দে। আমার ছোড মাইয়াডা কইছিন হের ইস্কুল নিবার লেইহ্যা ফুলের তোড়া কিনবার। হেইদিন হারাদিন খাডনির টেহা দে একটা ফুলের তোড়া কিনছিলাম। তয় বাড়িত আর লইয়া যাইবার পারি নাই। মায়াডা ম্যালা দুঃখ পাইছে। টিভিত দেইখ‍্যা কইছিন আব্বা আমার লেইগ্যা এরুম ফুলের তোড়া আইনা দিবা।
– তুমি এমন ভাবছো কেন ভাই। যারা ফুল বিক্রেতা তাদেরও কর্সংস্থান হচ্ছে।  কত মানুষের ভাতের যোগাড় হচ্ছে  এ ব্যবসা থেকে। আচ্ছা বাড়িতে নিতে পারলানা মানেটা কি বুঝলাম না তো।
– হেইডা তো অনেক কতা। আনহেরে সব কইবাম। তয় আমার পোলাপাইনগুলা তো না খাইয়া থাহে খালা।
– কি বলছো তুমি?  আমি বুঝতে পারলাম না তুমি আমারে আগে আপা ডাকলে এখন খালা ডাকছো কেন?  আরে আরে তুমি রিকসা কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছো। এতো অন্ধকারে। এটা কোন জায়গা?

লোকটা পিছন ফিরে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাহাহা করে হেসে উঠতেই আমি এক চিৎকার দিয়ে উঠলাম।
আমি যার রিক্সায় ওঠেছিলাম তিনিই তো এ লোক। কিন্তু তিনি তো যুবক বয়সী ছিলেন। ওনার চুলগুলো আধা কাচা পাকা চুলের কি করে হলো?
এই আপনি কোথায় চললেন? আপনি এই অন্ধকারে আমাকে নিয়ে কেন এলেন?
লোকটা কোন কথাই বলছে না। আমি সামনে এগুতেই হাত দিয়ে একটা ঘরের দিকে ইশারা করে দেখিয়ে মুহূর্তে মিলিয়ে গেলেন।

আমি খুব সাহস করে কুঁড়ে ঘরটার দিকে এগিয়ে গেলাম। দরজায় শব্দ করতেই দশ-এগারো বছর বয়সী একটা বাচ্চা মেয়ে দরজা খুলে দিলো। বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছর বয়স্কা এক নারী। ঘরে আরও তিনজন ছেলেমেয়ে। তারা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে। বাঁশের ফালার জীর্ণ ঘরের দেয়ালে একটা ছবির দিকে চোখ পড়লো।
-ছবিটা কার?
-আমগর আব্বা। টেরাকের নিচে পইরা বছর অইলো মইরা গেছে। মেয়েটা আমার দিকে এগিয়ে এসে আরও বললো-
আমার ইস্কুল থেইকা মিছিল অইবো,বেহেই ফুল লইয়া আইবো। আব্বারে আমি কইছিলাম। আব্বা তো ফুল লইয়া আইবার সময় টেরাকের নিচে পইরা মইরা গেছিন।  কালহা তো আবার একুশে ফেব্রুয়ারি। আনহেরে কি আব্বা কইয়া গেছিন? আমি ত আর এহন ইস্কুলে পড়ি না।
আমি মেয়েটার হাতে ফুলগুলো দিয়ে তার মাথায় হাত রাখলাম…

আমি যখন জাগলাম বিছানায় জ্বরে কাঁপছি। ওঠেই চিৎকার দিয়ে ওঠলাম। দৌড়ে আসলো সবাই।
-আমি কোথায় ছিলাম গতরাতে? আমাকে তাদের কাছে নিয়ে চল।
আমাকে সবাই বুঝাতে চেষ্টা করলো আমি অসুস্থ। তারপরও আমি জেদ করলাম।

আমি দেখলাম মেয়েটি খালি পায়ে ফুলের তোড়া নিয়ে হেঁটে স্কুলের দিকে যাচ্ছে। একজন লোকটির কবর দেখিয়ে দিলো। গতরাতে তো এখানেই তিনি অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন।

আমি লোকটির কবরের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। চোখ থেকে দুফোটা পানি পড়ে গেল। বুঝলাম অনেক দায়িত্ব আমার কাঁধে দিয়ে গত রাতে তিনি অন্ধকারে লুকিয়েছেন।


ঢাকাওয়াচ/টিআর

সম্পাদকঃ মোঃ শাখাওয়াত হোসেন সজীব
নিবন্ধন নং -১৬৬