অনলাইন জুয়া

জব্দ ৮০ কোটি টাকা পেতে মরিয়া জুয়াড়ি কোম্পানী মুনফ্রগ ও উল্কা গেমস


2024/05/ulka-games-moonfrog-fraud.jpg

সাখাওয়াত সজীব
গেমস ডেভলপের নামে অনলাইন জুয়া পরিচালনা করে বিদেশে অর্থপাচারের ঘটনায় জব্দ ৮০ কোটি টাকা ফিরে পেতে সর্বাত্মক চেষ্টা করছে জুয়াড়ি কোম্পানী মুনফ্রগ ও উল্কা গেমস লিমিটেড। উল্কা তিন পাত্তি জুয়াচক্রের মূলহোতা ও উল্কার সিইও জামিলুর রশীদ কয়েকমাস জেল খাটার পর জামিনে বের হয়ে ৮০ কোটি টাকা ফিরে পেতে ভারতীয় জুয়াড়ি মুনফ্রগ ল্যাবের সাথে বিবাদের নাটক সাজান। এরই অংশ হিসেবে তারা জুয়ার টাকাকে বৈধতা দিতে তথ্য গোপন করে কোম্পানী আইনের ম্যাটার (১৬৪/২০২৪) হিসেবে উচ্চ আদালতে নিয়ে আসেন। যদিও তারা অবৈধ জুয়া কোম্পানীর রেজিস্ট্রেশনই নিয়েছেন মিথ্যা তথ্য দিয়ে। এছাড়া বিনিয়োগ বোর্ডেও মিথ্যা তথ্য দিয়ে অনুমোদন নিয়ে দেশ থেকে শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন।

Your Image

র‌্যাবের দায়ের করা মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের ৩০ অক্টোবর র‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার হয় জুয়াড়ি কোম্পানি উল্কা গেমসের সিইও জামিলুর রশীদ। গ্রেপ্তার জামিলুর রশিদ এই অনলাইন জুয়া চক্রের মূল হোতা। ২০১৭ সালে প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রতিষ্ঠান মুনফ্রগ ল্যাবসের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। ২০১৮ সালে মুনফ্রগের বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে দেড় লাখ টাকার বেশি বেতনে এতে যুক্ত হন তিনি। মুনফ্রগের অনলাইন জুয়ার অ্যাপ তিনপাত্তি গোল্ডের জনপ্রিয়তা বেড়ে গেলে ২০১৯ সালের শুরুর দিকে জামিলুর উল্কা গেমস নামের একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন। দেশে গেম বানানোর অনুমোদন থাকলেও জুয়ার বৈধতা না থাকায় গেম ডেভলপ করার মিথ্যা তথ্য দিয়ে তিনি উল্কা গেমসের নিবন্ধন নেন। এমনকি মিথ্যা তথ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) কাছ থেকে গেম বানানোর কথা বলে অনুমতি নেয় ‘উল্কা গেমস লিমিটেড’। এরপরে মুনফ্রগ ল্যাবসের মাধ্যমে দেশে অনলাইন জুয়ার কারবার শুরু করে। মুনফ্রগ থেকে কাগজে-কলমে মাত্র সোয়া কোটি টাকার কথিত বিনিয়োগ এনে অনলাইন জুয়া পরিচালনা করে ব্যাংকিং চ্যানেলেই ২০০ কোটি টাকা দেশ থেকে বিদেশে সরিয়ে নিয়েছে চক্রটি।

 

 

বিনিয়োগ বোর্ড কীভাবে একটি জুয়া কোম্পানীকে অনুমোদন দিয়েছে?
২০২২ সালে উল্কা চক্রের গ্রেপ্তারের পর সংবাদমাধ্যমের এমন প্রশ্নের মুখে পড়েছিল বিনিয়োগ বোর্ড। বিডা তখন জানিয়েছিল, বাংলাদেশ সবসময় বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত করে আসছে। বিদেশি বিনিয়োগের অনুমতি দিয়ে থাকে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। গেমিং ডেভেলপমেন্টে ভারতীয় কোম্পানিটি বিনিয়োগ করতে চাইলে বিডা সহজেই তাদের অনুমতি দেয়। তবে গেমিং সেক্টরে ডেভেলপমেন্টের কথা বলে অনলাইন জুয়ার কোনও খেলা তারা চালু করবে তা বুঝতে পারেনি বিডা।

বিডার একজন কর্মকর্তা তখন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, বিদেশি বিনিয়োগ সবসময় উৎসাহিত করা হয়। সবাই সব নিয়ম-কানুন মেনেই বিনিয়োগ করেন। তারা বিনিয়োগ করে লাভ নিবেন—এটাই স্বাভাবিক। তবে কোনভাবেই দেশের আইনে অনুমতি দেয় না, এমন বিনিয়োগ কেউ চায় না। উল্কা গেমস একটি বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে আসে। ডিজিটাল বা অনলাইন গেম ডেভেলপমেন্টের বিনিয়োগকে বিডা স্বাগত জানায়। তবে তারা যে এভাবে জুয়া খেলবে, তা বিডার জানা ছিল না। ওই কর্মকর্তা দাবি করেছিলেন, বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিমাসে একটি প্রতিবেদন দেওয়ার কথা। কিন্তু উল্কা গেমস নিয়মিত কোনও প্রতিবেদন দেয়নি। তাদেরকে বারবার বলার পরও তারা কোনও প্রতিবেদন দেয়নি। তারা গেম ডেভেলপমেন্টের কথা বলে বিডা থেকে অনুমতি নিয়েছে। ডেভেলপমেন্টের তারা কী করছে তা বিডাকে জানায়নি, তারা কেবল ভারতের ‘তিন পাত্তি গোল্ড’ গেম বাংলাদেশে শিফট করেছে। নিবন্ধন নেওয়ার সময়ে উল্কা ‘তিন পাত্তি গোল্ডের’ বিষয়ে বিস্তারিত কিছুই জানায়নি বলেও জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘তারা বিনিয়োগের কথা বলে কার্ডের কী গেম ছড়িয়ে দিবে তাতো আমাদের বলেনি।’ বিডার তৎকালীন ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন বিভাগের ডিরেক্টর জেনারেল শাহ মোহাম্মদ মাহবুব সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে উল্কার কাছে তথ্য চেয়েছি। তারা কোন খাতে কী বিনিয়োগ করেছে, তা তাদের জানাতে হবে।’

মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিডার অনুমতি নিয়ে উল্কার মাধ্যমে ব্যাংকিং চ্যানেলে একটি আন্তর্জাতিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে অর্থ নিয়েছে ভারতের জুয়াড়ি কোম্পানি মুনফ্রগ। অনলাইন জুয়া পরিচালনা করে কোম্পানিটি ২০১৯-২০ অর্থ বছরে দেশ থেকে প্রায় ১৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা সরিয়ে নিয়েছে। পরের অর্থ বছরে সরিয়েছে প্রায় ৫৭ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থ বছরে তারা প্রায় ৯৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা সরিয়ে নিয়েছে। বিডার অনুমতি থাকায় অনলাইন জুয়ার কোম্পানিটি টাকা ব্যাংকিং মাধ্যমে দেশ থেকে নিয়ে গেছে। এভাবে অনলাইনে জুয়ার মাধ্যমে গত ৩ বছরে ১৭৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে কোম্পানিটি। ব্যাংকিং চ্যানেল ছাড়াও হুন্ডির মাধ্যমে তারা হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে।

জুয়া পরিচালনা, মানি লন্ডারিং, তৎকালীন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ একাধিক আইনে ২০২২ সালের ১ নভেম্বর তাদের বিরুদ্ধে রাজধানীর কাফরুল থানায় মামলা হয়। যার নং- ০১/৩১৯। মামলায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা ছিলেন— জুয়াড়ি চক্রের প্রধান জামিলুর রশিদ (৩১), সায়মন হোসেন (২৯), মো. রিদোয়ান আহমেদ (২৯), মো. রাকিবুল আলম (২৯), মো. মুনতাকিম আহমেদ (৩৭) ও কায়েস উদ্দিন আহম্মেদ (৩২)। ৩০ অক্টোবর অভিযান চালিয়ে রাজধানীর মহাখালী ও উত্তরা থেকে র‌্যাব তাদের গ্রেপ্তার করেছিল। গ্রেপ্তার অনেকেই এখন জামিনে রয়েছে বলে জানা গেছে।

কোন কোন ব্যাংকে ৮০ কোটি টাকা
জুয়াড়ি চক্রের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, উল্কা গেমসের ৪টি ব্যাংক একাউন্টে জুয়ার ৮০ কোটি টাকা রয়েছে। এরমধ্যে ইস্টার্ন ব্যাংকের একাউন্টে রয়েছে দেড় কোটি টাকা। বাকি টাকা ব্র্যাক ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ও ডাচ-বাংলা ব্যাংকে রয়েছে। জুয়ার জব্দ টাকার মধ্যে সবচেয়ে বড় অংক রয়েছে ব্র্যাক ব্যাংকের একাউন্টে।

ব্র্যাক ব্যাংকে সেদিন কী হয়েছিল
দেশের ব্যাংকিং খাতের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে গত ৩০ এপ্রিল। এদিন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উপপরিচালক তানিয়া সুলতানার সাক্ষরিত আদেশসহ ব্র্যাক ব্যাংকের গুলশান-১ শাখায় যায় এনবিআরের একটি টিম। সেখানে বলা হয়, উল্কা গেমসের কাছ থেকে ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরের বকেয়া কর ও সুদ বাবদ ৫৩,৯৭,৮৩,৬৫২ (তেপ্পান্ন কোটি সাতানব্বই লাখ তিরাশি হাজার ছয়শত বায়ান্ন) টাকা পাওনা রয়েছে। এরমধ্যে ব্র্যাক ব্যাংকে থাকা প্রায় ৫১ কোটি টাকা কর অঞ্চল-১৫ বরাবর পে অর্ডার করে দিতে বলা হয়। কিন্তু উল্কা গেমসের একাউন্টে লেনদেনের বিষয়ে আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় কোর্টের অনুমতি ছাড়া এনবিআরকে টাকা দিতে অপারগতা জানায় ব্র্যাক ব্যাংক। এতে ক্রমেই বড় হতে থাকে বিবাদ। এনবিআর থেকে আরও উচ্চপর্যায়ের টিম আসে ব্র্যাক ব্যাংকের গুলশান-১ শাখায়। ব্র্যাক ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও গুলশান-১ শাখার এ ঘটনার দিকে নজর দেয়। একপর্যায়ে ব্র্যাক ব্যাংকের আইন শাখা বিষয়টি সরাসরি মোকাবেলা করতে থাকে। এতে এনবিআরের টাকা পাওয়ার পথ সংকুচিত হয়ে আসে। তবে এনবিআর কর্মকর্তারাও নাছোড়বান্দা ছিলেন। এই ঘটনায় নজিরবিহীনভাবে ১৩ ঘণ্টা তারা ব্র্যাক ব্যাংকের গুলশান-১ শাখায় ছিলেন।

শেষ পর্যন্ত ৫১ কোটি টাকা না পাওয়ায় বিষয়টিকে ‘ব্র্যাক ব্যাংকের অসহযোগিতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ’ বলেও মন্তব্য করেছেন কর অঞ্চল-১৫ এর উপ কর কমিশনার ফারজানুল ইসলাম। তবে ব্র্যাক ব্যাংক শুরু থেকেই অসহযোগিতার কথা খারিজ করে বলে এসেছে, আদালতের আদেশ পেলে এনবিআরকে টাকা দিতে তাদের কোনো আপত্তি নেই। সেজন্য পরদিন মে দিবসের বন্ধের মধ্যেও বিষয়টি হাইকোর্টে নিয়ে গেছে ব্র্যাক ব্যাংক। সেখানে শুনানিতে তারা ৩০ এপ্রিলের সেই নজিরবিহীন ১৩ ঘণ্টার বিষয় আদালতের নজরে আনেন এবং এ বিষয়ে করণীয় কী তা জানতে চান। শুনানি শেষে আদালত ৫ মে’র পূর্বনির্ধারিত শুনানির আগ পর্যন্ত ওই অ্যাকাউন্টের টাকা হস্তান্তর করতে নিষেধাজ্ঞা দেন। এর ফলে এখনও দাবিকৃত টাকা পায়নি এনবিআর।

জুয়াড়ি চক্রের নয়া ফন্দি
র‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তারের পর তিন পাত্তি জুয়াড়ি চক্রের শত শত কোটি টাকা আয় ও পাচারের থলের বিড়াল বের হয়ে আসতে থাকে। এরপর সরকারের বিভিন্ন সংস্থা তাদের ব্যাংক একাউন্ট জব্দের উদ্যোগ নেয়। এতে তাদের শেষ কয়েকদিনের আয়ের কিছু অংশ ৮০ কোটি টাকার বেশি আটকা পড়ে যায়। প্রথমে সেদিকে নজর না দিলেও জামিনে মুক্ত হয়ে আসার পর তারা ওই টাকা আত্মসাতের ফন্দি করতে থাকে। ব্র্যাক ব্যাংকের প্রধান আইন কর্মকর্তার বক্তব্যেও বিষয়টি জানা যায়। তিনি গত ৩০ এপ্রিলের ঘটনায় সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘উল্কা গেমসের পক্ষদ্বয়ের আমাদের ব্যাংকে যে রক্ষিত টাকা আছে সেই টাকার বিষয়ে একটি আদেশ আসে। সেই আদেশটা ছিল, পক্ষদ্বয় ব্র্যাক ব্যাংকে রক্ষিত টাকা অন্য একাউন্টে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু ইতিপূর্বে এই টাকায় এনবিআরের ফ্রিজ আদেশ বা নিষেধাজ্ঞা ছিল। তখন আমরা এনবিআরের স্বার্থ রক্ষার্থে বিষয়টি আদালতকে অবগত করি এবং আমাদের করণীয় জানতে চাই। আদালত তখন আরেকটি আদেশ দেন, ৫ মে সেটি শুনানির জন্য কার্যতালিকায় রয়েছে। এখন এটি যেহেতু বিচারাধীন বিষয়, সুতরাং আমরা আদালতের অনুমতি ছাড়া টাকা দিয়ে দিতে পারি না। এখানে ব্র্যাক ব্যাংকের কোনো স্বার্থ নেই। বরং এনবিআরের স্বার্থ রক্ষার জন্যই আমরা আদালতকে বিষয়টি জানিয়েছি। উচ্চ আদালত শুনানি শেষে যে আদেশ দিবেন আমরা সেই মোতাবেক কাজ করব।’

জানা যায়, বিদেশি জুয়াড়ি কোম্পানী মুনফ্রগের পরামর্শেই জুয়ার বিষয়টি গোপন করে শেয়ার সংক্রান্ত বিবাদের নাটক সাজিয়ে কোম্পানী আইনে উচ্চ আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল- দুই কোম্পানীর মধ্যে বিবাদের মামলা হলে আদালত কোম্পানী আইনে বিবেচনা করে যে কোম্পানীর পক্ষেই রায় দিক, টাকা মূলত তাদের হাতেই যাবে। কেননা দুই কোম্পানী মিলেই অনলাইন জুয়াচক্র পরিচালনা করে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে আসছিল।

সূত্র জানায়, প্রথমে এনবিআরকে না জানিয়ে কোর্টের আদেশে টাকা সরিয়ে নিতে চাইলেও ব্র্যাক ব্যাংকের তৎপরতায় সেই চেষ্টা ভেস্তে যায়। এনবিআরের পাওনার বিষয়টিও আদালতের সামনে চলে আসে। এতে হাইকোর্টে ৫ মে’র শুনানিতে জুয়ার বিষয় সামনে চলে আসে কিনা, সেই বিষয়েও জুয়াড়ি চক্র আতঙ্কে ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় দুবাইয়ে কিছুদিন আগে দুই জুয়াড়ি চক্রের একটি বৈঠক হয়। বৈঠকের আলোচনায় তাদের আশঙ্কা ছিল, আদালত যদি কোনভাবে জুয়ার বিষয়টি জেনে সেটি বিবেচনায় নিয়ে পুরো টাকা জব্দ করে সরকারি কোষাগারে নিয়ে নেওয়ার আদেশ দেন, তাহলে পুরোটাই হাতছাড়া হয়ে যাবে। সেজন্য দুই চক্র শেষ পর্যন্ত এনবিআরের করের টাকা পরিশোধে একমত হয়। কোনভাবে এনবিআর যদি করের টাকা নিয়েও যায়, তাহলে বাকিটা ভ্যাট-ট্যাক্স পরিশোধ করা সাদা টাকা হিসেবে বৈধতা পেয়ে যাবে। এতে জুয়াড়ি দুই পক্ষ কথিত বিবাদ মীমাংসানামা দাখিল করে যেকোন এক পক্ষ বা উভয় পক্ষকে বাকি টাকা দিয়ে দেওয়ার আবেদন করবে। পুরোটা হারানোর চেয়ে কিছুটা পাওয়া ভালো, এটাই ছিল সেদিনকার বৈঠকের মূল সিদ্ধান্ত।

তিন পাত্তি জুয়া চক্রের পেছনে কারা
র‌্যাবের অভিযানে ৫ প্রধান সহযোগীসহ উল্কা গেমসের সিইও জামিলুর রশীদ গ্রেপ্তার হওয়ার পর বেরিয়ে এসেছিল মাফিয়া চক্রের পরিচালনায় ভয়ঙ্কর জুয়াড়িদের টাকা পাচারের তথ্য। বাংলাদেশে এর পরিচালনার দায়িত্বে ছিল জামিলুর রশীদ। সে তার সহযোগীদের দিয়ে হাজার কোটি টাকা পাচার করে আসছিল।

র‌্যাবের অভিযানে জুয়ার বিষয় উঠে আসলে ভারতের বেঙ্গালুরুতেও জুয়াড়ি কোম্পানী মুনফ্রগের সদর দপ্তরে ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালায়। এর আগেও একাধিকবার মুনফ্রগের বিরুদ্ধে ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়েছিল। সেসময় গোয়েন্দা সূত্রে জানা গিয়েছিল, পাকিস্তান এবং দুবাইভিত্তিক একটি মাফিয়া গোষ্ঠী তিন পাত্তি জুয়া চক্র পরিচালনা করছিল। ওই মাফিয়া গোষ্ঠীর আয়ের মূল উৎস ছিল তিন পাত্তি গোল্ড। ভারতে ধাওয়া খেয়ে গোয়েন্দা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে মুনফ্রগ তখন সুইডেনে আশ্রয় নেয়। সুইডেনের কাগুজে কোম্পানী স্টিলফ্রন্টকে দিয়ে মুনফ্রগ অধিগ্রহণ করে নেওয়া হয়েছে বলে খবর ছড়ানো হয়। সুইডেনের অধিগ্রহণকৃত কোম্পানীর বিরুদ্ধে যেন ভারত সরকার কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারে, সেজন্যই মূলত এই নাটক সাজানো হয়েছিল। পরে ২০২২ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের উল্কা গেমসের বিষয়েও নিজেদের ওয়েবসাইটে বিবৃতি দিয়েছিল জুয়াড়ি কোম্পানী স্টিলফ্রন্ট। বিবৃতিটি দেখুন এখানে মূলত বিভিন্ন দেশের সরকার, আইশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দেওয়ার লক্ষ্যে এসব করে আন্তর্জাতিক মাফিয়াদের জুয়াড়ি চক্র। সেই ধারাবাহিকতায় এখনও অবৈধ জুয়ার জব্দ টাকাকে কোম্পানী আইনের ম্যাটার হিসেবে নিয়ে হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে মুনফ্রগ ও উল্কা গেমস নামক সেই দুই জুয়া কোম্পানী।

জুয়ার জব্দ টাকা আসলে কে পাবে?
জুয়াকাণ্ডে জব্দ হওয়া পুরো ৮০ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, জুয়া পরিচালনা করা এবং জুয়া পরিচালনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করা অবৈধ কর্মকাণ্ড। কেননা জুয়া খেলার টাকা এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদি সংগ্রহ করতে গিয়ে অনিয়ম ও অপরাধে জড়িয়ে পড়েন জুয়াড়িরা। সেজন্য বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে এর কোনরূপ বৈধতা নেই। সুতরাং অবৈধ জুয়ার টাকায় ভ্যাট-ট্যাক্স আরোপ হওয়ার কথা নয়।

অন্যদিকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে কোম্পানীর রেজিস্ট্রেশন নেওয়াটাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এখনও যদি কেউ মিথ্যা তথ্য দিয়ে জব্দ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ফন্দি করে থাকে, তাহলে সেটি ভয়ঙ্কর ব্যাপার। উচ্চ আদালত নিশ্চয়ই সব বিষয় বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। তবে এটুকু বলা যায় যে, জুয়াড়ি কোম্পানী কোনভাবেই জব্দ টাকা ফেরত পাওয়ার অধিকার রাখে না। জব্দ হওয়া টাকার পুরোটাই সরকারি কোষাগারে জমা করা উচিত। এতে দেশের জনগণ লাভবান হবে।


ঢাকাওয়াচ/স

ঢাকাওয়াচ২৪ এর খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন ।
ঢাকাওয়াচ২৪ডটকমে লিখতে পারেন আপনিও ফিচার, তথ্যপ্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, ভ্রমণ ও কৃষি বিষয়ে। আপনার তোলা ছবিও পাঠাতে পারেন dhakawatch24@gmail.com ঠিকানায়।
×