‘সোর্সকে’ পুলিশের ভেস্ট পরিয়ে সড়কে তল্লাশি, এসআইকে গণধোলাই
- জয়পুরহাট প্রতিনিধি
- প্রকাশঃ ০৬:৩৩ পিএম, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪
জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুর থানার উপপরির্দশক (এসআই) ইউনুছ আলী ও তার কথিত সোর্স পারভেজ হোসেনকে গণধোলাই দিয়েছেন জনতা। সংবাদ পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের দুইজনকে উদ্ধার করেছে।
বুধবার (৪ ডিসেম্বর) রাত সাড়ে নয়টার দিকে আক্কেলপুর-জয়পুরহাট সড়কের আক্কেলপুর উপজেলার হালির মোড় বাজারে এ ঘটনা ঘটে।
ইউনুছ আলী তার সোর্সকে নকল পুলিশ সাজিয়ে তারা দুইজন মিলে সড়কে তল্লাশি চৌকি বসিয়ে যানবাহন আটকিয়ে ঘুষ বাণিজ্য ও হয়রানী করছিলেন বলে অভিযোগ স্থানীয় জনতার। এ ঘটনায় বুধবার (৪ ডিসেম্বর) রাত সাড়ে দশটার দিকে জয়পুরহাটের পুলিশ সুপার (এসপি) মুহম্মদ আবদুল ওয়াহাব আক্কেলপুর থানায় ছুটে আসেন। তিনি ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা পেয়ে ইউনুছ আলীকে থানা থেকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করেছেন। পুলিশের রিফ্লেক্টিভ ভেস্টসহ আটক সোর্স পারভেজ হোসেনের বিরুদ্ধে রাতেই থানায় একটি মামলা হয়েছে। ওই মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখিয়েছে পুলিশ।
মুহম্মদ আবদুল ওয়াহাব বলেন, ‘ইউনুছ আলীকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করা হবে। সোর্স পারভেজ হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’
পারভেজ হোসেন নওগাঁর বদলগাছি উপজেলার চকবেনী গ্রামে নজরুল ইসলামের ছেলে। তিনি জয়পুরহাট আদালতের একজন আইনজীবী সহকারী হিসেবে কাজ করেন। এ ছাড়া, পুলিশের সোর্সের কাজও করেন বলে জানিয়েছেন পারভেজ।
থানা পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আক্কেলপুর-জয়পুরহাট সড়কের আক্কেলপুর পৌরশহরের কেসের মোড় নামের স্থানটি রাতে বিপদজনক। সেখানে আগে চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটত। বুধবার (৪ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় থানার এসআই ইউনুছ আলী কেসের মোড়ে গোপনে তল্লাশি চৌকি বসান। ইউনুছ আলী সাদা পোশাকে আর সোর্স পারভেজ হোসেন পুলিশের রিফ্লেক্টিভ ভেস্ট পরে তল্লাশি চৌকিতে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এ সময় তারা সড়কের উভয় দিকে চলাচলকারী অটোভ্যান, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল ও বাইসাইকেল আরোহীদের তল্লাশি চৌকিতে থামান।
ইউনুছ আলীর নির্দেশে পারভেজ কয়েক জনকে ভয়ভীতি দেখিয়ে ঘুষ নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তল্লাশি চৌকি পরিচালনার বুধবার (৪ ডিসেম্বর) সময় রাত সাড়ে আটটার দিকে আক্কেলপুর পৌরশহরের দিক থেকে একটি মোটরসাইকেল জয়পুরহাটে দিকে যাচ্ছিল। মোটরসাইকেলটি তল্লাশি চৌকিতে পৌঁছালে পুলিশের রিফ্লেক্টিভ ভেস্ট পরা সোর্স পারভেজ মোটরসাইকেলটি থামানোর সংকেত দেন। বিপদভেবে মোটরসাইকেলের চালক দ্রুত গতিতে তল্লাশি চৌকি অতিক্রম করে চলে যান। এ ঘটনার এক মিনিট পর তল্লাশি চৌকিতে আরেকটি মোটরসাইকেল থামানো হয়। পুলিশের রিফ্লেক্টিভ ভেস্ট পরা সোর্স ওই মোটরসাইকেলের পেছনে চড়ে আগের চলে যাওয়া মোটরসাইকেল ধাওয়া করেন। হালির মোড়ে পৌঁছার পর মোটরসাইকেল চালক ওই সোর্সকে নামিয়ে দেন। তখন সোর্স নিজেকে পুলিশ সদস্য পরিচয় দিয়ে মোটরসাইকেল চালককে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে তাকে মারধর উদ্যত হন। পুলিশ দেখে সেখানে উৎসুক লোকজন জড়ো হন।
মোটরসাইকেল চালক উৎসুক লোকজনদের ঘটনাটি খুলে বলেন। তখন জনতা রিফ্লেক্টিভর ভেস্ট পরা ব্যক্তির কাছে পুলিশের পরিচয়পত্র দেখতে চান। তিনি তখন পুলিশের পরিচয় দেখাতে ব্যর্থ হন। এক পর্যায়ে পুলিশের সদস্য নন বলে জনতার কাছে স্বীকার করেন। এতে উত্তেজিত জনতা তাকে আটকে রেখে মারধর করেন। খবর পেয়ে কেসের মোড় থেকে ইউনুছ আলী তার সঙ্গীকে রক্ষা করতে বাঁশি বাজাতে-বাজাতে হালির মোড়ে ছুটে যান। তখন উত্তেজিত জনতা পুলিশের রিফ্লেক্টিভর ভেস্ট পরা ব্যক্তি পুলিশ কি না তা ইউনুছ আলীর কাছে জানতে চান। ইউনুছ আলী ওই ব্যক্তিকে পুলিশ বলে পরিচয় দেন। এতে উপস্থিত জনতা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তারা ইউনুছ আলীকেও মারধর শুরু করেন। পরে স্থানীয় কয়েক ব্যক্তি তাদের দুইজনকে উদ্ধার করতে গিয়ে তারাও মারধরের শিকার হন।
এক পর্যায়ে থানা পুলিশের একটি দল তাদের দুইজনকে উদ্ধার করতে এসে উপস্থিত জনতার রোষানলে পড়েন। থানা পুলিশ রাত নয়টার পর তাদের দুইজনকে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসেন। এরপর রাত সাড়ে দশটার দিকে মুহম্মদ আবদুল ওয়াহাব আক্কেলপুর থানায় আসেন। এসপি রাতেই অভিযুক্ত ইউনুছ আলীকে থানা থেকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করেন। এ ঘটনায় রাতেই পারভেজ হোসেনের বিরুদ্ধ একটি মামলা করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হালির মোড় এলাকার বাসিন্দা বলেন, ‘ইউনুছ আলী ও আরেক জন পুলিশের লাইট জ্যাকেট (রিফ্লেক্টিভর ভেস্ট) পরে কেসের মোড়ে যানবাহন আটকাচ্ছিলেন। পরে হালির মোড়ে এসে একজন ভুয়া পুলিশ ধরা পড়ে। ইউনুছ টাকা ছাড়া কিছুই বুঝেন না।’
রাতে থানার নারী ও শিশু হেল্প ডেস্কের কক্ষে পারভেজ হোসেনকে রাখা হয়েছে। পারভেজ হোসেন বলেন, ‘আমি জয়পুরহাট আদালতের একজন আইনজীবী সহকারী হিসেবে কাজ করি। পাশাপাশি, রাতের বেলায় পুলিশের সোর্সের কাজ করে আসছি। পুলিশের রিফ্লেক্টিভর ভেস্টটি আমার বাড়িতে ছিল। আমার দুলাভাই এমদাদ পুলিশের এসআই। তিনি চট্টগ্রামে চাকরি করেন। এই রিফ্লেক্টিভ ভেস্টটি আমার দুলাভাইয়ের। ইউনুছ আলী আমাকে ডেকে নিয়ে আসেন। বুধবার সন্ধ্যা থেকে তার সঙ্গে কেসের মোড়ে কাজ করছিলাম। একটি মোটরসাইকেলে চড়ে অন্য একটি মোটরসাইকেল ধাওয়া করছিলাম। হালির মোড় এসে আমাকে মোটরসাইকেল থেকে নামিয়ে দেয়া হয়। তখন লোকজন জড়ো হয়। এতে বিপত্তি ঘটে। লোকজনের কাছে নিজে পুলিশ নয়, পুলিশের সোর্স বলে পরিচয় দিয়েছি। আমার গায়ে পুলিশের রিফ্লেক্টিভ ভেস্টটি দেখে ক্ষিপ্ত হন। তখন লোকজন ইউনুছ ও আমাকে মারধর করে।
ইউনুছ আলী বলেন, ‘পারভেজ পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করেন। আমি তাকে ডেকে আনিনি। পুলিশের রিফ্লেক্টিভর ভেস্ট পরে মোটরসাইকেল ধাওয়া করতে গিয়ে লোকজনের হাতে ধরা পড়েছিল। তাকে রক্ষা করতে গিয়ে আমিও উত্তেজিত জনতার মারধরের শিকার হয়েছি।’
আক্কেলপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মইনুল ইসলাম বলেন, ‘আমি সাক্ষী দিতে গিয়েছিলাম। থানায় পৌঁছে নকল পুলিশ আটকের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠিয়ে উদ্ধার করে এনেছি। যে ভ্যান আটকিয়ে রেখেছিল, সেই ভ্যানচালক বাদী হয়ে থানায় একটি মামলা করেছেন।’