দুর্নীতির সম্পদের পাহাড় ফেরাতে না পারলে কিসের বিপ্লব
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- প্রকাশঃ ০৬:৫০ পিএম, ২৮ নভেম্বর ২০২৪
‘দুর্নীতি ও লুন্ঠনের মাধ্যমে সম্পদে গড়ে তোলা হয়েছে। এগুলো কেন বাজেয়াপ্ত হল না? এ সম্পদ কোথায় গেল? এই সম্পদ কেন আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকার অধিগ্রহণ করল না! লুণ্ঠনকারীদের যাদের ব্যাংক ঋণ আছে, সেগুলো সমন্বয়ের জন্য তাদের সম্পত্তি কেন দ্রুত সময়ের মধ্যে অধিগ্রহণ করা হল না। এমন পদক্ষেপের কথা শোনা গেলেও দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি নেই।’ এটি করা গেলে আমি নিশ্চিত মানুষের মধ্যে কর দেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ বাড়বে বলে জানান শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
তিনি বলেন, ‘দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের যে পাহাড় গড়ে উঠেছে, সেখান থেকে জনগণের সম্পদ ফিরিয়ে নিতে না পারলে কিসের বিপ্লব হল।’
বৃহস্পতিবার (২৮ নভেম্বর) ঢাকার পল্টনে অর্থনীতি বিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইআরইফ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংলাপে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান এসব কথা বলেন। ইআরএফ ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান র্যাপিডের যৌথ আয়োজনে বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও বাজেটের উন্মুক্ততা নিয়ে জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
আর্থিক খাতসহ নানা বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ আছে, তবে কেন যেন উদ্বেগটা কাটছে না, এর কারণ ব্যাখ্যা করে সরকারের কাছে প্রশ্ন শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘সরকার যেসব উদ্যোগ নিচ্ছে, তার ফল আসছে না। মানুষ অত ধৈর্য্য রাখতে পারছে না। কিংবা আস্থার সংকট হচ্ছে।’
এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারে থাকাকালীন ইআরএফের এক অনুষ্ঠানে এই বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বলেছিলেন ‘ডাল মে কুচ কালা হে’। এই উদ্বৃতি ফের উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আগামী রোববার বলতে পারব কোন কোন ডাল পচা, আর কোন কোন ডাল ভাল ছিল। রোববার প্রধান উপদেষ্টার কাছে শ্বেতপত্র হস্তান্তর করা হবে। পর দিন সংবাদ সম্মেলনে জনগণের জন্য গত সরকারের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার চিত্র তুলে ধরা হবে।
দেশের দুইটি ফুসফুস ব্যাংক ও জ্বালানি খাত। এই দুই খাতে বড় ধরনের অনিয়মের কথা উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘ব্যাংক ও জ্বালানিখাতে বেশি লুটপাট হয়েছে। এসব তুলে ধরা হবে প্রতিবেদনে।’
দুর্নীতি প্রসঙ্গে দেবপ্রিয় বলেন, ‘সাধারণ মানুষের যে ধারণা আছে, তার চেয়ে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল। এমন একটি অর্থনীনৈতিক পরিস্থিতিতে কোন উত্তারাধিকার সরকারের করার কিছু থাকে না। ব্যাংকি খাতে সমস্যা বেশি ছিল। তাৎক্ষণিক দূর করার চেষ্টা চলছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর যতটা উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে, তা যদি সরকার দক্ষতার সাথে পরিচালনা করতে না, পারে তবে দেশের মানুষকে ততটাই হতাশ করা হবে। এ জন্য বছর শেষে সরকারকে পাঁচ মাসের মূল্যায়ন উপস্থাপন করতে হবে। কি কি সরকারের দিক থেকে করা হয়েছে। এগুলো একত্রিত করে প্রকাশ করতে হবে। বাজেটের আগে চলমান পরিস্থিতিতে আগামী আগামী ছয় মাসের পরিকল্পনা প্রকাশ করতে হবে। এর মধ্যে মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ, সরকারি ব্যয়, রাজস্ব আয় ও বৈদেশিক খাতের ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা তুলে ধরতে হবে। আগামী জানুয়ারিতে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা জন্য অন্তভূক্তিমূলক টেকসই উন্নয়ন ফোরাম গঠন করতে পারলে আগামী বাজেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারবে।’
দেবপ্রিয় বলেন, ‘আর্থিক স্বস্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে সংস্কার করা কঠিন হবে।’
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনে রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড) চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার এমনভাবে রেখে গেছে, তার খেসারত আমরা গুনছি। বেপরোয়া অনেক নীতি নিয়ে ছিল। ফলে মূল্যস্ফীতি হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এখন ব্যাংক থেকে টাকা লুটপাট ও চুরি বন্ধ হয়েছে। এর সুফল পাওয়া যাবে। ব্যাংকের আমানত সংগ্রহ ও রপ্তানি বেড়েছে। বর্তমানে নেওয়া নীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ সাড়া দেখতে পাচ্ছি। তবে, আর্থিক ব্যবস্থাপনা কঠিন হবে। কারণ, আগামী ছয় মাস অত্যন্ত কঠিন সময় যাবে। এর মধ্যে রিজার্ভ বাড়াতে হবে। রিজার্ভ না বাড়লে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব হবে না।’
জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন র্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক আবু ইউসুফ বলেন, ‘সরকারের ব্যয় সচ্ছতার সঙ্গে হচ্ছে কিনা। জনগন খুবই কম জানতে পারছে। বাজেট ব্যয়ে সচ্ছতা ৩৭ শতাংশ। যা যথেষ্ট নয়। এক্ষেত্রে ভারত, নেপাল ও শ্রীলংকার চেয়ে পিছিয়ে আছে। কেবল পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে। বাজেটে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ১১ শতাংশ আর বাজেট বাস্তবায়ন তদারকি হচ্ছে ৩৭ শতাংশ।’
অর্থ মন্ত্রনালয়ের যুগ্ম সচিব আনোয়ারুল কবির বলেন, ‘বাজেট বাস্তবায়নে কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। এটা কিভাবে তরান্বিত করা যায় তার চেষ্টা করা হবে। জরিপে বেশ কিছু সুপারিশ এসেছে, তা নিয়ে কাজ করবে অর্থ মন্ত্রণালয়।’
প্রথম আলোর হেড অফ অনলাইন শওকত হোসেন মাসুম বলেন, ‘এখন প্রত্যাশা সবার বেশি। রাতারাতি মূল্যস্ফীতি কমে যাবে না। এর জন্য সময় গালবে। তবে, মূল্যস্ফীতি কমানোর ক্ষেত্রে আস্থার সংকট আছে। মূল্যস্ফীতি কমাতে সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু, শুরুতে বেসরকারি খাতের সঙ্গে যোগাযোগে ঘাটতি ছিল। আর আস্থা সংকটের আরেকটি কারণ আইন শৃঙ্খলার ঘাটতি।’
তিনি আরো বলেন, ‘ডিসেম্বরের মধ্যে সরকার যা করতে চায়, তার আগামী ছয় মাসের পরিকল্পনা মানুষকে জানালে আস্থা ফিরবে।’
ইআরএফের সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।