সেনাপ্রধানের কার্যালয় থেকে সরল পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ছবি, কেন এই সিদ্ধান্ত?
- আন্তর্জাতিক ডেস্ক
- প্রকাশঃ ০৪:৪৫ পিএম, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪
অর্ধশতাব্দী ধরে ভারতীয়দের কাছে ‘সবচেয়ে বড় সামরিক বিজয়ের’ প্রাণবন্ত প্রতীক ছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের নথিতে সইয়ের একটি ছবি। তবে, সম্প্রতি ছবিটি সেনাপ্রধানের কার্যালয় থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ছবিটি গত পাঁচ দশক ধরে সেনাপ্রধানের কার্যালয়ে ঝুলে ছিল এবং প্রায়ই বিদেশি জেনারেল ও অন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে তোলা ছবির পটভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হত। সংবাদ টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া ও দ্য হিন্দুর।
সেনাপ্রধানের লাউঞ্জে নতুন একটি চিত্রকর্ম স্থাপন করা হয়েছে। এই নতুন চিত্রকর্ম ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দৃশ্য তুলে ধরা ঐতিহাসিক চিত্রকর্মের জায়গায় প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
সেনাবাহিনীর একটি সূত্র জানিয়েছে, নতুন চিত্রকর্মটির নাম হিন্দি ও ইংরেজিতে ‘করম ক্ষেত্র - ফিল্ড অব ডিডস’। এই চিত্রকর্ম ভারতীয় সেনাবাহিনীর ২৮ মাদ্রাজ রেজিমেন্টের কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল থমাস জ্যাকব এঁকেছেন। এতে সেনাবাহিনীকে ‘কেবল জাতির প্রতিরক্ষা নয়, এর পাশাপাশি ধর্মের রক্ষক, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও জাতীয় মূল্যবোধের সংরক্ষক’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এটি সেনাবাহিনীর প্রযুক্তিগত উন্নতি ও একীভূত শক্তি হিসেবে রূপান্তরকেও তুলে ধরেছে।
নতুন চিত্রটির ব্যাকগ্রাউন্ডে তুষারঢাকা পাহাড়, ডান দিকে লাদাখের প্যাংগং লেক ও বাম দিকে গরুড় (হিন্দু পুরাণে উল্লেখিত পক্ষিশ্রেষ্ঠ ও বিষ্ণুর বাহন) ও কৃষ্ণের রথ এবং চাণক্যের (রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি বিষয়ে প্রাচীন ভারতের এক দিকপাল) উপস্থিতি রয়েছে। পাশাপাশি, আধুনিক সামরিক সরঞ্জাম যেমন ট্যাংক, অল-টেরেইন যান, পেট্রল বোট, দেশীয় লাইট কমব্যাট হেলিকপ্টার ও অ্যাপাচি অ্যাটাক হেলিকপ্টারের চিত্রও প্রদর্শিত হয়েছে।
সেনাবাহিনীর এক সূত্র নাম প্রকাশ না করা বলেছে, ‘এই চিত্রকর্মটি এমন একটি দেশকে উপস্থাপন করে যার সমৃদ্ধ সভ্যতা রয়েছে, যা বরাবরই ন্যায়পরায়ণ ও প্রয়োজনমত বলপ্রয়োগে বিশ্বাস করে। এটি সাহসী, আধুনিক ও দক্ষ একটি সেনাবাহিনীকে তুলে ধরে, যারা সব সময় নিজেদের সীমান্ত এবং স্বার্থ রক্ষায় প্রস্তুত।’
সূত্রটি আরও জানিয়েছে, এটি মহাভারতের শিক্ষার ভিত্তিতে সেনাবাহিনীর ন্যায়পরায়ণতার প্রতি চিরস্থায়ী অঙ্গীকারকে প্রতিফলিত করে। চাণক্যের কৌশলগত ও দার্শনিক প্রজ্ঞাও এতে অন্তর্ভুক্ত, যা নেতৃত্ব, কূটনীতি ও যুদ্ধে সেনাবাহিনীর দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে সহায়ক। সাম্প্রতিক সময়ে প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থ অধ্যয়ন এবং ভারতীয় দর্শন ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে একটি ‘দেশজ কৌশলগত শব্দভান্ডার’ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।
সূত্র আরও জানিয়েছে, এই নতুন চিত্রকর্মটি আধুনিক ভারতীয় সেনাবাহিনীর উন্নত প্রযুক্তি, স্থল, বায়ু ও সাগরের মধ্যে সমন্বয় এবং প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কার্যকর হামলার প্রস্তুতিকে তুলে ধরে। এর মূল বার্তা হল-সেনাবাহিনীর আত্মত্যাগ, শৃঙ্খলা ও বীরত্বের ঐতিহ্যকে সম্মান জানানো, পাশাপাশি ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তাদের অটুট সংকল্প দেখানো।
তবে, বেশ কয়েকজন সাবেক সেনাসদস্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই পরিবর্তন নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। উত্তরাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এইচএস পানাগ লিখেছেন, ‘গত এক হাজার বছরে ভারতের প্রথম বড় সামরিক বিজয় ও একক জাতি হিসেবে প্রথম বিজয়- ১৯৭১ সালের প্রতীকী ছবি/চিত্রকর্মটি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটি এমন এক পদক্ষেপ, যা থেকে মনে হয় মিথ, ধর্ম ও দূরবর্তী খণ্ডিত সামন্ত শাসনের ইতিহাস ভবিষ্যতের বিজয়ের অনুপ্রেরণা দেবে।’
প্রসঙ্গত, ভারতের সেনাপ্রধানের লাউঞ্জে বাংলাদেশ সংক্রান্ত যে ছবিটি আগে টাঙানো ছিল, সেটির পটভূমি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের। ঐতিহাসিক ছবিটিতে দেখা যায়, পাকিস্তানের লেফটেন্যান্ট জেনারেল এএকে নিয়াজি আত্মসমর্পণের দলিলে সই করছেন। তার পাশে বসে আছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান ও বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন বাংলাদেশের কমান্ডার এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকার, ভাইস অ্যাডমিরাল কৃষ্ণন, এয়ার মার্শাল দেওয়ান, লেফটেন্যান্ট জেনারেল স্বাগত সিং এবং মেজর জেনারেল জেএফআর জ্যাকব।
ভারতীয় বিমানবাহিনীর সাবেক এয়ার ভাইস মার্শাল মনমোহন সিং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ঢাকা আত্মসমর্পণ ছবিটি সরানোর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এখানে বিদেশি বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ও সামরিক প্রধানেরা সেনাপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং ভারতের ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘটনাটির প্রতীকটি দেখেন। কিন্তু, এখন, এই অপটু উদ্যোগ কেন?’
পুরোনো চিত্রকর্মটি কোথায় রাখা হয়েছে, সেটি অন্য কোথাও টানানো হয়েছে কিনা তা স্পষ্ট নয়। আর সরকার বা সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ছবি সরানো নিয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক কোন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।