পুলিশের ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর নিয়ন্ত্রণ কমাতে হবে
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- প্রকাশঃ ০৭:৪৫ পিএম, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪
‘ব্রিটিশ আমল থেকেই পুলিশকে সরকারের পেটুয়া বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। দেশ স্বাধীন আর ক্ষমতার পালাবদলেও এই সংস্কৃতি থেকে আমরা বের হতে পারিনি। পুলিশের ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর নিয়ন্ত্রণ কমাতে হবে। পুলিশকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। স্পেশালাইজড নামে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে ইউনিট গঠন না করে পুলিশের কাঠামো ঠিক করতে হবে। একই সঙ্গে পুলিশ সদস্যদের রাজনৈতিক নেতার অন্যায় আবদারে না বলার সাহস রাখতে হবে। পুলিশ সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। তাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া পুলিশের সংস্কার ফলপ্রসূ হবে না।’
শনিবার (২১ ডিসেম্বর) সকালে সিরডাপ মিলনায়তনে সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের (সিজিএস) অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারের অগ্রাধিকার ক্ষেত্রগুলো নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজন ‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ: আইনশৃঙ্খলা প্রসঙ্গ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
সংলাপের শুরুতে সিজিএজের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ত্রুটি হল সুশানের অভাব। সংস্কার শব্দটি অনেক ব্যবহৃত হচ্ছে, কিন্তু এটি ঘৃণিত শব্দে পরিণত হয়েছে। সংস্কার চলমান একটি প্রক্রিয়া। আমরা সাধারণ মানুষের কথা শোনার চেষ্টা করছি। অন্তর্বর্তী সরকার আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। সাধারণ জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, ব্যবসায়ীরা নিরাপদে ব্যবসা করতে পারছে না, পুলিশ মনোবল হারিয়ে ফেলেছে এবং প্রতিনিয়ত মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে।’
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল আনম মুনীরুজ্জামান বলেন, ‘সার্বিকভাবে কীভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ঠিক করা যায়, তার ওপর নজর দিতে হবে। কেবল পুলিশের ওপর নয়। রাজনৈতিক দলগুলোকে কমিশনের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলে কমিশনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যা করা হচ্ছে না। পুলিশকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। পুলিশের মানসিক স্বাস্থ্যে ঘাটতি আছে। বর্তমান প্রযুক্তিগুলো পুলিশ সদস্যদের শিখাতে হবে। জনগণেরও পুলিশকে সাহায্য করতে হবে। পুলিশের কাজের তদারকি করার ব্যবস্থা করতে হবে। পার্লামেন্টে পুলিশের কোড অব কন্ডাক্ট তৈরি করতে হবে। পর্যালোচনা প্রক্রিয়া আনতে হবে। জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল তৈরি করতে হবে। অ্যাডভোকেসি গ্রুপগুলোকে সাহায্য করতে হবে যেন ওয়াচ ডগ হিসেবে কাজ করতে পারে। জনগণকে তাদের দাবি তুলে ধরতে হবে, যেন সেই দাবিগুলো তারা পূরণ করতে পারে।’
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন বলেন, ‘বিগত সরকার এমন আভাস দিয়েছে যে, তারা ক্ষমতায় না থাকলে অনেক মানুষ মারা যাবে। পুলিশের সেবা নাকি পুলিশের নিয়ন্ত্রণ দরকার? এখানে কাজ করতে হবে। পুলিশের ওপর নিয়ন্ত্রণ কমাতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কার করতে হবে, যেন ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ না হয়। পুলিশের কাজ সেবা করা, এটি সব রাজনৈতিক দলগুলোকে বুঝতে হবে।’
সাবেক আইজিপি এম এনামুল হক বলেন, ‘রাজনৈতিক নেতার আদেশের বিরুদ্ধে পুলিশ সদস্যদের না বলার সাহস থাকতে হবে। কমিশন আগেও হয়েছে, কিন্তু তার প্রয়োগ হয়নি। তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।’
সাবেক আইজিপি মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, ‘পুলিশকে আমরা হেনস্তাকারী সংস্থা হিসেবে তৈরি করেছি। বিচার সব জায়গায় থাকতে হবে, কেবল পুলিশের ক্ষেত্রেই নয়। ক্ষমা সবার চাইতে হবে। যারা নির্দেশ দিয়েছে ও অর্থনীতি ধ্বংস করেছে তাদেরও ক্ষমা চাইতে হবে এবং বিচারের আওতায় আনতে হবে। ইতিবাচক কর্তৃত্ববাদী থাকতে হবে। অতিরিক্ত জোর প্রয়োগ যেন কেউ আর না করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।’
পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য মো. জারিফ রহমান বলেন, ‘পুলিশ ও জনগণের মধ্যে একটা ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে। পুলিশ তার ভুল স্বীকার করেছে। কিন্তু দোষীদের বিচারেরে আওতায় আনতে হবে। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ হয়েছে। এটার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে কমিউনিটি পর্যায় থেকে। এখানে নজর দিতে হবে। চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স কমিউনিটি পর্যায় থেকে শুরু করলে অন্য কেউ জুলাই-আগস্টের মত কিছু করতে চাইলেও পারবে না। কমিশনে এমন মানুষ থাকতে হবে যারা চাপিয়ে দেওয়া নির্দেশের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারবে।’
সাবেক সাংসদ উষাতন তালুকদার বলেন, ‘আমরা বলি- দেশের মালিক জনগণ। কিন্তু আসলেই কি তাই? যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করে তারা কার স্বার্থে কাজ করে? পুলিশ নিয়োগের ক্ষেত্রে তার দলীয় পরিচয় দেখা যাবে না। যারা ক্যাডার হয় তারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সামগ্রিকভাবে মূল্যবোধ ঠিক করতে হবে। সেনাবাহিনী থেকে র্যাব নিয়োগ দেওয়া যাবে না। গায়েবি মামলা নিয়ে বর্তমান সরকার কিছু করেনি। পুলিশের বেতন-ভাতা বাড়ানো নিয়ে চিন্তা করতে হবে। পার্বত্য অঞ্চলে পুলিশের ক্ষমতা জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করতে হবে।’
হামীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক একে আজাদ বলেন, ‘৫২ থেকে এ পর্যন্ত পুলিশের তুলনা করে দেখেন, তার উন্নতি হয়েছে নাকি অবনতি? পুলিশকে এই পর্যায়ে কে নিয়ে গেল? এগুলো রাজনৈতিক দলগুলো করে থাকে। পুলিশকে অমানবিক কাজে নিয়োজিত করা যাবে না। র্যাবকে বিলুপ্ত করতে হবে। এগুলো না করলে এটা চলতেই থাকবে।’
প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান বলেন, ‘গত ৫৪ বছরে আমরা রাষ্ট্র গঠন করতে পারিনি। গত চার মাসে কিছু কমিশন হয়েছে। কিন্তু, সেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘু বা উপজাতি প্রতিনিধি নেই। বৈষম্য ভেদাভেদ দূর করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী স্বাধীনভাবে কি কাজ করতে পারে? বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হতে হবে। পুলিশ ও বিচার বিভাগকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন ভবিষ্যতে কোন সমস্যা না হয়।’
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির সভাপতি আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, ‘আমাদের দেশে একজন ভাল রাজনীতিবিদ দরকার। ভাল মানুষদেরকে সংসদে আসতে হবে, দেশ শাসনে আসতে হবে। খারাপ ভোটার খারাপ মানুষদেরকে ক্ষমতায় আনবে।’
অধিকারের পরিচালক এএসএম নাসিরুদ্দিন এলান বলেন, ‘পুলিশ গত ১৫ বছর অনেক নিয়ম লঙ্ঘন করেছে। তারা দায়মুক্ত ছিল যা বিগত সরকার দিয়েছে। জুলাই-আগস্টের পর পুলিশের মনোবল কমে গেছে। আমরা যেই সংস্কারের দিকে যেতে চাচ্ছি সেদিকে যেতে পারছি না।’
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, ‘পুলিশকে রাজনীতিকরণ করা হয়েছে। এটি প্রতিরোধ করার জন্য মানবাধিকার সনদ মানতে হবে এবং আমাদের যা নিয়ম আছে তা অনুসরণ করতে হবে। পুলিশের কাঠামো ঠিক করতে হবে। রাজনীতির সংস্কার করতে হবে।’
এবি পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, ‘আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠাতারা রাষ্ট্র কী তা তারা বুঝতে পারেনি। রাজনৈতিক দলগুলো আর্টিকেল ৭’-এর মধ্যে আটকিয়ে আছে। এই রাষ্ট্রতে জমিদারি অবস্থা, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এখনও চলছে। এখান থেকে বের হতে হবে। আমাদের এ দেশের নাগরিক হতে হবে, বাসিন্দা নয়।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডজের গবেষণা ফেলো সাফকাত মুনির বলেন, ‘পুলিশে এত স্পেশালাইজড ইউনিট লাগবে না। এতে প্রতিযোগিতা তৈরি হয়। পুলিশের কাঠামোর দিকে নজর দিতে হবে। পুলিশেরও ন্যায্য দাবি দেখতে হবে।’
সাবেক জজ ইকতেদার আহমেদ বলেন, ‘পুলিশের সংজ্ঞা ঠিক করতে হবে। অতীতে ও বর্তমান সরকার সংবিধান লঙ্ঘন করে কাজ করছে। এ রকম হতে থাকলে দেশে কখনো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতে পারবে না।’
সিজিএসের চেয়ারম্যান মুনিরা খান বলেন, ‘ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত সবাই পুলিশকে ব্যবহার করেছে। অন্যায়কারীদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। বিচার বিভাগের সঙ্গে পুলিশের সমন্বয় করতে হবে।’