বাংলাদেশে সমুদ্র দূষণ রোধে প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস
- নিউজ ডেস্ক
- প্রকাশঃ ০৩:০০ পিএম, ০৭ মার্চ ২০২৩
আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে ২০১২ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ায় মোট ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার বেশি সমুদ্র এলাকা এখন বাংলাদেশের। এছাড়া ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল ও চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৪৫ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহিসোপানের তলদেশে সবধরনের প্রাণিজ-অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রে বিরোধপূর্ণ ১৭টি ব্লকের ১২টি পেয়েছে বাংলাদেশ এবং ভারতের কাছ থেকে দাবিকৃত ১০টি ব্লকের সবগুলোই পেয়েছে বাংলাদেশ। এসব ব্লক থেকে প্রায় ৪০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া সম্ভব। ২ বছরের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল প্রদত্ত এ রায় দুইটি বাংলাদেশের জন্য ‘সমুদ্র বিজয়’ নামে আখ্যায়িত হয়েছে।
বাংলাদেশের সমুদ্র বিজয়ের পর আন্তর্জাতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ একটি দেশ হিসেবে আলোচিত ও স্বীকৃত বাংলাদেশ, যে দেশে মানব স্বাস্থ্য এবং জীববৈচিত্র্যের জন্য একটি অন্যতম সমস্যা সামুদ্রিক ও উপকূলীয় দূষণ। বাংলাদেশের সমুদ্রাঞ্চল ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার। এই বিশাল সমুদ্র সীমার দূষণ ঠেকাতে না পারলে আমাদের এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জলজ প্রাণিজগৎ বিপন্ন হবে, হুমকির মুখে পড়বে জলবায়ু, মানবসভ্যতা। সাম্প্রতিক সময়ে ডলফিন, তিমি, শুশুকসহ বৃহৎ আকৃতির সামুদ্রিক প্রাণীকে উপকূলের কাছাকাছি আসতে দেখা যায় এবং এসব প্রাণী অতিমাত্রায় প্লাস্টিক-দূষণের শিকার হচ্ছে। একইভাবে ভয়াবহ দূষণে রোগাক্রান্ত ও আহত অবস্থায় মরছে বিপুলসংখ্যক সামুদ্রিক জীব।
বাংলাদেশের উপকূলীয় দূষনের একটি উদ্ভূত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে বিভিন্ন জলজ ব্যবস্থায় প্লাস্টিক দূষণ। দেশের গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য সমস্যাকে বোঝার ও তা সমাধান করার জন্য আমাদের জ্ঞান ও চর্চা এখনো অনেকটা সীমিত। বলতে দ্বিধা নেই যে, আমাদের জাতীয় বোধগম্যতা এবং সক্ষমতা এ ক্ষেত্রে একটি বড় ধরণের সংযোগ বিচ্ছিন্নতা চিহ্নিত করে। বাংলাদেশের সুস্বাদু পানি এবং সামুদ্রিক পরিবেশে প্লাস্টিক দূষণের উপর এখানে সমস্ত উপলব্ধ পর্যালোচনা করার সুযোগ খুবই সীমিত।
বাংলাদেশের উপকূলীয় ও সামুদ্রিক পরিবেশের উদ্ভিদ, প্রাণীজগত, হাইড্রোকার্বন, খনিজ দিয়ে সমৃদ্ধ করছে এর আমানত এবং বাণিজ্যিকভাবে শোষণ যোগ্য ভাল স্টক মাছ এবং সামুদ্রিক খাবারের উপর. বাংলাদেশে, সামুদ্রিক দূষণকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে, একটি ভূমি ভিত্তিক এবং অন্যটি সমুদ্র ভিত্তিক। সমুদ্র দূষণের কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে মিউনিসিপ্যাল বর্জ্য, শিল্প বর্জ্য, জাহাজ ভাঙ্গা কার্যক্রম এবং কৃষি বর্জ্য। পানির বৃহৎ আধার সমুদ্রকে বলা হয় ‘পৃথিবীর রক্তপ্রবাহ’। এ মহাসমুদ্রগুলোকে মহাভাগাড়ে পরিণত করার সম্পূর্ণ দায়ও আমাদের। অক্সিজেনের ৩০ শতাংশের জোগান আসে সমুদ্র থেকে, অথচ এই অক্সিজেন-ভান্ডারকে আমরা প্রতিনিয়ত বিনষ্ট করে চলছি। গবেষণার তথ্য হচ্ছে, বছরে ২৫০ মিলিয়ন টন বর্জ্য নিক্ষিপ্ত হচ্ছে সমুদ্রে। এই বিপুল পরিমাণ বর্জ্যে ভয়াবহ দূষণের কবলে পড়ে সমুদ্র বিপন্ন হচ্ছে। এ কারণে পানি ও প্রাকৃতিক পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতির পাশাপাশি বহু সামুদ্রিক প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটছে। হুমকির মুখে পতিত হচ্ছে ‘সুনীল অর্থনীতি’।
বাংলাদেশে সমুদ্র দূষণের কারণগুলোর মধ্যে টেক্সটাইল এবং ডাইং শিল্প বার্ষিক ১২.৭ থেকে ১৩.৫ মিলিয়ন বর্জ্য জল নিঃসরণ করে এবং ২০ শতাংশ মিষ্টি জলকে দূষিত করে। শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড গুলো এক বছরে প্রায় ২২.৫ টন পলি ক্লোরিনযুক্ত বাইফিনাইল ডাম্প করে। সামুদ্রিক তেল দূষণের ৫০ শতাংশ এরও বেশি শহুরে কার্যকলাপ থেকে আসে।
প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে, অব্যবস্থাপিত প্লাস্টিক বর্জ্যের মাত্রার নিরিখে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের অবস্থান দশমে। বাংলাদেশে প্লাস্টিক দূষণের উপর আলোচনা, পর্যালোচনা ও অধ্যয়ন খুবই সীমিত এবং সামগ্রিক পর্যবেক্ষণ প্রতি তা তির্যক। ২০০৬ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে ২৪টির মতো গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। ৯টির প্রতিবেদনে সামুদ্রিক পরিবেশে প্লাস্টিক দূষণের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে, এছাড়াও ৮টি প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে এবং শুধুমাত্র একটি সুস্বাদু পানির পরিবেশের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে।
বাংলাদেশে প্লাস্টিক দূষণ মোকাবেলার লক্ষ্যে জাতীয় কোন কার্যকর ব্যবস্থাপনা কৌশল প্রণয়ন হয়নি। এ নিয়ে গবেষণার ও অভাব রয়েছে, নদীর প্লাস্টিক পরিবহন নিরীক্ষণ ও মডেল এবং জলজ জীবের জন্য প্রভাব পরীক্ষা করায় আরও কাজের প্রয়োজন রয়েছে।
বাংলাদেশের দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ জানিয়েছে বাংলাদেশের প্রধান নদীগুলো বিলিয়ন বিলিয়ন টন আবর্জনা এবং বে অব বেঙ্গল মধ্যে পলি পাঠায় বর্তমানে, এলএমপি সবচেয়ে বেশি সামুদ্রিক দূষণের একটি সাধারণ রূপ যার জন্য দায়ী ৭৫ শতাংশ বা তারও বেশি, আরেকটি অনুমান পরিসংখ্যান দেয় বিশ্বব্যাপী তথ্যের ভিত্তিতে ৫০ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। সাধারণত, সমুদ্র জলে উপকূলীয় জল প্রবাহিত হয়ে প্রবেশ করে ভূমি, ড্রেন, নদী, চ্যানেল এবং অন্যান্য প্রবাহ থেকে যা সামুদ্রিক দূষণের প্রায় ৪৪ শতাংশ এছাড়াও বিশ্বব্যাপী সামুদ্রিক দূষণের ৩৩ শতাংশ জন্য দায়ী করা হয় জাহাজ চলাচলকে।
বাংলাদেশে এলএমপির প্রভাব রয়েছে বর্জ্য পরিশোধন সুবিধার অভাবসহ নগরায়ণ, শিল্পায়ন, কৃষি, পলি ইত্যাদি সামুদ্রিক এবং উপকূলীয় সম্পদের অবনতি ঘটায়, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে আন্ডারলাইন করে সমুদ্র ইকোনমিতে পৌঁছতে প্রচন্ড বাধা দেয়।
বাংলাদেশে কিছু আইন ও প্রবিধান রয়েছে যা সমুদ্র সুরক্ষার জন্য বিশ্বব্যাপী চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংশোধন করতে হবে। আমাদের লক্ষ্য হলো পরিবেশ এবং বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষনে জাতীয় জনমত গঠন করা ও আইনি শাসনের পাশাপাশি দেশীয় স্টেকহোল্ডারদের হাতে হাত রেখে এগিয়ে যাওয়া ভূমিভিত্তিক থেকে সামুদ্রিক পরিবেশকে রক্ষা, বাংলাদেশের সমুদ্র ও উপকূলকে দূষণমুক্ত করা, বাংলাদেশের মানব স্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্যের জন্য প্রধান হুমকিকে মোকাবেলা করা।
লেখক : ডেপুটি চিফ রিপোর্টার, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)।
ঢাকাওয়াচ/স