
দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার পর অবশেষে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার খালাস সংক্রান্ত আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছে সুপ্রিম কোর্ট।
মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) রাতে ৫৯ পৃষ্ঠার এ রায়ের অনুলিপি আদালতের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। এর মাধ্যমে ১০ বছরের কারাদণ্ড থেকে খালাসের সিদ্ধান্তের বিস্তারিত ব্যাখ্যা আনুষ্ঠানিকভাবে জনসমক্ষে এল।
এর আগে চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ মামলার অন্যান্য আসামিকে খালাস দেন।
রায়ে আদালত উল্লেখ করেন, “এই (মামলার) আপিলগুলোর বিষয়বস্তু গঠনকারী কার্যধারাগুলো উদ্দেশ্যমূলকভাবে গঠন করায় তা আইনের স্পষ্ট অপব্যবহার বলে প্রতীয়মান হয়েছে, যা দুরভিসন্ধিমূলক মামলার সমতুল্য।” আদালত আরও বলেন, “এই রায় অন্যান্য দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে, যারা এ মামলায় আপিল করেননি।”
এই রায়ের ফলে বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টের পূর্ববর্তী রায় বাতিল হয়, ফলে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ অন্যান্য আসামি আপিল না করেও সাজা থেকে অব্যাহতি পান।
খালেদা জিয়াসহ তিনজনের করা আপিল মঞ্জুর করে ১৫ জানুয়ারি এ রায় দেন আদালত। আপিলের শুনানিতে অংশ নেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, বদরুদ্দোজা বাদল, রুহুল কুদ্দুস কাজল, কায়সার কামাল, জাকির হোসেন ভূইয়া ও মাকসুদ উল্লাহ। কাজী সালিমুল হক কামালের পক্ষে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী এস এম শাহজাহান। রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল আরশাদুর রউফ ও অনীক আর হক এবং দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আসিফ হাসান।
রায় ঘোষণার পর জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, “যে মামলায় কিছুই ছিল না, সে মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ সাজা পাঁচ বছর থেকে ১০ বছর করে, এটি খুবই দুঃখজনক... আজ মনে হয়েছে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করেছে।”
দুদকের আইনজীবী আসিফ হাসান জানান, মোট চারটি আপিল আদালত মঞ্জুর করেছে। তিনি বলেন, “যেহেতু আদালত মামলাটিকে ম্যালিসিয়াস প্রসিকিউশন বলেছেন, তাই যারা আপিল করেননি তারাও খালাস পেয়েছেন।” এদের মধ্যে রয়েছেন তারেক রহমান ও কামাল সিদ্দিকী।
খালেদা জিয়ার আপিলের শুনানি শুরু হয়েছিল গত ৭ জানুয়ারি এবং চার দিনের শুনানি শেষে ১৫ জানুয়ারি রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ করা হয়।
এই মামলার সূচনা ২০০৮ সালের ৩ জুলাই, যখন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অভিযোগ আনে যে এতিমদের সহায়তার জন্য বিদেশ থেকে পাঠানো ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিশেষ জজ আদালত-৫ রায়ে খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করেন। একই সঙ্গে তারেক রহমান, সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল, সাবেক মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ ও মমিনুর রহমানকে ১০ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে হাইকোর্টে আপিল করলে আদালত একই বছরের ৩০ অক্টোবর খালেদা জিয়ার সাজা পাঁচ বছর থেকে বাড়িয়ে ১০ বছর করেন এবং অন্য দুই আসামির আপিল খারিজ করেন।
২০১৯ সালের ১৪ মার্চ খালেদা জিয়া এ রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করেন। ২০২৪ সালের ১১ নভেম্বর আপিল বিভাগ তার আবেদন মঞ্জুর করে সাজার কার্যকারিতা স্থগিত রাখেন। পরে তিনি পৃথক আপিল দাখিল করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে আপিল বিভাগের রায়ে মামলাটি বাতিল হয়ে যায় এবং সর্বোচ্চ আদালতের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ সংশ্লিষ্ট সবাই খালাস পান।
এই রায়ের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার আইনি অধ্যায়ের অবসান ঘটল।