
আওয়ামী লীগ থেকে অন্য দলগুলো কি শিক্ষা গ্রহণ করবে?
মো. মনিরুজ্জামান মনির: যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকেন, তাদের মধ্যে একটা অহমিকা অটোমেটিক্যালি তৈরি হয়ে যায়। তখন তারা আর জনগণের ভাষা বুঝতে পারেন না কিংবা বুঝতে চান না। তারা ব্যক্তি স্বার্থে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তারা অনেক কিছুই জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। ফলে জনগণের সঙ্গে তাদের দূরত্ব তৈরি হয়। এই দূরত্ব বাড়তে বাড়তে একটা সময় তারা সরকারের ওপর বিরক্ত হয়ে যান; ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। বিভিন্ন দাবি নিয়ে মাঠে নামেন। এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আন্দোলন বৃহৎ আন্দোলনে রূপ নেয়। সরকারবিরোধী গোষ্ঠী ও দেশপ্রেমিক জনগণও এই আন্দোলনে যোগ দেন। একটা সময় সরকারের পতন হয়। এটাই গণতান্ত্রিক দেশের স্বাভাবিক চরিত্র। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম না। এ দেশে আন্দোলন সংগ্রামে রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি তরুণ ও ছাত্রসমাজই সব চেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে, রাখছে, রাখবে। তারাই জনগণকে বারবার জাগিয়ে তুলেছে। পুলিশের বন্দুকের সামনে তারাই বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে বারবার। ’৫২, ৬৯ ও ৭১’-এর পর ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতন ঘটিয়েছিল মূলত ছাত্রসমাজ। দীর্ঘ সময় পর ২০২৪ সালে আরেকটি অভ্যুত্থান দেখল বাংলাদেশ। আন্দোলনের তীব্রতার মুখে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হলেন টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা।আওয়ামী লীগের মতো একটা বড় ও প্রাচীন দলের প্রধানকে যখন দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়; তখন তার ও দলের ভুল নিয়ে চলে নানা বিশ্লেষণ। এটাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। অন্য রাজনৈতিক দলগুলো এটা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করতে পারে তাদের ভবিষ্যত শিক্ষা-দীক্ষার জন্য। তারা যেন এই ভুলগুলো এড়িয়ে চলতে পারেন। শেখ হাসিনার সব চেয়ে বড় ভুল হলো পরিবারতন্ত্র। বিভিন্ন পদে তিনি আত্মীয়-স্বজনকে বসিয়েছেন। দলের দুঃসময়ে তারা তেমন ভূমিকা রাখতে পারেননি। এই পরিবারতন্ত্রের কারণে ক্ষতি হয়েছে দলের। ত্যাগী-নেতাকর্মীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। তাদের অনেককে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। অনেকে রাজনীতির মাঠ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। উদাহরণটা শুরু করতে চাই কুমিল্লা থেকে। এই নগরের আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এমপি ছিলেন আ ক ম বাহারউদ্দিন। কুমিল্লা সিটির উপনির্বাচনে তার মেয়ে তাহসিনা সূচনা বাহার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান এবং ভোটে জিতেও যান। খুলনার মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন তালুকদার আব্দুল খালেক। এর আগে তিনি বাগেরহাটের এমপি, প্রতিমন্ত্রী এবং এরও আগে খুলনা সিটির মেয়র ছিলেন। একাদশ সংসদে তার স্ত্রী হাবিবুন নাহার বাগেরহাট-৩ আসনে এমপি নির্বাচিত হন। পরে তিনি বন, পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হন।ঢাকা দক্ষিণ সিটির অন্যতম জনপ্রিয় মেয়র ছিলেন সাঈদ খোকন। তার বাবা মোহাম্মদ হানিফও অত্যন্ত জনপ্রিয় মেয়র ছিলেন। এই সাঈদ খোকনকে বাদ দিয়ে রাজনীতিতে হঠাৎ আবির্ভাব হওয়া ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসকে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। এর আগে তিনি আওয়ামী লীগের টিকিয়ে এমপি নির্বাচিত হন। তিনি শেখ হাসিনার ফুপাতো ভাই শেখ মনির ছেলে। তাপসের আরেক ভাই শেখ ফজলে শামস পরশকে সপ্তম কংগ্রেসে যুবলীগের চেয়ারম্যান করা হয়। এখানে লক্ষণীয় যে তাপস ও পরশ রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। কেবল শেখ পরিবারের সদস্য হওয়ায় ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করে তাদের চেয়ারে বসানো হয়েছে। গত সংসদে ঢাকায় যারা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন; তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন বাহাউদ্দিন নাছিম। মাদারীপুরের এই ভদ্রলোককে ঢাকায় কেন মনোনয়ন দিতে হলো? ঢাকার স্থানীয় এমন কোনও নেতা নেই; যাকে মনোনয়ন দেওয়া যায়? স্থানীয়দের মনোনয়ন না দেওয়ায় হয়তো শেখ হাসিনার ভয়ে কেউ মুখ খোলেননি; কিন্তু নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ছিল, তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। বেশ কয়েক বছর অবিভক্ত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। ঢাকায় এতো নেতাকর্মী থাকতে চাঁদপুরের এই লোককে কেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের দায়িত্ব দিতে হলো? ঢাকার পাশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জেলা হলো নারায়ণঞ্জ। নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি এবং পরে মন্ত্রী হন গোলাম দস্তগীর গাজী। তার স্ত্রী হাসিনা গাজী তারাব পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের টিকিটে। ফরিদপুর-৩ (সদর) আসনে টানা তিন বার এমপি এবং পরে মন্ত্রী হন ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তার আপন ছোট ভাই এহতেশাম বাবর ফরিদপুর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের টিকিটে। সারাদেশে একই অবস্থা ছিল। বাবা এমপি, ছেলে উপজেলার চেয়ারম্যান কিংবা পৌর মেয়র। স্বামী এমপি আবার স্ত্রী মেয়র কিংবা উপজেলা চেয়ারম্যান। কখনো কখনো এই দায়িত্বে বসানো হয়েছে এমপি-মন্ত্রীর নিকট আত্মীয়কে। এ কারণে টানা সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগে কিছু সুবিধাভোগী তৈরি হয়েছে। নতুন নেতা কিংবা ত্যাগী কর্মী তৈরি হয়নি। ফলে রাজপথে লড়াই করার মতো নেতাকর্মী দলটিতে ছিল না। এছাড়া অনেক নেতার নির্যাতনে অনেক নেতাকর্মীও গোপনে দলের বিরোধিতা করেছেন। বিতর্কিত বক্তব্য: গত ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কোটা বিষয়ে আমার কিছু করার নেই। মামলার পর আদালত যে রায় দেন, এতে নির্বাহী বিভাগের কিছু করার নেই। আদালতেই সমাধান হবে। সাংবাদিকের এক প্রশ্নে তিনি তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, মুক্তিযোদ্ধার নাতি-পুতিরা (কোটা) পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে? তার এই বিতর্কিত বক্তব্য শুধু তার জন্য নয়, দেশ ও জাতির জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পরই ১৪ জুলাই রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের স্লোগান ওঠে, ‘আমি কে? তুমি কে? রাজাকার রাজাকার’। পরে তা বদলে হয় ‘চেয়েছিলাম অধিকার/ হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘আমি কে? তুমি কে? রাজাকার, রাজাকার/ কে বলেছে? কে বলেছে? সরকার, সরকার’। ক্ষেত্রবিশেষে সরকারের বদলে ‘স্বৈরাচার’ শব্দটিও শোনা গেছে। এরপর এই আন্দোলন আর দমানো যায়নি। সরকারি-বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা রাজধানীর সব সড়ক অবরোধ করে প্রতিদিনই আন্দোলন করেন। আন্দোলন পরবর্তীতে এমনভাবে বৃদ্ধি পায় যা আর কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। এর আগে গত ৪ জুলাই কোটা ইস্যুতে আদালত যখন শুনানি আরও এক মাস পেছান তখন ছাত্রদের আন্দোলন আরও তীব্রতর হতে থাকে। অবশেষে ৬ জুলাই কোটাবিরোধীরা সারা দেশে ‘বাংলা বন্ধের’ ডাক দেন। সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ, পরীক্ষা বর্জন ও সাধারণ ছাত্র ধর্মঘটের আহ্বান জানান। গত ১১ জুলাই ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, কোটাবিরোধীরা সর্বোচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে যে শক্তি প্রদর্শন করছেন, তা বেআইনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, শিক্ষার্থীরা লিমিট ক্রস করে যাচ্ছেন। সারা দেশব্যাপী জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে কোটা আন্দোলন করতে দেওয়া প্রশাসনিক দুর্বলতা কি-না এমন প্রশ্নে ওবায়দুল কাদের বলেন, এটা প্রশাসনিক দুর্বলতা নয়, আমরা ধৈর্য ধরছি। ধৈর্য ধরা মানে দুর্বলতা নয়। সময়মতো যথাযথ অ্যাকশন নেওয়া হবে। আরেক প্রশ্নে তিনি বলেন, ছাত্র আন্দোলনের কতিপয় নেতা যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটার জবাব ছাত্রলীগই দেবে। ছাত্রদের বিষয় ক্যাম্পাস পর্যন্ত সীমিত থাকবে। আমরা দেখি রাজনৈতিকভাবে কারা প্রকাশ্যে আসে, তখন দেখা যাবে। আমরাও মোকাবিলা করতে প্রস্তুত। ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের পরই ১৬ জুলাই সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলায় তিন শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। এরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের সামনে প্রথমে দুই পক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। পরে দফায় দফায় ক্যাম্পাসজুড়ে সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ইটপাটকেল ছোড়ার ঘটনা ঘটে। পরে ছাত্রলীগ নেতাকর্মী একজোট হয়ে ফের আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। একপর্যায়ে ধারালো অস্ত্র, রড ও লাঠিসোঁটা হাতে থাকা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর দখলে চলে যায় ক্যাম্পাস। সংঘর্ষের সময় কয়েকজন যুবককে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে দেখা গেছে। সন্ধ্যায় বহিরাগতদের ক্যাম্পাস থেকে বের করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সেখানে পুলিশ প্রবেশ করে। পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার পর মধ্যরাতে ক্যাম্পাস ত্যাগ করে পুলিশ। এভাবে আন্দোলন তীব্র হতে থাকে। এক পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী অ্যাকশনে যায়। তাদের গুলিতে দেড় হাজারের মতো মানুষ নিহত হন। আহত হন আরও অনেক মানুষ। তাদের সিংহভাই ছাত্র-তরুণ। এক পর্যায়ে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে চলে যান বলে খবর আসে। এরপর সারাদেশে তাণ্ডব চালানো হয়। থানায় থানায় আক্রমণ করা হয়। অনেক পুলিশ সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী এবং তাদের সম্পদ হামলার শিকার হয়েছে। আওয়ামী লীগের এই পরিবারতন্ত্র, ত্যাগী নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন এবং অহমিকায় পতন থেকে অন্যান্য দলগুলো শিক্ষা গ্রহণ করবে- এটাই প্রত্যাশা করছি।

আন্তর্জাতিক বন দিবস ২০২৫: ‘বন বনানী সংরক্ষণ, খাদ্যের জন্য প্রয়োজন’
দীপংকর বর: পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে এ ধরণীকে বাসযোগ্য রাখতে বনের গুরুত্ব অপরিসীম। বায়ুর গুণগতমান রক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রাকৃতিক পরিবেশের বিরূপ প্রভাব রোধ, ভূমিক্ষয় ও মরুময়তা রোধ, কার্বন সংরক্ষণ এবং কার্বন নিঃসরণ রোধসহ প্রাণীকুলের বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদা পূরণে বন অনাদিকাল থেকে অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে। তাছাড়া, বনভিত্তিক জীবিকা বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু বন উজাড় ও অপ্রতুল সংরক্ষণ কার্যক্রমের ফলে অনেক দেশেই বনজ সম্পদ হুমকির মুখে পড়ছে, যা খাদ্য নিরাপত্তাসহ সামগ্রিক পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। সভ্যতার ক্রমবিকাশের ফলে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রভৃতির কারণে প্রতিনিয়তই বনভূমির পরিমাণ কমছে। বিকাশমান কৃষি ও আবাসনের জন্য ভূমি ব্যবহার পরিবর্তনের কারণে সংকুচিত হচ্ছে বনাঞ্চল। শুধু তাই নয়, নদী, খাল, জলাভূমি, জলাশয় ইত্যাদি জবরদখল ও ভরাটের কারণে প্রতিবেশের যে বিপর্যয়ের ঘটছে তা নিয়ন্ত্রণে আনা প্রয়োজন। তাই প্রতিবেশ, বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় বন আইন, বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনসহ এ সংক্রান্ত সকল আইন ও বিধিমালার সঠিক প্রয়োগ ও যথাযথ অনুসরণ নিশ্চিত করতে হবে। বন সংরক্ষণ, পুনরুদ্ধার এবং টেকসই বন ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২০১২ সালে ২১ মার্চকে আন্তর্জাতিক বন দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। বনজসম্পদের গুরুত্ব তুলে ধরতে এবং নীতিনির্ধারক, গবেষক ও সাধারণ মানুষকে বনায়নের গুরুত্ব সম্পর্কে উদ্বুদ্ধ করতে ২০১৩ সাল হতে প্রতি বছর বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নির্দিষ্ট একটি প্রতিপাদ্যকে কেন্দ্র করে এ দিবস পালন করা হয়। এবারেও বন অধিদপ্তরে আন্তর্জাতিক বন দিবস উদযাপন করা হবে । ২০২৫ সালের আন্তর্জাতিক বন দিবসের প্রতিপাদ্য ‘বন বনানী সংরক্ষণ, খাদ্যের জন্য প্রয়োজন’। এই প্রতিপাদ্য বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক। বন আমাদের খাদ্য উৎপাদন ও পুষ্টি নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। বিশ্বের বহু জনগোষ্ঠীর খাদ্য তালিকায় বন থেকে প্রাপ্ত ফলমূল, বাদাম, মধু, ভেষজ উদ্ভিদ, মাশরুম ও শাকসবজি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। সুতরাং, বন কেবল তাদের পুষ্টির উৎস নয়, বরং জীবনধারা ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এছাড়া, অনেক ঔষধি উদ্ভিদ পুষ্টি ও ভেষজ চিকিৎসার জন্যও ব্যবহৃত হয়। বন থেকে পাওয়া সকল খাদ্য উপাদান মানুষকে পুষ্টি জোগানোর পাশাপাশি স্থানীয় জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতেও ভূমিকা রাখে। বন উজাড় হলে খাদ্য উৎপাদনও হুমকির মুখে পড়ে। সঠিকভাবে বন সংরক্ষণ করলে তা দীর্ঘমেয়াদে খাদ্য উৎপাদনশীলতা বজায় রাখতে এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে সহায়তা করে। বন থেকে সংগৃহীত মশলা, তেল, রজন এবং ঔষধি গাছ খাদ্য ও ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। বনজ পণ্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব, যা অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। তাই বনজসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হলে খাদ্যশিল্পের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হবে। খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ টেকসই করতে হলে বন সংরক্ষণ ও পুনঃবনায়নের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ মোট আয়তনের ১৫ দশমিক ৫৮ ভাগ এবং বৃক্ষাচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ ২২ দশমিক ৩৭ শতাংশ; যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। দেশের প্রধান বনাঞ্চলগুলোর মধ্যে সুন্দরবন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বন, মধুপুর গড় ও শালবন উল্লেখযোগ্য। বনভূমির উপর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ, নগরায়ণ, শিল্পায়ন, কৃষি সম্প্রসারণ, অনিয়ন্ত্রিত বন নিধন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বনসম্পদ হ্রাস পাচ্ছে। বিশেষ করে, অবৈধ কাঠ কাটার প্রবণতা, চারাগাছের অপর্যাপ্ত রোপণ, বনাঞ্চলের ওপর অনুপ্রবেশ এবং বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংসের ফলে জীববৈচিত্র্যও মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় দেশের বনজ সম্পদ সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের জন্য বিভিন্ন নীতি ও প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে বন সৃজনের মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণের পাশাপাশি দারিদ্র্য নিরসনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বন সংরক্ষণ আইন দেশের বনাঞ্চল ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে আইনি কাঠামো প্রদান করছে। এ ছাড়া, টেকসই বন ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে গ্রিন ইকোনমি ধারণা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, যেখানে বনজসম্পদ ব্যবহারে পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করা হয়। বন অধিদপ্তরের আওতায় বন ও বৃক্ষাচ্ছাদন বৃদ্ধি, বন পুনরুদ্ধার কার্যক্রম, বন অবক্ষয় রোধ, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নেতিবাচক প্রভাবসহ অন্যান্য সংকট মোকাবিলা, উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী সৃজন এবং বন নির্ভর জনগোষ্ঠীর বনের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন বনভূমিতে ১৪টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩ হাজার ৫৩০ হেক্টর ব্লক বাগান, ৮৬৬ কিলোমিটার স্ট্রিপ বাগান, ৪৬০ হেক্টর ম্যানগ্রোভ বাগান সৃজন এবং বিক্রয় বিতরণের জন্য ১৯ দশমিক ৮০ লক্ষ চারা উত্তোলনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়াও, জবরদখলকৃত মোট বনভূমির উদ্ধারে বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে। ফেব্রুয়ারি/২০২৫ পর্যন্ত ৩৩ হাজার ৮২ একর বনভূমি উদ্ধার করা হয়েছে।বন, বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য জাতীয় বননীতি ২০২৪ অনুমোদন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এছাড়া বন ও বৃক্ষ সংরক্ষণ আইন, ২০২৫ এবং গ্রামীণ বন বিধিমালা, ২০২৫ প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ন্যাশনাল হার্বেরিয়াম এবং আইইউসিএনএর সহায়তায় ১ হাজার টি উদ্ভিদ মূল্যায়নপূর্বক রেড লিস্ট প্রকাশ করা হয়েছে। বন অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের সকল অফিসসমূহে নার্সারিতে ইউক্যালিপটাসের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিবেচনায় আকাশমনি প্রজাতির চারা উত্তোলন ও রোপণ বন্ধ রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বৃক্ষ সংরক্ষণ ও এর বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার জন্য বৃক্ষ হতে পেরেক উত্তোলন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বন সংরক্ষণ ও বন খাত থেকে কার্বন নি:সরণ কমানোর লক্ষ্যে ১ হাজার ৩০৩ একর জবরদখলকৃত বনভূমি উদ্ধারপূর্বক বনায়ন করা হয়েছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার বিশেষ উদ্যোগে বিভিন্ন সরকারি কাজে বরাদ্দকৃত বনের জমি ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে বর্ণিত কার্যক্রমগুলো বন, বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার সোনাদিয়ার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ইকো-ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) অনুকূলে বরাদ্দকৃত ৯ হাজার ৪৬৭ একর জমি বন বিভাগের অনুকূলে হস্তান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে প্রশাসন একাডেমি স্থাপনের জন্য বন্দোবস্তকৃত কক্সবাজার জেলার সদর উপজেলায় ৭০০ (সাতশত) একর এবং মাল্টিডিসিপ্লিন একাডেমির নামে ১৫৬ একর বনভূমির বন্দোবস্ত বাতিল করা হয়। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) ‘টেকনিক্যাল সেন্টার’ নির্মাণের জন্য কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলায় বরাদ্দকৃত ২০ একর সংরক্ষিত বনভূমি অবমুক্তকরণ (ডি-রিজার্ভ) বিষয়ক জারীকৃত প্রজ্ঞাপন বাতিল করা হয়। এছাড়া একই ধরনের আরও কয়েকটি বরাদ্দ বাতিলের কার্যক্রম মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। বন, বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে এবং সে অনুযায়ী বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে- রক্ষিত এলাকার মাস্টারপ্ল্যান ও ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান প্রণয়ন; দেশীয় ও বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ প্রজাতির জীনপুল সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণ; সরকারি জবরদখলকৃত বনভূমি উদ্ধারপূর্বক বনায়ন কার্যক্রম পরিচালনা; বাংলাদেশের বন এবং বন্যপ্রাণী ও তাদের আবাসস্থল সংরক্ষণে জনসাধারণকে সচেতন করার জন্য বিভিন্ন সভা, সেমিনার, ওয়ার্কশপ, কনফারেন্স, দিবস উদযাপন, ওয়াইল্ডলাইফ অলিম্পিয়াড পোস্টার, বিলবোর্ড, লিফলেট, বুকলেট বিতরণসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা।বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। আমাদের যেটুকু বনাঞ্চল আছে সেটার সংরক্ষণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি বনের স্বাস্থ্য ও বৈচিত্র্য উন্নত করতে হবে। বন অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন সামাজিক বনায়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে পতিত ও প্রান্তিক সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন ভূমি বনায়নের আওতায় এসেছে। সামাজিক বনায়ন কার্যক্রম গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন ও সরকারি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য নির্মল পরিবেশ সৃষ্টিতে সামাজিক বনায়ন অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। বনায়ন কার্যক্রমে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের জন্য সবুজ অর্থনীতি যাত্রা ত্বরান্বিত হচ্ছে। বন সংরক্ষণে স্থানীয় জনগণের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বন নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী যেমন বিশেষ নৃগোষ্ঠী, কৃষক ও স্থানীয় বাসিন্দারা বনসম্পদের প্রতিদিনের ব্যবহারকারী। তাই বন সংরক্ষণে তাদের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করতে হবে। সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার স্থানীয় জনগণকে বন রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় অন্তর্ভুক্ত করছে, যেখানে তারা বন সৃজনের পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে। এ ছাড়া, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও পরিবেশবাদী সংগঠন স্থানীয় জনগণের মধ্যে বন সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশে বন সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের জন্য সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে, জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া এই প্রচেষ্টা সফল হবে না। স্থানীয় জনগণ, কৃষক, বননির্ভর সম্প্রদায় এবং নীতিনির্ধারকদের মধ্যে বনের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো দরকার। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, স্কুল-কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম এবং সরকারি-বেসরকারি সংস্থার প্রচারণার মাধ্যমে মানুষকে বোঝাতে হবে যে বন সংরক্ষণ শুধু জীববৈচিত্র্যের জন্য নয়, বরং টেকসই খাদ্য উৎপাদন ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও অপরিহার্য। টেকসই বন ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হলে পরিকল্পিত নীতি প্রণয়ন এবং সেগুলোর বাস্তবায়ন জরুরি। বাংলাদেশে সামাজিক বনায়ন, বন সংরক্ষণ আইন ও বনভিত্তিক জীবিকা উন্নয়নের মতো বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, তবে এগুলোকে আরও কার্যকর করতে হবে। বন উজাড় রোধে কঠোর মনিটরিং, অবৈধ কাঠ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ এবং বনভূমি পুনঃবনায়নের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। একইসঙ্গে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে বন সংরক্ষণে সম্পৃক্ত করা গেলে বন ও খাদ্যের টেকসই সম্পর্ক রক্ষা করা সম্ভব হবে। নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে কৃষি ও বন বিভাগের মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি, বনজ খাদ্যের চাষাবাদকে উৎসাহিত করা এবং বন ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। বন সংরক্ষণ ও খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করতে উন্নত দেশগুলোর প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা দরকার। বন সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় উন্নত দেশগুলোর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশও টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে পারে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত আন্তঃসরকার প্যানেল এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণাকে কাজে লাগিয়ে দেশীয় নীতিমালা প্রণয়ন করলে বন সংরক্ষণ আরও কার্যকর হবে। গবেষণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে বনজ খাদ্য উৎপাদন, রপ্তানি এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবিকা উন্নয়নের পথ সুগম করা সম্ভব হবে। বন সংরক্ষণ ও খাদ্য নিরাপত্তার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে জনসচেতনতা, কার্যকর নীতি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সমন্বিত প্রয়াস প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে সরকার, গবেষক, স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর একসঙ্গে কাজ করা জরুরি। বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান খাদ্য নিরাপত্তার সংকট ও পরিবেশগত পরিবর্তনের মুখে বন সংরক্ষণ ও খাদ্য ব্যবস্থাপনার মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতির প্রয়োজনীয়তা আজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাই উন্নয়ন নীতিমালায় এমন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে, যেখানে বন সংরক্ষণ ও খাদ্য নিরাপত্তা পরস্পরের সম্পূরক হিসেবে বিবেচিত হবে। বাংলাদেশে সামাজিক বনায়ন, বনজসম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং টেকসই কৃষি চর্চার মাধ্যমে এই ভারসাম্য রক্ষার উদ্যোগ ইতোমধ্যে নেওয়া হয়েছে, তবে তা আরও কার্যকর করতে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন। এ দেশকে বর্তমান জনগোষ্টী ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য টেকসই পরিবেশ উন্নয়নকল্পে বিজ্ঞানভিত্তিক ও লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বন সংরক্ষণ, উন্নয়ন, বনজদ্রব্যের টেকসই উৎপাদন এবং এর সুচিন্তিত ও টেকসই ব্যবহার একান্ত প্রয়োজন। এ লক্ষ্য অর্জনে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা, স্থানীয় জনগোষ্ঠী, কৃষক, গবেষক এবং সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অত্যন্ত জরুরি। বন উজাড় বন্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলা, বনের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন এবং গবেষণা ও প্রযুক্তির সহায়তায় বনসম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। আন্তর্জাতিক বন দিবস ২০২৫ আমাদের এই বাস্তবতা উপলব্ধি করার সুযোগ এনে দিয়েছে, যেখানে সবাই মিলে একটি সুস্থ, সবুজ ও খাদ্যনিরাপদ পৃথিবী গড়ার জন্য অবদান রাখতে পারে। এখন সময় এসেছে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একসঙ্গে কাজ করার, যাতে বন আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। লেখক: উপপ্রধান তথ্য অফিসার, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়

৩ কোটি ৮০ লাখের অধিক কিডনি রোগীর দাবি ও প্রত্যাশা
মো. আবদুল আলী: কিডনি সুরক্ষা ও রোগ প্রতিকারের একমাত্র উপায়- জনসচেতনতা এবং “অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় অকাল মৃত্যু নয়” হোক আমাদের প্রত্যয়। আজ ১৩ মার্চ (বৃহস্পতিবার) কিডনি দিবস-২০২৫ পালিত হচ্ছে। এই বছরের প্রতিপাদ্য হল “আপনার কিডনি কি সুস্থ? তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করুন, কিডনির স্বাস্থ্য রক্ষা করুন”। গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে, ১৮ কোটি জনসংখ্যার এই বাংলাদেশে ৩ কোটি ৮০ লাখের অধিক মানুষ কোনো-না-কোনোভাবে কিডনি রোগে আক্রান্ত। মরণব্যাধি কিডনি রোগের দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। প্রতি বছর অগণিত মানুষ অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করছে। প্রিয়জনকে বাঁচাতে মৃত্যুর দিনক্ষণ পর্যন্ত চিকিৎসার পেছনে ছুটতে বাধ্য থাকে ভুক্তভোগী পরিবার। প্রবাদ আছে “কিডনি রোগী মরেও যায়, মেরেও যায়”। বাস্তবে আমৃত্যু চিকিৎসার ভার সয়বার সাধ্য ধনী, মধ্যবিত্ত বা হতদরিদ্র কারো নেই। এমন বাস্তবতায় আমাদের অদম্য প্রত্যয় “মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি”। কিডনি রোগের দুষ্প্রাপ্য, ব্যয়বহুল চিকিৎসায় ভুক্তভোগী এবং নির্মম বাস্তবতার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে অর্থাভাবে চিকিৎসাবঞ্চিত হতদরিদ্র কিডনি-রোগী ও ভুক্তভোগী পরিবারের বুকফাটা বোবাকান্না ও নির্মম কষ্টের আওয়াজ সরকার, সামর্থ্যবান ও মানবিক সমাজে ছড়িয়ে দিয়ে সর্বজনীন সহযোগিতা ও উদ্যোগের মাধ্যমে জীবন রক্ষার প্রয়োজন। ৬৮ হাজার গ্রামবাংলার অগণিত হতদরিদ্র কিডনি রোগী চিকিৎসা বঞ্চিত হয়ে অকাল মৃত্যুবরণ করছে। অপর দিকে সীমিত সাধ্যের গুটিকয়েক কিডনি রোগীর ডায়ালাইসিস অর্থাভাবে মাঝপথে বন্ধের কারণে ব্যাপক হারে কিডনি রোগীর মৃত্যু আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। কোনো একক ব্যক্তি বা পরিবারের পক্ষে কিডনি রোগের ব্যয়বহুল চিকিৎসা সামাল দেয়া সম্ভব নয়। ক্রমবর্ধমান কিডনি রোগী ও মৃত্যুর হার কমাতে প্রয়োজন রাষ্ট্রের যথোপযুক্ত পদক্ষেপ ও মানবিক সমাজের সহযোগিতা। বিশ্ব কিডনি দিবস-২০২৫ উপলক্ষ্যে দেশের ৩ কোটি ৮০ লাখের অধিক কিডনি রোগীর দাবি ও প্রত্যাশা পূরণে চিকিৎসক, হাসপাতাল, ক্লিনিক, ল্যাব, ব্লাড ও অক্সিজেন ব্যবস্থাপনা, অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, ন্যায্যমূল্যে ডায়ালাইসিস, ঔষধসহ সমন্বিত প্রচেষ্টায় কিডনি-রোগীদের চিকিৎসার সু-ব্যবস্থা মূল উদ্দেশ্য। লক্ষ্য অর্জনে স্বাস্থ্যবিষয়ক দপ্তর, এনজিও, মানবিক সংগঠন, ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান ও দেশ-বিদেশের সহযোগিতায় রোগীদের বিড়ম্বনামুক্ত সাশ্রয়ী মূল্যে, বিনা মূল্যে চিকিৎসার সু-ব্যবস্থার মাধ্যমে জীবন রক্ষার এক অদম্য প্রত্যয় নিয়ে কাজ করে আসছে চট্টগ্রামে “কিডনি রোগী কল্যাণ সংস্থা”। মূলত জীবন রক্ষার জন্য প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ ও মানবিক সহযোগিতা। কিডনি সুরক্ষা ও রোগ প্রতিরোধের একমাত্র উপায় জনসচেতনতা: এ উপলক্ষ্যে ডায়াবেটিকস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি, ক্যান্সার, থেলাসেমিয়া, স্ট্রোক, স্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, জরায়ু ও স্তন ক্যান্সার, পাইলস, গ্যাস্ট্রিক, লিভার ডিজিজ, হৃদরোগ, প্যারেলাইজডসহ মাতৃত্বের গর্ভ ও প্রসবকালীন সচেতনতা ইত্যাদি ক্রমবর্ধমান রোগসমূহের প্রতিকারমূলক প্রাথমিক ধারণা (প্রযোজ্য শ্রেণির) পাঠ্যপুস্তকে অন্তভর্‚ক্ত করা হলে অনায়াসে ১৮ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশে জনসচেতনতা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচার সকল রোগের উৎপত্তির মূল উৎস। এসব জনগুরুত্বপূর্ণ ও জনস্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্যাবলি প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, অনলাইন মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনসাধারণের অসচেতনতা, অসাবধানতা, রোগের লক্ষণ সম্পর্কে ধারণার অভাব, রোগ প্রতিকারক ও আক্রান্ত রোগীর করণীয় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসাবিজ্ঞানের যাবতীয় তথ্যাবলি সম্প্রচারে পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ। বিদ্যমান ক্লিনিক ও হাসপাতালসমূহে স্বল্পমূল্যে মানসম্মত ডায়ালাইসিস সেন্টার চালু: পরিসংখ্যানমতে, দেশের ১৮ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ২ কোটিরও অধিক মানুষ কোনো না কোনোভাবে কিডনি রোগে আক্রান্ত। তার উপর প্রতিবছর ৪০ হাজারেরও অধিক মানুষ য্ক্তু হচ্ছে কিডনি বিকলের তালিকায়, যা খুবই উদ্বেগজনক। এই বিশাল সংখ্যক কিডনি-রোগীর তুলনায় চিকিৎসা-সুবিধা, চিকিৎসক, স্বাস্থ্য কর্মী, চিকিৎসা উপকরণ ও মেশিনারীজ সল্পতা-সংকট রোগীর চিকিৎসা প্রাপ্তির পথে মূল প্রতিবন্ধকতা। বিশেষ করে চুড়ান্ত পর্যায়ের রোগীদের জীবন রক্ষার অন্যতম অবলম্বন মানসম্মত ডায়ালাইসিস সেন্টার অপ্রতুল। তাই দরিদ্র ও হতদরিদ্র রোগীদের সামর্থ্যের মধ্যে বিদ্যমান হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহে মানসম্মত ডায়ালাইসিস সেন্টার স্থাপন সময়ের দাবি। অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় অকাল মৃত্যু নয়: প্রবাদ আছে ‘কিডনি রোগী মরেও যায় মেরেও যায়’। অসম্ভব ব্যয়বহুল এ-রোগের চিকিৎসা মৃত্যুর দিনক্ষণ পর্যন্ত। এমন বাস্তবতায় ডাক্তার ভিজিট, টেস্ট রিপোর্ট ফি, রিপোর্র্ট পর্যবেক্ষণ ফি, ফেষ্টুলা স্থাপন, ডায়ালাইসিস, কিডনি প্রতিস্থাপন ব্যয় ও ওষুধের উচ্চমূল্যসহ কিডনি চিকিৎসায় সর্বক্ষেত্রে ব্যয়হ্রাসে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ। এ লক্ষ্যে জীবনরক্ষাকারী ডায়ালাইসিস মেশিন, ডাইলেজার ও ডায়ালাইসিস উপকরণসহ যাবতীয় ওষুধ, যন্ত্রপাতি ও মেশিনারীজ সরঞ্জাম দেশি বিদেশি অংশীদারীত্বে দেশে উৎপাদন এবং জীবনরক্ষাকারী ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতির উপর যাবতীয় আমদানি শুল্ক মওকুফ করে চিকিৎসাব্যয় কমানোর উদ্যোগ গ্রহণ। জনবহুল এলাকায় শৌচাগার স্থাপন: প্রস্রাবের চাপ দীর্ঘমেয়াদি চেপে রাখা-অভ্যাসে পরিণত হলে কিডনি তার কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। একজন পুরুষ যতটা সহজে শোভন কিংবা অশোভনভাবে পয়-প্রস্রাব ত্যাগের সুযোগ নেয়, একজন মহিলার পক্ষে তা কখনো সম্ভব নয়। ফলে মহিলা কিডনি রোগীর সংখ্যা দিন দিন উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। উল্লেখ্য যে, শৌচাগার একদিকে মানবসেবা অপরদিকে লাভজনক ব্যবসাও বটে। সে বিবেচনায় উপজেলা থেকে শুরু করে জেলাশহর পর্যন্ত প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক জনবহুল এলাকায় সরকারি, স্থানীয় সরকার, এনজিও, মানবিক, সামাজিক উদ্যোগে স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার নির্মাণ কিডনিসহ নানাবিধ রোগ প্রতিকারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। এছাড়াও সব ধরনের ঔষুধের প্যাকেট ও পাতার গায়ে ওষুধের দাম মুদ্রণ, ভেজাল ওষুধ উৎপাদন বন্ধ এবং মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রয়ের উপর কঠোর নজরদারি ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থাসহ ব্যাথানাশক ও এন্টিবায়োটিক সেবনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ বাধ্যতামূলক করণ। সর্বসাধারণের জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে স্বাস্থ্যবীমা প্রচলনের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তির বিষয়ে সরকারের কার্যকরী পদক্ষেপ স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অন্যান্য সাধারণ অবদান রাখতে সহায়ক হবে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, সরকারি উদ্যোগ, মানবিক সমাজের মনোযোগ, নাগরিক সচেতনতা এবং স্বাস্থ্যখাতে শৃঙ্খলা ও দুর্নীতিমুক্ত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রিয় মাতৃভ‚মি বাংলাদেশ হতে পারে স্বাস্থ্যও চিকিৎসা-ট্যুরিজমের জন্য সারা বিশ্বের রোল মডেল। লেখক: আজীবন সদস্য, কিডনি রোগী কল্যাণ সংস্থা

মানুষ, সমাজ ও ভাষা
আফতাব চৌধুরী: ভাষা হচ্ছে কতগুলো অর্থবহ ধ্বনি সমষ্টির বিধিবদ্ধ রূপ; যার সাহায্যে একটি বিশেষ সমাজের লোকেরা নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময় করে। যে জনসমষ্টি এক ধরনের ধ্বনি সমষ্টির বিধিবদ্ধ রূপের দ্বারা নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময় করে ভাষা বিজ্ঞানীরা তাকে একটি ভাষা সম্প্রদায় হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এখানে একটি ধ্বনি সমষ্টির উল্লেখ করা যাক- ‘আমরা বই পড়ি’। এ ধ্বনি সমষ্টি নির্দিষ্টক্রমে বিন্যস্ত করে শুধু বাঙ্গালিরা ব্যবহার করে এবং এর দ্বারা যে ভাব প্রকাশিত হয় তা আমরা বাঙ্গালিদের একটি ভাষা-সম্প্রদায় হিসেবে অভিহিত করতে পারি। এ ক্ষেত্রে ইংরেজরা যে ধ্বনি সমষ্টি ব্যবহার করবে তা হল- উই রিড বুকস। জার্মানরা এ ক্ষেত্রে বলবে- উইর লেসেন বিলসার। ফরাসিরা বলবে- নুয়াস লিসন্স ডেসলিভার্স। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে, একই ধরনের ধ্বনি সমষ্টি দিয়ে সব মানুষের কাজ চলে না। এক এক ধরণের ধ্বনি সমষ্টি ও ধ্বনি সমাবেশ-বিধিতে এক একটি জনগোষ্ঠী অভ্যস্ত। ভাষা হচ্ছে মানুষের এমন এক অনন্য সুলভ বৈশিষ্ট্য, যা অন্য প্রাণী থেকে মানুষকে স্বাতন্ত্র্য দান করেছে, তার স্বাতন্ত্রের এ অভিজ্ঞানটি সে পৃথিবীতে তার আবির্ভাবের পর ক্রমবিকাশের ধারায় অর্জন করছে। এ অনন্য সুলভ সম্পদটি শুধু তার আছে। কারণ তার প্রয়োজন আছে এ সম্পদের। তার কারণটি অবশ্য আমরা যদি তলিয়ে দেখি তবে দেখতে পাব এর মূলে আছে আবার অন্য একটি আরো গভীরতম মানব বৈশিষ্ট্য, যেটি অন্য প্রাণীর নেই। সেটি হচ্ছে মানুষের মন এবং মনের ক্রিয়াজাত তার চিন্তারাজি। বিবর্তনের ধারায় ঝড়ের পরে প্রাণের বিকাশ হওয়ায় বৃক্ষলতা-পশুপক্ষীর আবির্ভাব সম্ভব হয়েছে। এর পরের ধাপে মনের বিকাশের ফলে মানুষের আবির্ভাব হল। মন আছে বলে মানুষ চিন্তা সম্পদের অধিকারী। নিজের ভাব ও চিন্তার সম্পদকে অন্যের কাছে পৌঁছে দিতে চায় বলে তার প্রয়োজন হয় এক উন্নততর প্রকাশ মাধ্যম যার নাম ‘ভাষা’। শুধু ক্ষুধা-তৃষ্ণা বা অন্য জৈববৃত্তি প্রকাশের তাগিদে ভাষার জন্ম হয়নি। জৈব চাহিদাকে অন্যের মনে সঞ্চার করে সমস্যার সহজতর সমাধানে ভাষা আমাদের সহায়তা করে ঠিক কিন্তু পুরোপুরি জৈব বৃত্তির তাগিদে ভাষার জন্ম হয়নি। যদি শুধু জৈব তাগিদে ভাষার জন্ম হত, তবে জীবজন্তুরা ভাষার জন্ম দিতে পারত অথবা শুধু জৈব প্রয়োজন মিটাতে হলে জীবজন্তুর মতো অস্ফুট ভাষা ও ইঙ্গিত হলে মানুষের কাজ হয়ে যেত। বস্তুর উন্নততর ভাব ও চিন্তাকে প্রকাশের জন্য মানুষের ভাষার প্রয়োজন। এ জন্য চিন্তা ও ভাষার মধ্যে অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক রয়েছে। চিন্তার সঙ্গে, মানুষের মনের সঙ্গে তার আত্মার সঙ্গে ভাষার এ অপরিহার্য সম্পর্ক আছে বলে জার্মান মনিষী হুমবোল্ট আরো গভীরে গিয়ে বলেছেন- মানুষের ভাষা হল তার আত্মা, আর আত্মা হল তার ভাষা। উক্তিটিতে কবি সুলভ উচ্ছ্বাস আছে স্বীকার করি। কিন্তু অস্বীকার করতে পারি না যে, মনীষীর মূল অনুভূতিটি নির্ভূল কারণ ভাষার সঙ্গে মানুষের মন ও তার আত্মার যোগ অবিচ্ছেদ্য। অর্থাৎ ভাষার উৎস তার মনে, মনের চিন্তারাজির প্রকাশের তাগিদে ভাষার জন্ম। ভাষা হচ্ছে মানুষের চিন্তার ধ্বনি মাধ্যম বিকাশ। ভাষাবিদরা বলেছেন, চিন্তা ও ভাষা মূলত এক, পার্থক্য শুধু এটুকু যে চিন্তা হল নিজের সঙ্গে নিজের নীরব কথোপকথন এবং যে প্রবাহটি আমাদের চিন্তা থেকে ধ্বনির আশ্রয়ে ওষ্ঠের মধ্য দিয়ে বয়ে আসে তা হল ভাষা। ভাষা সৃষ্টির মূলে মানুষের দুটি দিক রয়েছে। ব্যক্তি মানুষের মন ও চিন্তা, সমাজবদ্ধ মানুষের ভাব বিনিময়ের ইচ্ছা। অর্থাৎ ভাষার যেমন একটি ভাবগত উৎস আছে, তেমনি একটি সমাজগত চাহিদাও আছে। আধুনিককালে সাহিত্যের যেমন সমাজগত দিকটি বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হচ্ছে, তেমনি ভাষার সমাজগত দিক প্রাথমিক তাৎপর্য লাভ করছে। ভাষা বিজ্ঞানীরা তাই প্রথমে মনে করিয়ে দিচ্ছেন- ‘দ্যা ফার্স্ট পয়েন্ট উই মাস্ট মেক এবাউট ল্যাঙ্গুয়েজ, দেন, ইজ দ্যাট ইট ইজ এ সোস্যাল, র্যাদার দেন এ বায়োলজিকেল অ্যাসপেক্ট অফ হিউম্যান লাইফ।’ তাই ভাষা বিজ্ঞানীরা আজকাল সমস্বরে বলছেন, ‘ভাষা হচ্ছে একটি সামাজিক সংস্থা। এ কথার তাৎপর্য দ্বিবিধ। প্রথমত, ভাষার জন্ম সামাজিক প্রয়োজনে অর্থাৎ সমাজের অন্তর্গত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ভাব বিনিময়ের প্রয়োজনে। দ্বিতীয়ত, ভাষার প্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত হয় সমাজের কাঠামো অনুসারে। যে সমাজে শিশুর প্রতি সম্পর্কের আচরণের পার্থক্য আছে, সেখানে তাদের প্রত্যেকের জন্য ভাষার রয়েছে পৃথক পৃথক নাম-সম্পর্ক চিহ্ন। তাছাড়া কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সামাজিক গঠনের পরিবর্তন ঘটছে। ফলে এ সব সম্পর্ক চিহ্নের পরিবর্তন ঘটছে। সামাজিক প্রয়োজনে ও সামাজিক কাঠামো ভাষার প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। এসব কারণে আমরা ভাষাকে একটি সামাজিক সংস্থা বলতে পারি। আমাদের সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, সভ্যতার ক্রমবিকাশের দ্বারা যেমন ক্রমোন্নতি লাভ করবে তেমনি তার নতুন নতুন নান্দনিক উপলব্ধি, সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ ভাব ও বৈজ্ঞানিক আবিস্ক্রিয়া প্রকাশের জন্য ভাষাকে হতে হবে তত সূক্ষ্ণ উন্নত ও মার্জিত প্রকাশক্ষম। লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

বাঙালির প্রাণের ভাষা প্রিয় বাংলা ভাষা
আবছার উদ্দিন অলি: ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’ খ্যাতিমান গীতিকার আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা ও দেশ বরণ্যে সুরকার আলতাপ মাহমুদের সুরে এই কালজয়ী গানটি একুশের চেতনায় আমাদের উজ্জীবিত করেছে। আমাদের সাহস, অনুপ্রেরণা উৎসাহ যুগিয়েছে। এই একটি গান এত জনপ্রিয় যে, যাকে এখনো অন্য কোন গান জনপ্রিয়তার দিক থেকে অতিক্রম করে যেতে পারিনি। তাইতো একুশের গান বাংলা ভাষার অহংকার। বিনম্র শ্রদ্ধায় পালিত হবে একুশে ফেব্রুয়ারি। বাংলা ভাষা প্রাণের ভাষা। সমগ্র বাংলাদেশের প্রায় ১৮ কোটি লোক বাংলা ভাষা ব্যবহার করে এবং হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকলেই এর বিকাশ ও সমৃদ্ধিতে সাহায্য করে এটিকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে উন্নীত করেছে। ভাষার জন্য আন্দোলনের অর্ধ শতাব্দীকাল পরেও বাংলা ভাষার শহীদরা সেদিন যে স্বপ্ন দেখে নিঃশেষে প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন তার কতটা পূরণ হয়েছে, সেই প্রশ্ন উচ্চারিত হয়ে আসছে জনে জনে। স্বাধীনতা পরবর্তী ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা সংবিধান অনুযায়ী বাংলা ভাষা হলেও তার কতটুকু জাতীয় জীবনে প্রবর্তিত হয়েছে বা তার প্রাপ্য মর্যাদা অর্জন করেছে এ প্রশ্ন এখনো অমিমাংসিত। বাংলা ভাষাকে তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণার দাবিতে সেদিন পূর্ববঙ্গের সরকার প্রধান সমীপে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে শত শত নাগরিকের স্বাক্ষর সম্বলিত যে স্মারকপত্র পেশ করা হয়েছিল বাংলা ভাষা ভারতবর্ষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সম্পদশালী ভাষা এবং বিশ্বে প্রধান প্রধান ভাষাগুলোর মধ্যে একটি বিশিষ্ট স্থানের অধিকার। ১৯৫২-২০২৫ এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় আমরা দেখলাম, একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের অন্তহীন প্রেরণার উৎস। সেই ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখে বাঙালি তরুণেরা মাতৃভাষার মর্যাদার দাবিতে ঢাকার রাজপথে যে রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন, এই ফেব্রুয়ারির সেই রক্তেরই ডাক শুনেছে সমগ্র বাংলাদেশ। এবারের ডাক ন্যায়বিচারের, মানবতার ও সহিংসতার বিরুদ্ধে সংঘটিত ইতিহাসের নৃশংসতম অপরাধের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করার আহ্বান। ৫২’র শহীদ, তোমাকে সালাম। মাতৃভাষার দাবিতে বাঙালি তরুণদের সেদিনের আত্মবলিদান শুধু ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, ক্রমেই একটি গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বপ্ন ও অঙ্গীকার দানা বেঁধেছিল। সে স্বপ্নই স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধসহ ইতিহাসের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে আমাদের পথ দেখিয়েছে। তাই ফেব্রুয়ারি স্বাধীনতা, মুক্তি, সাম্য, গণতন্ত্র-আধুনিক বাঙালির সব শুভ চেতনার মাস। তারপর আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারির মিলেছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এই দিবসটি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসও বটে। মাতৃভাষা বাংলার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগের মহিমা ছড়িয়ে পড়েছে ভৌগলিক সীমারেখা অতিক্রম করে পৃথিবীর সব জাতি-গোষ্ঠীর মাতৃভাষার স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে। সত্য, ন্যায়, শান্তি ও গণতন্ত্রের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের দৃঢ় অঙ্গীকারের বার্তা ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয় এই দিনে। সবার সব পথ এসে মিশে গেছে শহীদ মিনারে। কন্ঠে ছিল সেই চিরচেনা বিষন্ন সুর। অনুপ্রাণিত ভোরের হাওয়ায় মর্যাদা সুমন্নত রাখতে বাংলা মায়ের বীর সন্তানদের বুকের রক্ত ঢেলে রাজপথ রাঙিয়ে দেওয়ার দিন অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। দিনটি সারা বিশ্বে পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। একুশ মানেই মাথা নত না করা। একুশ মানেই আন্দোলন, সংগ্রাম, প্রতিরোধ। বিশ্বের প্রতিটি জনগোষ্ঠীর নিজ নিজ মাতৃভাষা সংরক্ষণ ও বিকাশের বিষয়টি তাদের রাজনৈতিক অধিকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আমাদের এই দেশেও সংখ্যার দিক থেকে ছোট অনেক জনগোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন মাতৃভাষা রয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির পাশাপাশি সব সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির স্বকীয় পরিপুষ্টির সুযোগ অবারিত রাখা অত্যন্ত জরুরি। শুধু আনুষ্ঠানিকতায় মাতৃভাষায় মর্যাদা নেই, সর্বস্তরে মাতৃভাষার প্রচলন ঘটলেই কেবল তার মর্যাদা পায়। শিক্ষাসহ জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমে প্রয়োজন একটি জাতীয় ভাষা পরিকল্পনা। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন কিছু স্থায়ী প্রতিষ্ঠান ও মানুষ, যাঁরা বাংলা ভাষার বিকাশের লক্ষ্যে নিরন্তর কাজ করে যাবেন। মহান একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জীবনে শোক, শক্তি ও গৌরবের প্রতীক। ১৯৫২ সালের এ দিনে ভাষার মর্যদা রক্ষা করতে প্রাণ দিয়েছিলেন রফিক, শফিক, জব্বার, বরকত, সালামসহ আরও অনেকে। সারাবিশ্বের সকল নাগরিকের সত্য ও ন্যায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রেরণার উৎস আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সব ভেদাভেদ ভুলে একুশের উদ্বুদ্ধ হয়ে জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার শপথ নেই। লেখক: সাংবাদিক ও গীতিকার, চট্টগ্রাম

মানবিক চেতনার স্বপ্নবাজ কিডনি যোদ্ধা এসএম জাহেদুল হক স্মরণে
হৃদয় বড়ুয়া: মানুষ বাঁচে তার কর্মের মধ্যে, বয়সের মধ্যে নয়। পৃথিবীতে মানুষের শারীরিক উপস্থিতি স্বল্পকালীন। এ সময়ের মাঝে কেউ যদি মহৎ অবদান রাখে, সে-ই প্রতিষ্ঠিত হয় মহাকালের ইতিহাসে। অন্যথায় হারিয়ে যায় কালের গর্ভে। যে মানুষটিকে স্বশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি আজ তার প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী। তিনি হলেন এসএম জাহেদুল হক। পেশায় সাংবাদিক হলেও বাস্তব জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী-সংগ্রামী, পরিশ্রমী সত্যনিষ্ঠ হার না মানা একজন স্বপ্নবাজ মানবিক চেতনার মানুষ। তিনি স্বপ্ন দেখতেন, দেখাতেন আর তা বাস্তবায়নে নিরলস নির্ভিক নির্লোভ ভূমিকা পালন করতেন। তাঁর কাছে একটা পিতৃস্নেহ, শাসন, অনুরাগ ও ভালোবাসা পেয়েছি। তিনি ছিলেন আমার শিক্ষাগুরু, আদর্শ সমতুল্য। দীর্ঘ কর্মময় জীবনে তিনি আমাকে হাতে কলমে কাজ শিখিয়েছেন ও মানুষের প্রতি দয়া দাক্ষিণ্য অনুকম্পা প্রদর্শন করা শিখিয়েছেন। সর্বদায় দিয়েছেন উদ্যমী হওয়ার অনুপ্রেরণা। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত কিডনি রোগী কল্যাণ সংস্থার উদ্যোগে একটি ডায়ালাইসিস সেন্টার ও দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে গেছেন। তিনি এ সংস্থার পতাকা তলে চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী পরিবারসহ বহু গুণী মানুষকে নিজগুণে সমবেত করতে পেরেছিলেন। তাই, তিনি মৃত্যুবরণ করেও বেঁচে আছেন তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ও তাঁর মানবিক চেতনার কর্মকাণ্ডের মধ্যে। এসএম জাহেদুল হক ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়া উপজেলাার উত্তর কাঞ্চনার মিয়া বাড়ির মনুফকির হাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মৃত মোজাহেরুল হক ও মাতা মৃত মাহাবুবা বেগম। অত্যন্ত পরোপকারী মেধাবী মানুষটি ১৯৮২ সালে দাখিল, ১৯৮৪ সালে আলিম, কামিল, ১৯৮৭ সালে ফাযিল, ১৯৮৯ সালে বিএ অনার্স ও ১৯৯৮ সালে এলএলবি ডিগ্রী অর্জন করেন। স্বপ্নবাজ চেতনার মিষ্টভাষী জাহেদুল হকের জীবনের সিংহভাগ সময় মানব সেবায় ব্যয় করেন। তিনি সাংবাদিকতার পেশায় সিএমইউজের সাবেক অর্থ সম্পাদক ও দৈনিক কর্ণফুলী, দৈনিক খবরপত্র, দৈনিক স্বাধীন বাংলা পত্রিকায় ব্যুরো চীফসহ বিভিন্ন পত্রিকায় নানা দায়িত্ব পালন করেন। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ছুঁটে আসা জাহেদুল হকের জীবদ্দশা এত সহজ ছিল না। তিনি সাংবাদিকতা পেশার পাশাপাশি একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থারও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যে আচার-আচারণ, নম্র-ভদ্রতায় জয় করেন মানুষের হৃদয়। পরিচিতি পায় জাহেদ ভাই নামে। তাঁর ১০০ ফুটের অফিসে সব স্তরের মানুষ ছুটে আসত। বলা যায়, বুদ্ধিমত্তা ও একজন ভালো পরামর্শক ও দক্ষ সংগঠক ছিলেন। ২০১৫ সালে তিনি কিডনি রোগে আক্রান্ত হন, নেমে আসে তাঁর জীবন বেয়ে এক কালো অধ্যায়। এ ব্যয়বহুল ডায়ালাইসিস চিকিৎসা চালাতে গিয়ে তিনি হিমশিম খেয়ে যান। এক পর্যায়ে দুটি কিডনি বিকল হয়ে পড়ে। তিনি ২০১৬ সালে ভারতের একটি মেডিকেলে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করেন। ব্যয়বহুল কিডনি চিকিৎসার ভার বহন করতে না পেরে অকালে বিনা চিকিৎসায় বহু মানুষের মৃত্যু তাঁকে ভাবিয়ে তুলে, অংঙ্গীকার করেন তাদের জন্য কিছু করার। জীবদ্দশায় জাহেদুল হক একজন কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট রোগী হওয়ার সত্বেও দিন-রাত হতদরিদ্র কিডনি রোগীদের সেবায় সব সময় অতিবাহিত করে যান। কিডনি রোগীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন একাগ্রচিত্তে। এমন ব্যয়বহুল ডায়ালাইসিস খরচ ও ট্রান্সপ্ল্যান্ট সামর্থ না থাকা হতদরিদ্র কিডনি রোগীদের কল্যাণের জন্য ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কিডনি রোগী কল্যাণ সংস্থা। তাঁর মেধা, হার না মানা অদম্য প্রত্যয়ে স্বপ্ন নিয়ে তিলে তিলে গড়ে তুলা কিডনি রোগী কল্যাণ সংস্থা ২০২২ সালে বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক নিবন্ধন পায়। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত কিডনি রোগী কল্যাণ সংস্থার উদ্যোগে একটি ডায়ালাইসিস সেন্টার ও দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে গেছেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ‘যে ভোর চড়ই-ঘুঘু-বুলবুলির রাজত্বে থাকে সে ভোরে ছিল পেঁচার আত্মনাদ’! স্বপ্নবাজ কিডনি যোদ্ধা এসএম জাহেদুল হক আর নেই। এমন না ফেরার দেশে পাড়ি দেয়া স্বপ্নবাজকে দেখে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। তাঁর বলা একটি শব্দ হৃদয়ে তীব্র আঘাত করেছে যা এখনও করছে ‘হৃদয় কিডনি রোগীদের জন্য একটি হাসপাতাল করে যেতে পারলে আমার আত্মা শান্তি পাবে, কিডনি রোগীদের আত্মনাদ আমাকে ঘুমাতে দেয় না’ ২০২৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার রাত ৩টায় নিজ বাসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। অত্যন্ত মেধাবী-সংগ্রামী, পরিশ্রমী সত্যনিষ্ঠ হার না মানা এই স্বপ্নবাজ মানবিক চেতনার মানুষটিকে নিজ গ্রামে মসজিদের প্রাঙ্গণে পারিবারিক কবর স্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়। তার প্রথধম মৃত্যু বার্ষিকীতে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাচিত্তে স্মরণ করছি। স্মৃতিতে তিনি অমর হয়ে রবে হৃদয়ে। প্রভু দয়াময় তাঁর অসমাপ্ত স্বপ্ন বাস্তবায়নে সহায় হোন, তাঁর পরিবার-পরিজনের সুস্বাস্থ্য কামনা করছি। এটাই আজকের দিনের একমাত্র কামনা। লেখা: সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী, আজীবন সদস্য- কিডনি রোগী কল্যাণ সংস্থা

১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস: তারুণ্যের হৃদয় ছোঁয়া ভালোবাসা
আবছার উদ্দিন অলি: ডিজিটাল যুগে ভালোবাসার সংজ্ঞা পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন কে কাকে ভালোবাসে, আর কে বাসে না, সেটা বুঝাই খুব কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভালোবাসায় বিশ্বাসের জায়গা শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। ভালোবাসার রঙ বদলায় চাওয়া পাওয়ার এই জীবনে, নিজেকে হারায় যুগে যুগে প্রিয়জনে, স্বার্থের টানে যদি ভালবাসার মাপকাঠি হয়, সে ভালবাসায় নেমে আসে পরাজয় জীবনের প্রতিটি ক্ষণে, সত্যিকারের ভালবাসা যদি থাকে মনে প্রাণে, সেই মানুষের বন্ধন চিরজীবন হয়ে উঠে, ভালবাসার আপনজনে। ১৪ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) ভালবাসা দিবস। ভালোবাসার দিন, ভালোলাগার দিন। সব সময় ভালোবাসা সবার জন্য ভালোবাসা প্রতিদিন, প্রতিমাস, প্রতিক্ষণ। দেশের জন্য ভালোবাসা, সন্তানের জন্য ভালোবাসা, বাবা-মায়ের জন্য ভালোবাসা, স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা, বন্ধুর বান্ধবের ভালোবাসা, প্রেমিক প্রেমিকার ভালোবাসা, শুভাকাংখী ও শুভার্থী জন্য ভালোবাসা- সব ভালোবাসার মূলমন্ত্র একটাই, সেটা হলো নিজেকে অন্যের সুখ দুঃখ, হাসি কান্নায় অংশীদার করা। ভালোবাসার জন্য সবচাইতে বেশি প্রয়োজন সুন্দর মন। রুচিশীল চিন্তাভাবনা। কারো ক্ষতি না করার মনমানসিকতা গড়ে তোলা, ভালোবাসায় কারো ক্ষতি, অহংকার, থাকা কাম্য নয়। নিজের সুন্দর মনটাকে সুন্দর ভাবে অন্যকে উপস্থাপন করাই ভালোবাসা। শরীরের প্রতি আকাংঙ্খা, নারী লোভ, মানিব্যাগের প্রতি দূর্বলতা, আধুনিকতার নামে উশৃংঙ্খলতা, উগ্রতা, বিদেশী সংস্কৃতির ছায়া অনুকরণ, আমাদের প্রকৃত ভালোবাসা কালো আধাঁরে অন্ধ গলির চোরাপথে এগিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে নতুন প্রজন্ম তথ্য প্রযুক্তির ভালো দিকটার চাইতে খারাপ দিকটাই ঝুঁকে পড়েছে। সাইবার ক্রাইম, ইয়ারা ট্যাবলেট, উগ্র পোশাক, মোবাইল, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, নোটবুক আইফোনসহ অন্য সব ব্যবহৃত জিনিসপত্রে নগ্নছবির ব্যবহার ও তরুন তরুনীদের নগ্ন দৃশ্য ধারন করে ব্ল্যাক মেলিং চলছে। যার কারণে ভালোবাসা, পশুত্বের রূপ লাভ করছে। হচ্ছে খুন, ধর্ষণ, আত্মহত্যা, যৌন হয়রানী, ইভটিজিং, বিবাহ বিচ্ছেদ, কিশোর গ্যাং, মাদকের প্রতি আসক্তি সহ ছড়িয়ে পড়েছে নারীর প্রতি সহিংসতা। চারটি অক্ষরের একটি শব্দ ভালোবাসা। প্রেমের ধরণ হরেক রকম। এই প্রেমকে নিয়ে কবি কবিতা লিখেছেন, গীতিকার লিখেছেন গান, সাহিত্যিক তার ভাষায় প্রকাশ করেছেন নানা রকমের চিন্তাধারা। শিল্পী প্রেম নিয়ে গেয়েছেন গান সেই সাথে বাদ পড়েনি এমনকি বিজ্ঞানীও। দেশে এখন প্রেমিক প্রেমিকার সংখ্যা এত বেশী যে, কল্পনার বাইরে। তা বুঝা যায় শহরে একটা কফি হাউসও প্রতিদিন একটি ঘন্টার জন্যও খালি থাকে না। জোড়া জোড়া কপোত-কপোতি নিরবে আপন মনের কথা বলে যায় ডেটিং স্পটগুলোতে। আবার কখনো কখনো এখানে ভিলেন মাস্তান বখাটেদের আড্ডা বসে। হয়তো একটু উঁকি কিংবা কিছু বাংলা ছবির সংলাপ বড় গলায় বলার জন্য। আবহমান কাল হতেই প্রেম করতে গিয়ে অনেকে হয়েছে নি:স্ব। ছেলে মেয়েদের পছন্দ-অপছন্দের কোন তোয়াক্কাই করেনি অভিভাবকেরা। যদি কোন ছেলে মেয়ে প্রেম করতে গিয়ে কোন বিপদে পড়েছে তাহলে তাকে করা হয়েছে সমাজচ্যুত, কলংকিত এমনকি দৈহিক নির্যাতন করে তার অভিলাষকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে। প্রেম করাটা আসলে কেউ ভালো চোখে দেখে না। যদি কোন অভিভাবক শুনে তার ছেলে মেয়ে প্রেম করছে অতঃপর বিয়ে করবে তাহলে কোনভাবেই সেই প্রেম সার্থক হতে দেয় না, ছেলেটা যতই ভালো হোক শিক্ষিত, ভদ্র, ঘরবাড়ী, আয় রোজগার থাকুক না কেন তার অপরাধ সে প্রেম করেছে। এ সমাজে ছেলে-মেয়েদের প্রতিদিনই মিডিয়ায় প্রেম শেখানো হচ্ছে। এমন একটা রীতি গতানুগতিক ধারায় চলে আসছে প্রেম করে বিয়ে করলে সুখী হওয়া যায় না। বড় একটি কুসংস্কার আমাদের সমাজে বিরাজ করছে, একটা সুন্দর মন আর সহনশীল ও আন্তরিক মনোভাব বড় বেশী প্রয়োজন এক্ষেত্রে। ভালোবেসে কেউ ঘর বাঁধে, কেউ ঘর ছাড়ে তবু মানুষ প্রেম করে এবং অনাদিকাল করবে। প্রেম পবিত্র ও পরিস্কার বাস্তবমুখী খাঁটি সুন্দর মন ও মননশীলতার ভেতরে গড়ে তুলতে হবে তবে প্রেমটা হবে নজর কাড়ার মত। এসএমএস, ই-মেইল, ফেইসবুক, ইন্টারনেটে চলছে ভালোবাসার আলাপ চারিতা। ভুল বানান রুচিহীন মেসেজ, অর্ধনগ্ন ছবি আদান-প্রদান চলছে। ভালোবাসার পাত্র-পাত্রীরা মোবাইল কোম্পানীর ফ্রি টকটাইম ও এসএমএস এর বিশেষ ছাড় কখন আসবে সে অপেক্ষায় প্রতীক্ষার প্রহর গুণে। ফেসবুকে নতুন নতুন ছবি ডাউনলোড করা, ই-মেইলে নতুন মন্তব্য লেখা চলছে সমানতালে। হোক শুদ্ধ কিংবা ভুল বানান। রুচিহীন ভালোবাসা চলছে, চলবে। আবার কেউ কেউ বাজার থেকে মেসেজ বই কিনে, ম্যাগাজিন কিংবা নতুন কোন বই থেকে মেসেজ কপি করে প্রিয়জনকে পাঠাচ্ছে। নকলের জোয়ার চলছে। হাতের লেখা চিঠির সেই আবেগ, এই গভীরতা নেই, সেই হৃদ্যতা এখন আর দেখা দেয় না। নিবিড় সুখের বন্ধন আর প্রেমের রহস্যময়তা কিংবা ভালোবাসার যত ছলকলা ভিন্নরূপে ভিন্ন মেজাজে উপস্থাপনা হচ্ছে। তবুও ভালোবাসা, ভালোবাসার মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ুক সবার মাঝে। ভ্যালেন্টাইন’স ডে ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখুক অনন্তকাল। লেখক: সাংবাদিক ও গীতিকার

বিচারহীনতার সংস্কৃতি যেন না আসে
গাজী তারেক আজিজ: দেখতে দেখতে ছয় মাস পার করলো অন্তর্বর্তী সরকার। পার করছে চরম বৈরী সময়। এরই মধ্যে ঘটে গেলো আরেক নির্মমতা। গুড়িয়ে দেয়া হলো স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের তীর্থস্থান খ্যাত ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারের বাড়ি। যে বাড়িতে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট স্ব-পরিবারে হত্যাকান্ডের শিকার হন বঙ্গবন্ধুসহ একই পরিবারের মোট ১৭ জন সদস্য শহীদ হন। এ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নিকট আত্মীয় আরও ৯ জন শহীদ হন। সর্বমোট ২৬ জনকে খুনিরা নৃশংসভাবে সে রাতে খুন করে। যা ছিল নজিরবিহীন এক হত্যাযজ্ঞ। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুননেছা, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান, কর্ণেল জামিল (বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা অফিসার), সেনা সদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হক প্রমুখকে খুন করে খ্যান্ত হয়নি খুনিরা। প্রায় একই সময়ে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণির বাসায় হামলা চালিয়ে শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াতের বাসায় হামলা করে সেরনিয়াবাত ও তার কন্যা বেবী, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে সজীব সেরনিয়াবাত, এক আত্মীয় বেন্টু খান, আবদুল নঈম খান রিন্টুকে (আওয়ামী লীগ নেতা আমীর হোসেন আমুর খালাতো ভাই) খুন করে। ওই সময় দেশে না থাকায় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ভয়ঙ্কর সেই হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পর ওই সময় খুনিরা প্রকাশ্যে তাদের এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বিভিন্ন বিদেশী সংবাদ মাধ্যমে স্বীকার করে। এ হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই বিচারের আওতায় যেন কোন দিন না আসে তাই দেশে নতুন আইন ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ চালু করা হয়। যা ছিলো কালো আইন বলে খ্যাত। নির্মম এই হত্যাকাণ্ড যারা করেছে তাদের বিচারের আওয়াতায় না এনে উল্টো বিচারের পথ আইনগতভাবে রূদ্ধ করার বেআইনী প্রক্রিয়া জাতিকে করেছিলো কলুষিত। শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনি ব্যবস্থা থেকে অনাক্রম্যতা বা শাস্তি এড়াবার ব্যবস্থা প্রদানের জন্যই মূলত বাংলাদেশে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ এ ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন। এতে করে তৎকালীন বিচার পাওয়ার পথ স্থায়ীভাবে বন্ধ করা হয়েছে বলে মনে করা হলেও আদতে তা হয়নি। ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায় থেকে বিচার ও শাস্তি নিশ্চিতের মাধ্যমে সেই কালো আইন কিংবা বিচারহীনতার যে আইনানুগ সংস্কৃতি তা থেকেও দেশ, দেশের বিচার ব্যবস্থা ও বিচারালয় কলুষমুক্ত হতে পেরেছিল বলেও ধরে নেয়া হয়। তথাপিও আরেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে চট্টগ্রামে সার্কিট হাউজে হত্যা করে। তখন বুঝতে বাকি থাকে না, দেশের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা দেশ বিরোধী চক্র থেমে ছিল না। আর সেটা যুগে যুগে চলমান ছিল, আছে এবং থাকবে। রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন ব্যক্তিকে ক্ষমতা থেকে হটানো কিংবা হটাতে চক্রান্ত করে দেশকে চরম অস্থিতিশীল করেও কেমন যেন এক ধরনের আনন্দ অনুভব করে আরেক ধরণের লোক। এ অবস্থা থেকে বাঁচতে হলে হয় কৌশলী হতে হবে অথবা ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকা চাই। যুগে যুগে এই ধরনের অবস্থা বা সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে শাসকদের কেউ কেউ এতটাই কঠোর ও কঠিন হয়েছে যে তা নির্মমতার মাত্রা অতিক্রান্ত করেছে। একটা পর্যায়ে তারা স্বৈরশাসক তকমা পেয়ে আরো বেশিমাত্রায় কঠোর হয়েছেন। সবার কেউ কেউ আরো বেপরোয়া হতেও দ্বিধা করেননি। এই পরিস্থিতি উৎরিয়ে কেউ মহান হতে পেরেছেন তেমনটা দেখা যায় না খুব একটা। আবার শাসকের রোষানলে পড়ে নিজেদের জীবন-যৌবন কাটিয়েছেন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। এইসব নেতারা গণমানুষের রাজনীতি করে জীবন যৌবন উৎসর্গ করেছেন। তেমনই একজন ছিলেন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি মানুষকে ভালোবেসে, বিশ্বাস করে আত্মবলিদান করেছেন স্বমহিমায়, স্বগৌরবে। বাংলাদেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে একটা স্বাধীন সার্বভৌম ভূখণ্ড উপহার দিয়েছিলেন। আর এই সময়ে এসে তাঁকেও চরম দেশপ্রেমের পরীক্ষায় পড়তে হচ্ছে! তা না হলে কেন তাঁর নিজের বাসভবন ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও শেষে গুড়িয়ে দেয়া হয়। সভ্য সমাজ তো দূরে থাক, অতীতের সকল সংকটেও কেউ যে বাড়ির দিকে আঙুল তুলে কথা বলার সাহস করেনি, তাই হলো। তারপর কি দেখলাম? মিডিয়ার অতি উৎসাহ যতটা না মানুষকে বিদ্বেষ ছড়িয়েছে ঠিক ততটাই নজিরবিহীন পাহারাদারের ভূমিকাও ছিল লক্ষ্যণীয়। সেটা কেমন? প্রশ্ন থেকে যেতে পারে! তা হচ্ছে আরেক ধরনের গুজব রটিয়ে ফায়দা ওঠানো। যেমন ৩২ নাম্বারের সেই বাড়িটার পার্কিং বেজমেন্টে তথাকথিত আয়নাঘরের সন্ধান লাভের আশায় কথিত ভিউ ব্যবসায়ী অনলাইন মাল্টিমিডিয়ার ক্যামেরা। না হলে সুযোগ মতো সেখানটায়ও কোন না কোন হাঁড়গোড় রেখে আরেক গল্পের ফাঁদ পেতে মিডিয়ার খোরাক বানানো যেত! যা মিডিয়ার কল্যাণে আর হয় নি। দীর্ঘ কয়েকদিনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। আর হতাশ হয় তথাকথিত ‘মবকারীরা’। কিছুই পাওয়া গেল তো না-ই! একটা যেনতেন ছোট দুই তিন ইঞ্চি সাইজের হাঁড় নিয়েও গবেষণার কোন কমতি নেই! একেকজন যেন বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। তা ভালো কথা! পাশাপাশি সারাদেশে শুরু হলো ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা। গাজীপুরে হলো ব্যতিক্রম। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাসায় অগ্নিসংযোগ আর লুটপাট করতে গেলে স্থানীয় জনতার দাবড়ানি খেয়ে পালাতে তো পারলোই না উল্টো হামকার শিকার বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কতিপয় নেতা-কর্মীর। এতে ক্ষেপে যায় কেন্দ্রীয় নেতারা। তারা ও স্থানীয় নেতাদের দাবী তারা সাবেক মন্ত্রী মোজাম্মেল হকের বাড়ি রক্ষা করতেই গিয়েছিল। আর হামলার শিকার হয়েছে। তারা ভাবতেই পারেনি এভাবে প্রবল বিরোধিতায় পড়তে হতে পারে! কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের কর্মসূচি চলে। এই কয় দিনে আরো দেখা হয় ৩২ নাম্বারের ইট রডসহ খুলে নেয়ে যেতে। সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযানের নামে সেনাবাহিনীসহ যৌথবাহিনীর নেতৃত্বে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’। ধরা হতে থাকে আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী, সমর্থকদের। বলা হয়েছিল গায়েবী মামলা হচ্ছে। হয়েছেও তাই। সরকারে থেকেই আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বললেন মামলায় নাম থাকলেই যেনতেন গ্রেফতার নয়। পুলিশ প্রধানও একই কথা বারবার বলেছেন। তথাপিও আমরা দেখছি অনেক নিরীহ লোককে ধরে উল্লেখিত গায়েবী মামলায় ফরওয়ার্ড করতে। পাশাপাশি যাদের নাম এজাহারে উল্লেখ করেছে কিন্তু অভ্যুত্থান তথা আন্দোলনে কোন ভূমিকা ছিল না তেমন লোকদের ধরে চালান করা হচ্ছে। এতে কি হচ্ছে? একটা পরিবার আর্থিক ও মানবিক বিপর্যয়ে পড়ছে। উপরন্তু গেপ্তার হলে জামিন পেতে ব্যাপক ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। আর এক শ্রেণির লোক মামলার তদ্বির বাণিজ্য করে হাতিয়ে নিচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা। এই পর্যন্ত ডেভিল হান্টে গ্রেফতার হয়েছে প্রায় ২ হাজার লোক। জানা হয়নি সকলেই আওয়ামী লীগ কর্মী সমর্থক কিনা? তাছাড়া সরকার থেকে গ্রেপ্তারকৃতদের এবং অন্য যারা গ্রেপ্তার হচ্ছে তাদের ‘ডেভিল’ বলে সম্বোধন করা হচ্ছে। এক শ্রেণির আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থকরা তৎকালীন যেমন বেনিফিশিয়ারী নয়। তেমনই এখনও মানবেতর জীবনযাপন করছে বলে শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েও কি রক্ষা হচ্ছে? বোধ করি অনেকটাই অনাকাঙ্খিত এই ঝড় তৃণমূলের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকা কর্মীদের জন্য ‘অশনিঝড়’। এ দিকে সরকার থেকেও ঘোষণা করা হচ্ছে আগামী ডিসেম্বর নাগাদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে। এতেও কেউ কেউ সন্দিহান। কারণও অনেকটা স্পষ্ট। রাজনীতিকদের দ্বিচারিতা। তাদের একেক সময় একেক ধরনের বয়ান। কখনো সংস্কারের কথা বলে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া। আবার কখনো প্রয়োজনীয় সংস্কারের দাবী জোরালো করা। আবার যাদের ভোটের মাঠে অতিশয় দূর্বল বলে ভাবা হচ্ছে তারাই আবার প্রার্থী চূড়ান্ত করে ঘোষণা দিতেও শুরু করেছে। অন্যদিকে ভোটের রাজনীতিতে অপেক্ষাকৃত বড় দল বিএনপি ভোটের বিকল্প কিছুই ভাবছে না। তাদের দাবী প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচন। আবার নেতাদের একেক কথাও পরিষ্কার যথাসময়ে ভোট অনুষ্ঠান হওয়া নিয়ে। এদিকে ভোটের মাঠে যোগ বিয়োগ গুন ভাগের যে সমীকরণ এতে করে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের আরেকটি কমিটি, জাতীয় নাগরিক কমিটিও রাজনৈতিক দল গঠন তথা আত্মপ্রকাশ নিয়ে ঘোষণা দিতেই যদিও বিএনপি স্বাগত জানিয়েছে তথাপিও সতর্ক উচ্চারণে বলেছে সরকারে থেকে কেউ রাজনৈতিক দল গঠন করলে জনগণ ভালোভাবে নিবে না। মূলতঃ জনগণের দোহাই দিয়ে নিজেদের অভিব্যক্তিই প্রকাশ করেছে দলটি। যদিও অভ্যুত্থান পরবর্তী তারা যথেষ্ট চাঙ্গা থাকলেও এখন এই ঘোরচক্র সময়ে কিছুটা হলেও আতিশয্যে ভাটা পড়তে শুরু করেছে। আবার জামায়াত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের জোট গঠন করে চমকে দিতে চাইলেও কতটুকু সক্ষমতা রয়েছে তা নিয়েও বোদ্ধামহল তথা অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোও যথেষ্ট সন্দিহান। আবার ছন্নছাড়া আওয়ামী লীগ থেকে বলা হচ্ছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটি, এবি পার্টিসহ আরো কিছু দল মূলতঃ জামায়াতের বি টীম হয়েই মাঠে রয়েছে। আর যদি ছাত্রদের দল জামায়াতের সাথে ভোটের জোট করে সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সে অভিযোগ নেহাৎই উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই বলেও অনেকেই তেমনটা মনে করছেন। সর্বোপরি সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে আহ্বান করা হচ্ছে মব থামাতে। চলছে অপারেশন ডেভিল হান্ট। চলছে গ্রেপ্তার। নির্বাচনী আয়োজন। তথাপিও রাষ্ট্রীয় যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে কেউ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকটাও দেখতে হবে। কথায় আছে ছোটবেলায় পুকুরে ব্যাঙ দেখে বাচ্চাদের ঢিল ছোঁড়ার আনন্দে যেন ব্যাঙের পরিবারে বিষাদের ছায়া না নেমে আসে! ডেভিল বলা হোক আর সন্ত্রাসী বলা হোক নিরীহ লোক গ্রেপ্তার করে বাহবা না কুড়িয়ে সংখ্যা কম হোক তবু যথাযথ হোক। সেটাই কাম্য। আরো উদ্বেগ ভর করেছে দেশের সাজাপ্রাপ্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের জামিন এবং খালাস ও খালাসের প্রক্রিয়ায়। তেমন দৃষ্টান্ত না হোক যা ভবিষ্যতে নিজের বিরুদ্ধে যায়! লেখক: অ্যাডভোকেট, কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই ও আমাদের করণীয়
প্রতি বছর ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ক্যান্সার দিবস পালিত হয়। যার মূল লক্ষ্য ক্যান্সার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন নিশ্চিত করা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং বিভিন্ন ক্যান্সার গবেষণা সংস্থা এই দিবসকে কেন্দ্র করে নানা কার্যক্রম পরিচালনা করে। যার মাধ্যমে ক্যান্সার প্রতিরোধ, নির্ণয় ও চিকিৎসার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়।ক্যান্সার বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, প্রতি বছর প্রায় ১০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এবং এর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ক্যান্সারের সবচেয়ে সাধারণ ধরনগুলোর মধ্যে রয়েছে ফুসফুস ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার, অন্ত্র ক্যান্সার ও প্রোস্টেট ক্যান্সার।গবেষণায় দেখা গেছে, শতকরা ৮০% ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভব যদি আমরা সচেতন হই এবং সঠিক জীবনযাত্রা অনুসরণ করি। ক্যান্সারের বিভিন্ন কারণ রয়েছে যার মধ্যে কিছু প্রতিরোধযোগ্য। জেনেটিক কারণ ছাড়াও জীবনযাত্রার ধরন, খাদ্যাভ্যাস, পরিবেশগত দূষণ, ধূমপান ও অ্যালকোহল সেবন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। ক্যান্সার প্রতিরোধেসঠিক পুষ্টি ও ভিটামিন গ্রহণ ছাড়া কোন বিকল্প নেই।শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত ভিটামিন ও মিনারেল প্রয়োজন।বিশেষ করে ভিটামিন ডি, বি১, বি১২ এবং থার্টিন শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।প্রতিদিন অন্তত ১০-১৫ মিনিট সকালে রোদে থাকা উচিত যা শরীরে ভিটামিন ডি উৎপাদনে সহায়তা করে। রাসায়নিক ও কেমিক্যালযুক্ত খাবার পরিহার করতে হবে।ভেজালমুক্ত ও অর্গানিক খাবারের প্রতি মনোযোগী হতে হবে।অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকযুক্ত খাদ্যদ্রব্য পরিহার করা জরুরি। প্রায় ৩০-৫০% ক্যান্সার প্রতিরোধযোগ্য, যদি আমরা কিছু স্বাস্থ্যকর অভ্যাস মেনে চলি।বেশি পরিমাণে শাকসবজি, ফলমূল, আঁশযুক্ত খাবার এবং কম চর্বিযুক্ত প্রোটিন গ্রহণ ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ধূমপান ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান কারণ।শতকরা প্রায় ৪০% ক্যান্সার ধূমপান ও বায়ু দূষণের কারণে হয়।তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের ফলে ফুসফুস, মুখগহ্বর, গলা ও পাকস্থলীর ক্যান্সারের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। ক্যান্সার থেকে বাঁচতে হলেধূমপান ও অ্যালকোহল বর্জন করতে হবে। ধূমপান পরিহার করলে এবং দূষিত বাতাস থেকে দূরে থাকলে ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।মোবাইল ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইসের অতিরিক্ত আসক্তি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।প্রয়োজনের বাইরে অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম এড়ানো উচিত।বাসা-বাড়িতে মশার কয়েল ও ক্ষতিকর কেমিক্যালযুক্ত স্প্রে কম ব্যবহার করতে হবে।বায়ু দূষণ ও অন্যান্য পরিবেশগত দূষণ ৩৫% ক্যান্সারের জন্য দায়ী। দৈনিক অন্তত ৩০ মিনিট শারীরিক পরিশ্রম করলে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে। স্থূলতা অনেক ধরনের ক্যান্সারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্ত করা গেলে চিকিৎসার সফলতার হার অনেক বেশি থাকে। তাই নিয়মিত মেডিকেল চেকআপ করা জরুরি।বর্তমানে ক্যান্সার চিকিৎসায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। ইমিউনোথেরাপি, কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন থেরাপি ও জেনেটিক থেরাপির মাধ্যমে এখন ক্যান্সার চিকিৎসা অনেক বেশি উন্নত হয়েছে। তবে ক্যান্সারের নিরাময় এবং উন্নত চিকিৎসা সবার জন্য সহজলভ্য করা এখনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখার মাধ্যমে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।ক্যান্সার প্রতিরোধে সচেতনতার বিকল্প নেই। আমরা যদি নিজেরা সচেতন হই এবং পরিবার ও আশপাশের সবাইকে সচেতন করি, তাহলে এই মরণব্যাধি থেকে বাঁচতে পারব।এই বিশ্ব ক্যান্সার দিবসে আসুন আমরা প্রত্যেকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই—ক্যান্সার সম্পর্কে জানব, সচেতন হব এবং অন্যদেরও সচেতন করব। লেখক : সৈয়দ হুমায়ুন কবিরক্যান্সার গবেষক ও সভাপতি ওয়ার্ল্ড ক্যান্সার সোসাইটি বাংলাদেশ।

বিশ্বায়নের নতুন রূপ ও জলবায়ু পরিবর্তন
আফতাব চৌধুরী: একবিংশ শতাব্দীতেও বিশ্বায়নের সংজ্ঞা নিয়ে সমাজ চিন্তাবিদদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। বিশ্বায়ন কি ধনতান্ত্রিক সমাজের বিশ্বব্যাপী আগ্রাসন? অথবা ম্যাকডোনা লাইজেশন, নাকি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন? কেউ কেউ আবার সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ, বিশ্ব-বৈশ্বিক গ্রাম এসব প্রপঞ্চ দিয়েও ব্যাখ্যা করেছেন বিশ্বায়নকে। বিশ্বায়ন একটি পুরনো প্রত্যয় এবং শুধু পশ্চিমাকরণ নয়। বিশ্বায়নের ঢেউয়ের ধারাবাহিকতায় জ্ঞানের বিকাশ, ধর্মের প্রসার, মানুষ, পণ্য, প্রযুক্তি ও ভাষার গতিশীলতা ঊনবিংশ শতাব্দীর বহু আগেই শুরু হয়েছে। যেমন সীমান্ত ছাড়িয়ে ইন্দোনেশিয়া অথবা চীনে ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটে। অথবা ইংরেজি সার্বজনীন ভাষায় পরিণত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে আধুনিক রাষ্ট্র, অলিম্পিক, আন্তর্জাতিক সম্মেলন তথ্য প্রযুক্তি ইউরোপের বাইরে প্রসারিত হতে তাকে। আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাংক এ সময়েও বলেছেন, ‘বিশ্বায়নের কেন্দ্র ছিল চীন ও ভারত।’ বিশ্বায়নের ইতিবাচক দিক হিসেবে বিভিন্ন অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, দারিদ্র উপশম-নিরসন ও আধুনিক প্রযুক্তির প্রসারকে ইঙ্গিত করা হয়। আর এর নেতিবাচক দিকগুলোর উল্লেখ বহু পুরনো ও প্রতিষ্ঠিত- সেগুলো হল সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতা, দাসত্ব, সমাজে চরম অসমতা সৃষ্টি। তবে একবিংশ শতাব্দীতে এসে পশ্চিমা বিশ্বের একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব হতে দেখা যায়। উদ্ভব হয় বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর। বাজার ব্যবসায়ের নতুন মাত্রা ব্রাজিল, রাশিয়া ও চীনের মত দেশগুলোকে শক্তিশালী করে তোলে। উত্তর আধুনিকতাবাদী তাত্ত্বিকদের অনেকেই তাই নতুন করে সমাজ সম্পর্কে তত্ত্ব দিতে শুরুকরেন। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকেও এ সময়ে ছাড়িয়ে যাচ্ছে প্রযুক্তিনির্ভর প্রচার মাধ্যম। আর এর মাধ্যমে বিভিন্ন আদর্শ ও মতবাদ পুরো বিশ্বকে জয় করে নিচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে যেসব সংকট তৈরি হচ্ছে, তার পেছনে কোন বিশ্বযুদ্ধ নেই বা তা সমাধানের জন্য কোন একক শক্তি নেই; বরং সব নিয়ন্ত্রণ করছে প্রযুক্তি ও প্রচারনির্ভর বাজার ব্যবস্থা। সংকট নিরসনে রাষ্ট্র যেন আর নিজের অবস্থানে থাকতে পারছে না। বিশ্ব একটি প্রাচীন প্রক্রিয়া ও তার কিছু সুফলও আছে। কিন্তু একটি রাষ্ট্র ও নাগরিকদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব যে বিশ্বায়নের ফলে হুমকির মুখে পড়েছে, সে প্রশ্ন কি আজও আমাদের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে না? একটি দুর্বল রাষ্ট্রের নীতিমালা বা প্রতিশ্রুতি পূরণ নির্ভর করছে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ রাষ্ট্রগুলোর উপর- তারা আমেরিকা, লাতিন আমেরিকা, চীন, জাপান যে-ই হোক না কেন। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দেশগুলোর নিজস্ব বাজার ব্যবস্থা পরাজিত হয় বিদেশী বিনিয়োগের কাছে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য শিল্পের উপরই নির্ভর করতে হয় অথবা বড়জোর নির্ভর করতে হয় মানবসম্পদের উপর। বর্তমান বিশ্বায়ন তাই একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ডের রাজনৈতিক শক্তি ও অনুপস্থিত অর্থনৈতিক শক্তির মাঝে ক্ষমতার খেলা। সে খেলা বস্তুত জন্ম দেয় অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকির রাজনৈতিক অর্থনীতি। বিশ্বায়নের মাধ্যমে ছড়িয়ে যাওয়া প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানব সমাজ নিজেকে আধুনিক প্রমাণ করেছে হয়তো বা কিন্তু প্রানহীন করেছে অন্যান্য প্রজাতি ও জীববৈচিত্র্যকে। পরিবেশগত, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিজীবনের বিচ্ছিন্নতা প্রযুক্তিকেন্দ্রিকতার সরাসরি ফল। জলবায়ু পরিবর্তন ও এর ফলে বিভিন্ন দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দুর্বল দেশগুলো। কোপেনহেগেনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এটি যেমন স্বীকার করা হয়েছে, তেমনি এশীয় দেশগুলো যে সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়বে তাও তুলে ধরা হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ কার্বন নির্গমনকারী দেশগুলোর মত আমরা নিজেরাও জানি না, সম্পদ উৎপাদন ও ব্যবহার ঝুঁকিকেও সামাজিকভাবে উৎপাদন করছে। বিশ্বায়নের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে উত্তর আধুনিকতাবাদী তাত্ত্বিকদের প্রচার মাধ্যমকে সবচেয়ে শক্তিশালী হিসাবে দেখানোকে তখনই সাধুবাদ দেওয়া যাবে যখন প্রচার মাধ্যম এ ঝুঁকিগুলোকে বিশ্বব্যাপী প্রচার ও তা নিরসনে ব্যাপক সহায়তা করবে। সার্বভৌম রাষ্ট্রকে তার নিজের অবস্থান ফিরিয়ে আনতে এ মাধ্যমই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে পারে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও ভোগবিলাসী জীবনে এ উপমহাদেশের অধিকাংশ দরিদ্র মানুষের অংশগ্রহণ নেই- কার্বন নির্গমনের হার শূন্যের কোঠায়- তবু কেন তারাই জলবায়ু পরিবর্তন বা পরিবেশ অবক্ষয়ের জন্য সবচেয়ে বেশী মূল্য দিবে? সনাতনী ঢঙে পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ বা পশ্চিমা শক্তিকে মোকাবিলা করতে না- পারলেও নিজেদের জ্ঞান দিয়ে নিজেদের দুর্যোগকে তো আমরা মোকাবিলা করেছি। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতিপূরণের জন্য যেখানে কোপেনহেগেনে কার্যকর অংশগ্রহণ করেও কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায়নি, সেখানে রাজপথে দাঁড়িয়ে নদী বাঁচাও, পলিথিন ব্যবহার বন্ধ, টু স্ট্রোকবিশিষ্ট ইঞ্জিন বন্ধ, বিষাক্ত রাসায়নিক সার বা দ্রব্য আমদানী বন্ধ করতে তো মানুষ সাফল্য পেয়েছে। তাই, বিশ্বায়নের আগ্রাসী ভাব রুখতে হলে সম্মিলিত সামাজিক শক্তির কোন বিকল্প নেই। প্রযুক্তি ব্যবহারের নীতিমালা, পরিবেশবান্দব প্রযুক্তি গ্রহণ করা না করা সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ আরো কার্যকরভাবে থাকা জরুরি। নতুন করে ভাবতে হবে। যুদ্ধের সময় যখন পশ্চিমা দেশসহ প্রায় সারা বিশ্বের মানুষ ও প্রচার মাধ্যম পাশে এসে দাঁড়ায়, মানবাধিকার লঙ্ঘন হলে যখন ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’ কথা বলে- সেখানে রাজনৈতিক অর্থনীতি ততটা অনুপ্রেরণা দেয় না। যতটা দেয় মানবিকতাবোধ। এসব ভূমিকাও বিম্বায়নের সংজ্ঞায় পড়ে, তাই ঝুঁকিপূর্ণ পৃথিবী ও সমাজকে ঝুঁকিমুক্ত করে বাসযোগ্য করার জন্য প্রয়োজন বর্তমান বিশ্বের গতি-প্রকৃতিকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করা। লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

দ্বৈত নাগরিকদের রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো যাবে না
মো. মনিরুজ্জামান মনির: আপনার এক পা বাংলাদেশে। আরেক পা ব্রিটেন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রে, কানাডা, ভারত কিংবা অন্য কোন উন্নত দেশে। আপনি বাংলাদেশকে টাকা কামানোর স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছেন। চুরি-বাটপারি, ঘুষ-দুর্নীতি, অবৈধ বাণিজ্য, নোংরা হাতে লুটপাট করে ওই সব দেশে টাকা পাচার করেছেন। গড়ে তুলছেন সম্পদের পাহাড়। আপনার কাছে জাতি কী প্রত্যাশা করতে পারে? আপনি কিই-বা দিতে পারেন? নিঃসন্দেহে বলা যায়, দেওয়ার মতো আপনার কাছে কিছুই নেই! কারণ আপনি যে-দেশের আলো-বাতাসে বড় হয়েছেন; খাবার খেয়েছেন; শুধু মোহের কারণে সেই দেশের সাথে প্রতারণা করছেন। আপনাকে জাতির কুলাঙ্গার বললে অত্যুক্তি হবে না বৈ কি! বলছিলাম দেশের নিয়ম ভেঙে যারা দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন; আমলা, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী হয়েছেন; অর্থ পাচার করেছেন- তাদের কথা। বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করলে বা বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করলে তিনি সাংসদ বা মন্ত্রী হতে পারেন না। সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন এ বিষয়ে বলেন, ‘বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে, এমন কোনো ব্যক্তির সাংসদ নির্বাচিত হওয়া বা মন্ত্রিত্ব লাভের সুযোগ নেই। তথ্য গোপন করে যদি এ কাজ হয়ে থাকে, তাহলে আইন ও সংবিধান পরিপন্থী কাজ হয়েছে।’ সংবাদ মাধ্যম বলছে, ‘ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান গোপনে সাইপ্রাসের নাগরিকত্ব নিয়েছিলেন। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের ‘রেসিডেন্স কার্ড’ রয়েছে বেলজিয়ামের। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যুক্তরাজ্যের নাগরিক; সাবেক দুই প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ও জুনাইদ আহম্মেদের যুক্তরাষ্ট্রে থাকার ‘গ্রিন কার্ড’ (বৈধ অনুমতি) রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন মেয়াদে মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও সাংসদ ছিলেন- এমন ২৪ জনের দ্বৈত নাগরিকত্ব (রেসিডেন্স কার্ড বা গ্রিন কার্ড) থাকার সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বিদেশি নাগরিকত্ব পেতে হলে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কোনো কোনো দেশে রেসিডেন্স কার্ড বা গ্রিন কার্ড পাওয়ার পরের ধাপে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। সাবেক পাঁচজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর নাগরিকত্ব রয়েছে যুক্তরাজ্যে। তারা হলেন আ হ ম মুস্তফা কামাল, মো. তাজুল ইসলাম, সাইফুজ্জামান চৌধুরী, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও মো. মাহবুব আলী। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব বা গ্রিন কার্ড রয়েছে সাবেক চারজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ সাতজন সাবেক সাংসদের। তারা হলেন আব্দুস শহীদ, নসরুল হামিদ, জুনাইদ আহম্মেদ, মোহাম্মদ আলী আরাফাত, আবদুস সোবহান মিয়া গোলাপ, মাহফুজুর রহমান ও সালাউদ্দিন মাহমুদ জাহিদ। কানাডার নাগরিকত্ব রয়েছে এমন ছয়জনের নাম পেয়েছে দুদক। তাদের মধ্যে একজন সাবেক মন্ত্রী, অন্যরা সাবেক সাংসদ। এর মধ্যে রয়েছেন আবদুর রহমান, মাহবুব উল আলম হানিফ, আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম, শামীম ওসমান, শফিকুল ইসলাম শিমুল ও হাবিব হাসান। সুইজারল্যান্ডের নাগরিকত্ব রয়েছে সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের এবং জাপানে থাকার অনুমতি (রেসিডেন্স কার্ড) রয়েছে সাবেক রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিমের। সাবেক সাংসদ (টাঙ্গাইল-২ আসন) তানভীর হাসান ওরফে ছোট মনির জার্মানির নাগরিক এবং সাবেক সাংসদ (ময়মনসিংহ-১১) এমএ ওয়াহেদ পাপুয়া নিউগিনির নাগরিকত্ব নিয়েছেন। বিএনপি-জাপার কী অবস্থা: বিএনপি রাষ্ট্র ক্ষমতায় নেই ১৮ বছর। এর আগে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে তিন বার দলটি সরকার গঠন করে। দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বেও দলটি সরকার গঠন করেছিল। এর বাইরে প্রায় সব সংসদে তাদের দলের প্রতিনিধি ছিলেন। তাদের কেউ কি বিদেশি নাগরিকত্ব গোপন করে এমপি-মন্ত্রী হয়েছিলেন কি না; সেটাও পরিষ্কার করা দরকার। অন্যদিকে, দেশের আরেকটি বড় দল জাতীয় পার্টি। এই দলটি প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে টানা ৯ বছর দেশ শাসন করেছিল। এর বাইরে তারা সব সময় সরকারের কাছাকাছি থেকে ক্ষমতা ভোগ করেছে। তাদের দলের নেতারা এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন। তাদের কেউ বিদেশি নাগরিক কি না- সেই প্রশ্ন উঠেছে। দলটির বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদের বিদেশি নাগরিক বলে কিছু দিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়। যদিও এটা সত্য কিনা, তা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। আশা করি, জাতীয় পার্টি একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে বিষয়টি খোলাসা করবে। আর যদি সেটা তারা না করে, তাহলে ‘সন্দেহ’ বা অপপ্রচার আরও ঘনিভূত হবে। মনে রাখতে হবে অপরাধ কখনো চাপা থাকে না। এটা প্রকাশ পায়- আজ নয়তো কাল। আর তখন সেটা ইতিহাসের কালো অধ্যায় হয়ে থাকে। বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত কিংবা অন্য কোনও দলের নেতা দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন কি না; দুদককে সেই বিষয়টিও তদন্ত করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারে দ্বৈত নাগরিক আছে কি না: বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে যারা আছেন; তাদের কারো বিদেশি নাগরিকত্ব আছে কি না; তা প্রকাশ করা জরুরি। আশা করি, তারা নিজেরাই বিষয়টি খোলা করবেন। যদি তাদের কারো বিদেশি নাগরিকত্ব থেকে থাকে; তাহলে তিনি-তারা সংবিধান ভায়োলেট করে শপথ নিয়েছেন। তার বা তাদের উচিত পদত্যাগ করা। অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস জার্মানির নাগরিক বলে গুঞ্জন রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি পরিষ্কার করা দরকার। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলছেন, ‘বিগত আওয়ামী লীগ সরকার দেশ পরিচালনা করার ক্ষেত্রে আইনকানুন, বিধিবিধান ও নৈতিকতার তোয়াক্কা করত না। এই সরকার অবশ্যই নিয়ম মেনে দেশ পরিচালনা করবে- এটাই দেশের মানুষ প্রত্যাশা করছে।’ বিদেশে সম্পদের পাহাড়: সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী আবদুস সোবহান গোলাপের পরিবারের যুক্তরাষ্ট্রে একাধিক ফ্ল্যাট বা বাড়ি রয়েছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট (ওসিসিআরপি) তাদের ওয়েবসাইটে গত বছরের জানুয়ারি মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ২০১৪ সালে প্রথম নিউইয়র্কে অ্যাপার্টমেন্ট কেনা শুরু করেন গোলাপ। পরের পাঁচ বছরে তিনি নিউইয়র্কে একে একে ৯টি প্রপার্টি বা সম্পত্তির (ফ্ল্যাট বা বাড়ি) মালিক হন। এসব সম্পত্তির মূল্য ৪০ লাখ ডলারের বেশি (ডলারের বর্তমান বিনিময় মূল্য অনুযায়ী প্রায় ৪২ কোটি টাকা)। সালমান এফ রহমানের সাইপ্রাসের নাগরিকত্ব থাকলেও তার ‘বাগানবাড়ি’ যুক্তরাজ্যে। সেখানে তার চারটি বাড়ি রয়েছে। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ২০১৬-২০২১ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও আরব আমিরাতে ৬২০টি বাড়ি কিনেছেন; যার বাজারমূল্য প্রায় ৪৮ কোটি ডলার (প্রায় ৫ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা)। গত ৩১ অক্টোবর গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি উল্লেখ করেছে সিআইডি। এর আগেই গত সেপ্টেম্বর মাসে এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে আল-জাজিরার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট যুক্তরাজ্যে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিপুল সম্পদ থাকার বিষয়টি তুলে ধরে। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের বাড়ি রয়েছে লন্ডনে। তার এক মেয়ে আগে থেকেই লন্ডনে থাকেন। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা শামীম ওসমান কানাডার নাগরিক। দেশটির টরন্টো শহরে তার বাড়ি রয়েছে। এ ছাড়া দুবাইয়ের আজমান শহরে তার আরেকটি বাড়ি রয়েছে। কানাডায় বাড়ি, ব্যবসাসহ বিপুল সম্পদ রয়েছে ফেনীর সাবেক সাংসদ আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর নাসিম। তার মেয়ে কানাডায় থাকেন। যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি রয়েছে মানিকগঞ্জের সাবেক সাংসদ সালাহউদ্দিন মাহমুদ জাহিদের। তার মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। নাটোরের সাবেক সাংসদ শফিকুলের বাড়ি রয়েছে কানাডার টরন্টোর নিকটবর্তী স্কারবরো শহরে। গত বছরের শুরুতে বাড়িটি কেনা হয়। সাংসদদের ঘনিষ্ঠ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, ‘বাড়িটি কিনতে ১৭ লাখের বেশি কানাডিয়ান ডলার খরচ হয়েছে। বাংলাদেশি টাকায় যা প্রায় ১২ কোটি টাকা।’ এ ছাড়া, সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ও তার ছেলের নামে দুবাইয়ে বড় ধরনের বিনিয়োগ থাকার বিষয়টি জানতে পেরেছে দুদক। অনুসন্ধানে যুক্ত দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ‘সাবেক মন্ত্রী ও সাংসদদের মধ্যে যাদের দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে, তাদের সবার বিদেশে বাড়ি-গাড়িসহ বিপুল সম্পদ থাকার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখছেন তারা। অনুসন্ধান শেষে দ্বৈত নাগরিকত্বসহ বিদেশে বাড়ি-বিনিয়োগ ও টাকা পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্য মামলায় উল্লেখ করা হবে।’ অর্থপাচার: ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান গত ২ নভেম্বর এক সেমিনারে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে মোট কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা সম্ভব নয়। ব্যাংকের মতো আনুষ্ঠানিক মাধ্যম ব্যবহার করে ১৭ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্থ পাচারের কথা জানা যায়। বিভিন্ন ঘটনার ভিত্তিতে ধারণা করা যায়, বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে ১২-১৫ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে ক্ষমতার বলয় প্রতিষ্ঠা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দখলের মাধ্যমে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ পাচার করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে রাজনীতি, আমলাতন্ত্র ও ব্যবসা- এই ত্রিমুখী আঁতাত মৌলিক ভূমিকা পালন করেছে। সব প্রতিষ্ঠানেই দীর্ঘ সময় ধরে দলীয়করণের চর্চা হয়েছে; গত ১৫-১৬ বছরে যার চূড়ান্ত রূপ আমরা দেখেছি। এতে আমলাতন্ত্রকে কর্তৃত্ব দিয়েছে রাজনৈতিক শক্তি আর তা বাস্তবায়নে ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন এজেন্সিকে। ফলে, এসব জায়গায় কতটুকু পরিবর্তন আনা যাবে, তা গুরুত্বপূর্ণ। যে পরিবর্তন আসবে বলে আমরা আশা করছি, তা যেন টেকসই হয়।’ যারা টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন। তিনি বলেছেন, ‘বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে।’ আমরা আশা করব, দুদক যেন কেবল আশ্বাসই না দেয়। সেটার বাস্তব প্রতিফলনও ঘটাতে হবে। বেগমপাড়া: কানাডার প্রধান নগরী টরন্টো। এটি কানাডায় বাংলাদেশি অভিবাসীদের সবচেয়ে প্রিয় আবাসস্থল। সেখানে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের সংখ্যা পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এটি ‘বেগমপাড়া’ নামে বাংলাদেশিদের কাছে ব্যাপক পরিচিত। তবে বেগমপাড়া বলে সেখানে কোন স্থানের নাম নেই। এটি কেবলই মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়া একটি নাম। সেখানে বাংলাদেশি প্রাসাদসম বিপুল সংখ্যক বাড়ি রয়েছে। টরন্টো নগরীর বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় এবং টরন্টোর আশপাশের ছোট ছোট শহর মিসিসওগা, হ্যামিল্টন, গুয়েল্ফ ও অন্টারিও লেকের পাড়ঘেঁষা উপশহরগুলোর প্রাসাদসম অট্টালিকা বা ‘লেকশোর অ্যাপার্টমেন্ট’ ক্রয় করে গড়ে তোলা হয়েছে বাংলাদেশি ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বেগমপাড়া। এসব বাড়ি কিংবা অ্যাপার্টমেন্ট সাধারণ কানাডীয় নাগরিক কিংবা কানাডায় বসবাসরত বাংলাদেশি অভিবাসীদের ক্রয়ক্ষমতার আওতায় থাকা বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট নয়। এগুলোর দাম প্রায় ১ মিলিয়ন ডলার (১০ কোটি টাকার সমমূল্যের) থেকে শুরু করে ২-৩ মিলিয়ন ডলার (২০-৩০ কোটি টাকার সমমূল্যের) হয়ে থাকে। মূলত দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক, আমলা, সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার করে নিয়ে কানাডায় এসব বাড়ি কিনেছেন। তাদের অধিকাংশ গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে সে-দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন। বাংলাদেশে মাল কামানো (টাকা লুটপাট) শেষ হলে একটা সময় তারা উড়াল দেবেন সেখানে। বিতর্কিত ক্রিসেন্ট, বিসমিল্লাহ এবং বেক্সিমকো গ্রুপসহ ঢাকা ও চট্টগ্রামের চল্লিশটি প্রতিষ্ঠান গত এক দশকে রপ্তানি আয় থেকে উপার্জিত ৫৮৮ মিলিয়ন ডলার দেশে আনেনি। ঢাকাভিত্তিক শীর্ষ ২০টি প্রতিষ্ঠান ৫৫৯ মিলিয়ন ডলার এবং চট্টগ্রামভিত্তিক শীর্ষ ২০টি প্রতিষ্ঠান প্রায় ৩০ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় দেশে আনেনি। সব মিলিয়ে এই ৪০টি প্রতিষ্ঠান এখনো প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা দেশে ফিরিয়ে আনতে পারেনি বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এসব আমলা, উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দুদক তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে বলে আশাকরি। এস আলম ও আজিজ খান: বিতর্কিত শিল্পগোষ্ঠী এস আলম। বাংলাদেশে ভোজ্যতেল আমদানি থেকে পাওয়ার প্ল্যান্ট- সবই আছে এই গ্রুপের। তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে অনেক বেসরকারি ব্যাংক। তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা আটটি ব্যাংকের মধ্যে চারটি ব্যাংক থেকে ঋণের নামে লুট করেছে এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ধনকুবের ও ব্যবসায়ীরা ব্যাংকখাত থেকে প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছেন। এর মধ্যে কেবল এস আলম-ই অন্তত ১০ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছেন। বিতর্কিত এই শিল্পপতি বাংলাদেশের পাশাপাশি সিঙ্গাপুরের নাগরিক ছিলেন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর তিনি বাংলাদেশের নাগরিত্ব ত্যাগ করেছেন। অর্থাৎ তিনি এখন সিঙ্গাপুরের নাগরিক। ব্যবসার নামে তিনি যে লুটপাট করেছেন; হয়তো সেই অপরাধের বিচার আর করা যাবে না। অন্যদিকে, দীর্ঘদিন ধরেই স্থায়ী নিবাসী (পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট) হিসেবে সিঙ্গাপুরে বসবাস করে আসছেন সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান। সম্প্রতি তিনি সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। দেশটির আইনে দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ না থাকায় আজিজ খানকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে হয়েছে। সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ৫০ ধনীর তালিকায় আজিজ খান রয়েছেন। আজিজ খান ১৯৮৮ সাল থেকে সিঙ্গাপুরে স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে বসবাস করছেন এবং ২০১৬ সালে সামিটের প্রধান কার্যালয় সিঙ্গাপুরে স্থানান্তর করেন। বর্তমানে তার সম্পদের পরিমাণ ১১০ কোটি ডলার। সামিট গ্রুপ বাংলাদেশে জ্বালানি- বিশেষ করে বিদ্যুৎখাতের বড় ব্যবসায়ী। তার ভাই কর্নেল (অব.) ফারুক আওয়ামী লীগের নেতা এবং সাবেক মন্ত্রী। বিগত সরকারের সময় এই গ্রুপ বিভিন্নভাবে সরকারের আনুকূল্য পেয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি: বিদেশি নাগরিকত্ব নিয়ে যারা দেশে মন্ত্রী-সাংসদ হয়েছে; তারা প্রতারক। তারা এদেশের মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। তাদের শপথ গ্রহণই ছিল অবৈধ। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, ক্ষমতার অপব্যবহার ও বিচারহীনতার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। তথ্য গোপন ও প্রতারণা করা ওই সব প্রভাবশালীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি। তাদের অনেকে পালিয়ে বিদেশে চলে গেছেন। আবার অনেকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। যারা কারাগারে আছেন; তাদের বিচার করাটা হয়তো সহজ। আর যারা বিদেশে পালিয়ে গেছেন; তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। যেসব রাজনীতিক, আমলা ও ব্যবসায়ী অর্থপাচার করেছেন তাদের ছবিসহ সংবাদ প্রচার করতে হবে। এতে মানুষ তাদের আসল চেহারাটা দেখতে পাবে। লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি।

বৈষম্যহীন নতুন বছর ২০২৫
আবছার উদ্দিন অলি: নতুন বাংলাদেশে, নতুন আশা, নতুন ভালোবাসা নিয়ে এসেছে নতুন বছর ২০২৫ সাল। বছরের শুরুতেই নির্বাচনী আমেজ বিরাজ করছে। নোবেল জয়ী মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে। তাই, এবারের নতুন বছরটি এ দেশের মানুষের জন্য ভিন্ন আমেজের বার্তা নিয়ে আসছে। সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনমুখী। দিন শেষে আয়-ব্যয়ের হিসেব নিয়েই আমরা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। ২৪’র বিপ্লবের মাধ্যমে মানুষ আবার কথা বলার স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছে। এসেছে নতুন বছর, নতুন দিনের শপথে। তরুণ প্রজন্মই বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবে। তরুণরা বাংলাদেশকে নতুন করে পথ দেখিয়েছে। অর্থনীতিসহ সবকিছুতেই তরুণরা নেতৃত্বে আসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। যে প্রজন্ম জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছে, সেই প্রজন্মই বাংলাদেশের সর্বক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবে। তরুণদের নিয়ে শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়, সমগ্র পৃথিবী নতুন করে ভাবছে, আর অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। কারণ বাংলাদেশের তরুণরা জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পৃথিবীকে একটি নতুন পথ দেখিয়েছে। ফলে, এই তারুণ্য বাংলাদেশকে পরবর্তী কোথায় নিয়ে যাবে, পৃথিবী এখন সেটি দেখার অপেক্ষায় রয়েছে। তারুণ্যের ভিতরে যে উদ্যম, স্পৃহা, সচেতনতা রয়েছে, এসব গুণাবলীকে যদি কাজে লাগানো যায়, তাহলে বাংলাদেশ অবশ্যই কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছে যেতে পারবে। জুলাই অভ্যুত্থানে সকলেই রাস্তায় নেমে এসেছিল। এক দিকে, ছিল দেশ মাতৃকা, অপরদিকে মৃত্যু। মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু যে কোনো একটিকে বেছে নিয়ে আমাদের লড়তে হয়েছিল। প্রতিবাদী মানস আর পর্বতসম আত্মবিশ্বাস বুকে নিয়ে একটি বৈষম্যহীন, সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন দেখেছিল এ দেশের দুর্জয় তারুণ্য। যে স্বপ্নের সারথি হয়েছিল এ দেশের সাধারণ মানুষ। সাম্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে, অধিকার আদায়ের নির্ভীক সংগ্রামে শিক্ষার্থীদের সাথে ছুটে এসেছিল তাদের অভিভাবক, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, কারখানার শ্রমিক, দিনমজুর, এমনকি দিন এনে দিন খাওয়া মানুষটিও। তাদের সংগ্রাম ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, শোষণ, নির্যাতন আর বিচারহীনতার প্রতিবাদে। ছুটে চলেছি ঘর সংসার আর পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকার জীবন যুদ্ধের সংগ্রামে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ, ডলার সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দাভাব, মূল্যস্ফীতি, দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতিসহ নানা কারণে মানুষের জীবন-যাপন কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আয়ের সাথে ব্যয়ের বিরাট সামঞ্জস্য। সেই সাথে মধ্যবিত্তের সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে ২০২৫ সাল কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য আমাদেরকে প্রস্তুতি নিতে হবে। আমাদেরকে সব সমস্যাকে মোকাবিলা করে এই সময় কাটিয়ে নতুন আশা নতুন স্বপ্ন নিয়ে নতুন বছর ২০২৫ সাল। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত আসংখ্যাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দাভাব আর সেটাকে মাথায় রেখে আমাদের জীবন জীবিকা সচল রাখতে আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের দেওয়া সব নিয়মনীতি মেনে নতুন বছরে নতুন করে এগিয়ে যাবে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে। অনেক স্মৃতি জাগানিয়া ও আলোচিত বছর ছিল ২০২৪ সাল। ইংরেজী নববর্ষ উপলক্ষে নতুন সাজে সেজেছে চট্টগ্রাম। স্বাধীনতার পর এই প্রথম চট্টগ্রাম থেকে আমরা রাষ্ট্র প্রধান পেলাম। ড. মুহাম্মদ ইউনুস আমাদের সেই স্বপ্নের প্রত্যাশাটি পূরণ করেছেন। কথায় আছে যৎ কর্ম তৎ ফল। সুতরাং, এই ইংরেজী নববর্ষটি কি রকম হওয়া উচিত এই বিষয়ে নিছক কথার ফুলঝুরি না ছড়িয়ে আমার সব কর্মে বলনে চলনে দায়িত্ব পালনে আগামী দিনগুলোর প্রতিটি মুহুর্তকে সততার সাথে সৃজনশীল করে তুলতে চাই। গেল বছরের হিসেব খাতায়, যোগের চেয়ে বিয়োগের অংকটাই এখন বড়। সে যাই হোক আশা করি, নিরাশার দোলা চালেইতো জীবন চলে। মৃত্যুর আগ মুহুর্তে পর্যন্তইতো মানুষ আশায় বাঁচে। আমরাও মানুষ, তাই ক্ষেত্র বিশেষে অতীতের স্বীয় ব্যর্থতার গ্লানিকে পিছনে ঠেলে দিয়ে নতুন বছরের পথ পরিক্রমনে যাত্রাকালে চেনা এ পৃথিবীটার সবার জন্যে সুখ কামনায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এ ছাড়া, চৌচির কোন মাঠ ফসলের চৈতি ক্ষরায় কান্না কারো কোন দুঃখ ব্যাধি জ্বরায় নির্ঝর বারিধারা বিমূর্ত হাসি আশার একান্ত কাম্য। অনোদার যুদ্ধ বারুদের মানুষ মারায় নিত্য দিবারাত সন্ত্রাস জীবন পাড়ায় শান্তির প্রচ্ছায়া চিরায়ত খুশী আমাদের প্রানান্ত চাওয়া। দেশের মানুষ অস্থিতিশীল পরিবেশকে পেরিয়ে ভালোভাবে বেঁচে থাকুক এই প্রত্যাশা করি। নতুন কোন দূর্ঘটনায় আগুনে পুড়ে যাওয়া অসহায় মানুষদের কান্না আর দেখতে চাই না, বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো নতুন করে কারো প্রাণহানি ঘটুক, আমরা দেখতে চাই না, সড়ক দুর্ঘটনা, বাল্য বিবাহ, শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, ডিভোর্স, পারিবারিক কলহ, খুন, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, ইভটিজিং, মাদক সেবন, কিশোর গ্যাং, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অনলাইন প্রতারণা। আসুন সবাই মিলে নতুন বছরে নতুন করে সুন্দরভাবে বাঁচতে ঐক্যবদ্ধ হই। সুখে-দুঃখে একে অপরের পাশে দাঁড়াই। তবেই আমরা ফিরে পাব সেই “স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশ”। রাষ্ট্র কিংবা কোন দায়িত্বপূর্ণ ব্যক্তির অবহেলায় নতুন কোন দূর্ঘটনায় কোন মায়ের বুক যেন খালি না হয়, কোন স্ত্রী যেন স্বামী- সন্তান হারা না হয়। এই কামনা করি। নতুন বছরের সূর্যোদয়ের সোনালী আভায় লাখো গোলাপের সুভাসে আন্দোলিত হোক ১৬ কোটি বাঙালি। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যূত্থানে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা। আর যারা আহত হয়েছেন তাদের প্রতি রইল সমবেদনা আর ভালোবাসা। পুরোনকে বিদায় দিয়ে নতুনকে বরণ করে নেয়াই মানুষের সহজাত ধর্ম। আবহমান কাল ধরে মানুষ পুরাতনকে শুকনো ঝরা পাতার মত ত্যাগ করে নতুন কুঁড়ির উদগমন হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করে। ইংরেজী নতুন বছর ২০২৫-কে জানাই সাদর সম্ভাষণ। এক বুক অনাবিল আনন্দ নিয়ে স্বাগত জানাই নতুন বছরের নবীন প্রভাতের নবীন সূর্যকে। ২০২৫ সালে যেন সব বৈষম্যহীন পরিবেশকে পেছনে ফেলে কাঙ্খিত, মনোরম, ভালবাসায় এক গুচ্ছ প্রত্যাশা ও আশ্বাস কে খুঁজে পায় অনায়াসে। ইংরেজি নতুন বছর শুরুর দিন থেকে আশার আলোতে প্রত্যাশার পদধ্বনি বেজে উঠুক। সবকিছুর পরও সুখ শান্তির প্রত্যাশায় স্বাগত বৈষম্যহীন নতুন বছর ২০২৫ সাল। লেখক: সাংবাদিক ও গীতিকার

কেমন চাই গণমাধ্যমের সংস্কার
আহসান কামরুল: জুলাই গণঅভ্যুত্থানের তোড়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পলায়নের পরপরই দেশের সংবাদমাধ্যমের ওপর নজিরবিহীন হামলা হয়েছে। এটি ছিল সংবাদমাধ্যমের ওপর জনতার চরম ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। সংবাদমাধ্যমকে এমন টার্গেট করা ঠিক হয়েছে কিনা, সেটি ভিন্ন আলোচনা। কিন্তু সংবাদমাধ্যম কেন এমন টার্গেট হলো? স্বৈরাচারের ১৫ বছরে মিডিয়া কি কখনও গণমাধ্যম হওয়ার চেষ্টা করেছে? নাকি শুধু সংবাদমাধ্যম হিসেবেই ক্ষমতাসীনদের ফুট-ফরমায়েশ খেটেছে? বড়দাগে বলতে গেলে দু’চারটি মিডিয়া হাউজ ব্যতীত অন্য কেউই গণমাধ্যম হওয়ার ন্যূনতম চেষ্টা করেনি। এরা বরং নিজে থেকে যেচে গিয়ে ফুট-ফরমায়েশ খেটে গৌরববোধ করেছে। এ কারণে তারা গণমানুষ থেকে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রতিপক্ষে রূপ নেওয়ার কারণেই শেখ হাসিনার পলায়নের পর ওই ক্ষোভ গিয়ে উগড়ে পড়েছে মিডিয়া হাউজগুলোর ওপর। বিক্ষুব্ধ জনতা একের পর এক ভেঙেছে সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়। এটি বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের ইতিহাসের জন্যও একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে। একইসাথে সংবাদমাধ্যম সংশ্লিষ্টদের জন্যও শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে যে, ভবিষ্যতে তারা গণমাধ্যম হিসেবে সাংবাদিকতা করবে নাকি ফুট-ফরমায়েশি করে আবারও কোনো পালাবদলে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হবে। শেখ হাসিনার পলায়নের পর অন্তবর্তী সরকার গঠন হলে দেশের বিভিন্ন খাতে সংস্কারের দাবি ওঠে। গণআন্দোলনের সময়ও এটি ছিল আন্দোলনকারীদের অন্যতম দাবি ও কমিটমেন্ট। এর পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি সংস্কার কমিশনও গঠন হয়েছে, যার মধ্যে ‘গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন’ও অন্যতম। জুলাই গণআন্দোলনে মিডিয়ার যে ভ‚মিকা ছিল তা অবশ্যই নিন্দনীয়। ধারাবাহিকভাবে আন্দোলনকারীদেরকে তৎকালীন সরকারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ‘দুর্বৃত্ত, নাশকতাকারী’ ইত্যাদি বলেছিল বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যম। শেখ হাসিনার প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খানের নির্দেশনা অনুযায়ী মিডিয়া এসব কাজ করেছিল বা করতে বাধ্য হয়েছিল। এক্ষেত্রে বাধ্য হওয়ার ঘটনা খুবই কম। গণভবন থেকে নির্দেশনা পাওয়ার সাথে সাথেই বেশিরভাগ মিডিয়া সেই অনুযায়ী ‘হুক্কাহুয়া’ বলতে শুরু করেছিল। গণভবন থেকে পাঠানো নির্দেশনা যেন ছিল মিডিয়ার প্রতি লজ্জাবতীর ছোঁয়া, স্পর্শের সাথে সাথেই তারা গুটিসুটি হয়ে চুপসে গিয়েছিল। অথচ এটি মিডিয়ার চরিত্রের সাথে যায় না। সাংবাদিকদের হওয়া উচিৎ সাহসী। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী। যেমনটা কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় সেসময় (৩১ জুলাই ২০২৪) বলেছিলাম:‘‘আমি সেই দিন হব শান্ত,যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্তআমি সেই দিন হব শান্ত!’’ মিডিয়া কেন লজ্জাবতীর মতো চুপসে গিয়েছিল জুলাই গণআন্দোলন যখন তুঙ্গে, সামাল দেওয়ার পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছিল, তখন শেখ হাসিনা ইন্টারনেট বন্ধ করে গণহত্যার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। সেসময় পর্যন্তও মিডিয়া সব পক্ষের খবরাখবর পরিবেশন করছিল। ইন্টারনেট বন্ধের পর মিডিয়ার প্রতি নির্দেশনা জারি করেন শেখ হাসিনার প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খান। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বেশ কয়েকটি মুঠোফোন মেসেজে তিনি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের নিউজ প্রচার করতে নিষেধ করেন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরতে বলেন তিনি। এরপর থেকেই পাল্টে যায় সংবাদমাধ্যমের চরিত্র। খবরে আরোপ হয় সেন্সরশিপ। সব টেলিভিশন যেন হয়ে যায় বিটিভি। সরকার কীভাবে সফলতার সাথে আন্দোলন দমন করছে সেটি প্রচার করাই যেন হয়ে উঠে টেলিভিশনগুলোর খবরের মূল বিষয়বস্তু। সেসময় অবশ্য গুটিকয়েক পত্রিকা ভিন্নরূপে আবির্ভূত হয়েছিল। শেখ হাসিনা সরকারের প্রেস সচিবের প্রেসক্রিপশন উপেক্ষা করে ছাত্র-জনতা নিহতের খবরাখবর প্রকাশ করতে থাকে। এছাড়া মানবিক কিছু প্রতিবেদনও প্রকাশ করে তারা। এর ফলে আন্দোলন আরও বেগবান হয়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অবশ্য সেসব মনে রাখা হয়নি। গণমাধ্যমে কেমন সংস্কার প্রয়োজন দেশে ৯০ পরবর্তী সময়ে কর্পোরেট সংবাদধ্যম পুঁজির কাছে কুক্ষিগত হতে শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় গণমাধ্যম তার চরিত্র হারিয়ে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় গণমাধ্যম ধীরে ধীরে সংবাদমাধ্যমে রূপ নেয়। তবে কর্পোরেট মালিকানায় গেলেও সাংবাদিকতার মানোন্নয়ন সেভাবে হয়নি। বরং খারাপ সাংবাদিকতার চূড়ান্ত নজির আমরা দেখেছি। গত ৩ দশকে সাংবাদিকতা ডালপালা মেলে অনেকটা মহীরুহ হলেও নীতি-নৈতিকতার বাছ-বিচারসহ মানের দিক থেকে সবকিছুই তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। সেই গণবিচ্ছিন্নতার চূড়ান্ত রূপ আমরা দেখেছি জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময়। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণ করে গণমাধ্যমকে প্রকৃত গণমাধ্যমে রূপান্তর করতে নিম্নোক্ত সংস্কার জরুরি। ১) নিয়োগ সংক্রান্ত সংস্কার গণমাধ্যম এমন একটা ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে যে, এখানে নিয়োগ সংক্রান্ত তেমন কোনো নীতিমালা নেই। কোনো মিডিয়া প্রতিষ্ঠানই নিয়োগ সংক্রান্ত কোনো একক নীতিমালা অনুসরণ করে না। এখানে স্বচ্ছতাও নেই। এর ফলে ন্যূনতম অভিজ্ঞতা ছাড়াই পান দোকানদার থেকে কাঠ ব্যবসায়ী, জেলে, মাদক ব্যবসায়ীসহ নানা ক্ষেত্রের দাগী অপরাধীরাও সাংবাদিকতায় ঢুকে যাচ্ছে। ফলাফল স্বরুপ ছড়িয়ে পড়ছে চাটুকারিতা ও অপসাংবাদিকতা। সাংবাদিকতাকে সঠিক পথে রাখতে হলে নিয়োগ সংক্রান্ত সংস্কার প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বার কাউন্সিলের মতো পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে। অন্যদিকে অনেক মিডিয়া হাউজ রয়েছে যারা সাংবাদিকদেরকে নিয়োগপত্র দেয় না। অপেশাদার এমন আচরণ বন্ধ করে বাধ্যতামূলক নিয়োগপত্র দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া অনেক জায়গায় অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। পেশাদারিত্বের বদলে অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে অবস্থান নিতে হবে। শিক্ষাগত যোগ্যতার বাধ্যবাধকতা: দেশে অপসাংবাদিকতায় বেশিরভাগই করে থাকেন যাদের ন্যূনতম শিক্ষাগত এবং পারিপার্শ্বিক যোগ্যতা নেই। প্রেস কাউন্সিলসহ সাংবাদিকতার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা বিভিন্ন সময় নানা জায়গায় গিয়ে শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়ে কথা বলেন। অজ্ঞাত কারণে বিষয়টিকে তারা শুধু কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেন। অপসাংবাদিকতা রুখতে শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টিও সংস্কার প্রক্রিয়ার অন্তর্ভূক্ত করা যেতে পারে। চাকরির নিশ্চয়তা: পেশাদার সাংবাদিকতায় যারা রয়েছেন, তাদের বেশিরভাগেরই চাকরি নিয়ে এক অজানা আতঙ্ক থাকেন। কখন যেন আকস্মিক নোটিশে চাকরিহারা হতে হয়। সাংবাদিকদের চাকরি থেকে বের করে দেওয়া যেন ছেলের হাতের মোয়া। এমনও অনেকসময় হয় যে, রাতে কাজ করে গিয়ে সকালে শুনতে পান যে তার চাকরি নেই! এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে হবে। কোন সাংবাদিককে হুটহাট নোটিশে চাকরি থেকে বের করে দেওয়া যাবে না। কোনো কারণে যদি চাকরি যায়ও, সেটাও যেন আইনানুগ প্রক্রিয়ায় হয়। এতে সাংবাদিকতা অপেশাদারিত্ব থেকে রক্ষা পাবে। ২) বেতন সংক্রান্ত সংস্কার বিগত কয়েক দশকে সাংবাদিকতা পুঁজির কাছে কুক্ষিগত হলেও এর সুফল পায়নি পেশাদার সাংবাদিকরা। এখনকার বাজারেও ১০-১৫ হাজার টাকা বেতনে গ্র্যাজুয়েট কর্মী খোঁজেন মিডিয়ার কর্তারা! অনেক জায়গায় আবার সেও নেই। বেতন-ভাতা দেওয়া হবে বলে নিয়োগ দিলেও শেষ পর্যন্ত বেতন দেওয়া হয় না। দিলেও সেটি হয় অনিয়মিত। যে কারণে অনেক সংবাদকর্মী অনৈতিক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সাংবাদিকতা পেশার ওপর। এজন্য নিয়মিত বেতন দেওয়ার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। নিয়মিত বেতন দেওয়ার সক্ষমতা না থাকলে মিডিয়া হাউজ থাকার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে মনে হয় না। অবশ্য গ্রæপ অব কোম্পানির অন্যান্য খাতে বেতন-ভাতায় সমস্যা না হলেও মিডিয়ার ক্ষেত্রে 'দারিদ্রতার চরম রূপ' পরিলক্ষিত হয়। ওয়েজবোর্ড সংশোধন: প্রিন্ট মাধ্যমে ওয়েজবোর্ডের বিষয় থাকলেও টেলিভিশন এবং অনলাইন মাধ্যমে তারও বালাই নেই। সেজন্য কর্তাব্যক্তিরা নিজেদের মনমতো অন্যায্য বেতন নির্ধারণ করেন। প্রিন্টে ওয়েজবোর্ড থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটি মানা হয় না। কিছু কিছু জায়গায় মানা হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কাগজে-কলমে ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন দেখিয়ে সরকারি সুযোগ সুবিধা নেয় পত্রিকাগুলো। এছাড়া ওয়েজবোর্ড সংশোধন করে টেলিভিশন এবং অনলাইন গণমাধ্যম অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। ওয়েজবোর্ড যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা সেটি মনিটরিং করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবও এ বিষয়ে কথা বলেছেন। তিনি ওয়েজবোর্ড বাতিল করে ন্যূনতম বেতনের সিস্টেম চালু করার কথা বলেছেন। সেটিও আলোচনা সাপেক্ষে বিবেচনায় রাখা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে আইনের যথাযথ ও কঠোর বাস্তবায়ন হতে হবে। নাহলে আইন বা নিয়ম করে শেষ পর্যন্ত কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। ৩) পেশাদারিত্ব সংক্রান্ত সংস্কার জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের সময় আমরা সংবাদমাধ্যমকে লজ্জাবতীর মতো চুপসে যেতে দেখেছি। সেটাও তবু একধরনের অসহায়ত্ব বলে মানা যায়। তবে বেশকিছু সংবাদমাধ্যম আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে প্রোপাগান্ডা মেশিনে পরিণত হয়েছিল। পেশাদারিত্বের ন্যূনতম বালাই ছিল না তাদের। জনগণের প্রতিও ছিল না কমিটমেন্ট। স্বউদ্যোগে ওসব মিডিয়া সরকারের পক্ষ নিয়ে বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করেছে দিনের পর দিন। শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী আমলে এভাবেই পেশাদারিত্বের মুণ্ডুপাত করে গিয়েছে কথিত কিছু মিডিয়া। এই সংবাদমাধ্যমগুলো হয়ে উঠেছিল আওয়ামী লীগের গুজব সেল সিআরআই এর প্রোপাগাণ্ডা মেশিন। বিরোধী নেতাদের ব্যক্তিগত ফোনকল প্রচার, চরিত্র হনন থেকে শুরু করে নীতি-নৈতিকতার বলাৎকারসহ এমন কিছু নেই, যা কথিত সেই সংবাদমাধ্যমগুলো করেনি। এমন যাতে আর কখনও কেউ করতে না পারে, সেজন্য লাগাম টেনে ধরার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে অপেশাদার আচরণ করে এমন কাউকে সংবাদমাধ্যমে রাখা যাবে না। অন্যদিকে মালিকপক্ষও নানা সুবিধা পেতে নিউজরুমের কাছে অন্যায় আবদার করে থাকেন। অপেশাদার আচরণ করে তারা যাতে পার না পান, তার ব্যবস্থা থাকা জরুরি। এজন্য সংবাদমাধ্যমের মালিক, সম্পাদক এবং সাংবাদিকসহ সবার দলীয় লেজুড়বৃত্তি বন্ধ করতে হবে। এখানে যে যেই মতেরই হোক না কেন, শতভাগ পেশাদারিত্ব বজায় রাখতে হবে। এছাড়া সরকারও যাতে স্বাধীন সাংবাদিকতায় কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে সাইবার আইনসহ সকল কালাকানুন বাতিল করা জরুরি। প্রেস কাউন্সিল শক্তিশালীকরণ: পেশাদার সাংবাদিকতা করতে গিয়ে সাংবাদিকরা নানাভাবে হয়রানি ও মামলা-হামলার শিকার হন। সেজন্য প্রেস কাউন্সিলকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। থানা বা কোর্টে নয়, সংবাদ সংক্রান্ত সব মামলা প্রেস কাউন্সিলে করতে হবে। প্রেস কাউন্সিলের অনুমতি বা অবগতি ব্যতীত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সংবাদ সংক্রান্ত মামলা করতে না দেওয়ার বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। সংবাদ প্রকাশের জন্য সাংবাদিককে কোনো ধরনের হুমকি দেওয়া বা হামলা করা হলে কঠোরভাবে প্রতিহত করার ব্যবস্থা করতে হবে। ৪) নিবন্ধন সংক্রান্ত সংস্কার দেশে সংবাদমাধ্যমের নিবন্ধন প্রক্রিয়া এখনও যেন সেই ব্রিটিশ আমলে পড়ে রয়েছে। কেউ যদি যথাযথভাবে সংবাদমাধ্যমের নিবন্ধন পাওয়ার যোগ্য হয়, সেক্ষেত্রে দ্রুততম সময়ে আবেদন নিষ্পত্তি করতে হবে। আবেদন প্রক্রিয়াও অনলাইনভিত্তিক করা জরুরি। তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে এসেও মান্ধাতার আমলের মতো এ অফিস সে অফিস করে মাসের পর মাস কাটিয়ে দেওয়া যৌক্তিক বিষয় নয়। এছাড়া নিবন্ধন পেতে হয়রানি, ঘুষ দাবিসহ সব ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার ব্যবস্থা রাখতে হবে। পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে সংবাদমাধ্যমের অবমূল্যায়ন ও হয়রানি বন্ধ করে যেকোন এক জায়গায় সংবাদমাধ্যমের নিবন্ধন সংক্রান্ত বিশেষ সেল রাখা যেতে পারে। ভেরিফিকেশন থেকে শুরু করে নিবন্ধনসহ সবকিছু বিশেষ সেলের অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা করবেন। একইসাথে কালো টাকার মালিক, অসাধু ব্যবসায়ী, সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, মাফিয়া চক্রসহ অপেশাদার কাউকে সংবাদমাধ্যমের নিবন্ধন দেওয়া যাবে না। পেশাদারিত্বের বদলে সংবাদমাধ্যমকে ব্যবহার করে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থ কায়েমের চেষ্টা বন্ধ করতে হলে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেই হবে। স্বৈরাচারের আগে-পরে আমরা লক্ষ্য করেছি যে, কোনো রিপোর্ট সরকারের পছন্দ না হলে সংবাদমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া হয়। এটি খুবই খারাপ দৃষ্টান্ত। টেলিভিশন-পত্রিকার জন্য বিষয়টি কিছুটা জটিল হলেও অনলাইন সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে খুবই সহজ। বিটিআরসি নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ না হলেও এই প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে বহু অনলাইন মিডিয়া বন্ধ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ৫৪টি অনলাইন বন্ধ করার ক্ষেত্রে কোন ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেনি। আইন না মানলে নিবন্ধন স্থগিত ব্যতীত অনলাইন সংবাদমাধ্যমসহ কোনো মিডিয়াই যেন সরকার বন্ধ করতে না পারে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এরপরও সরকার কোনো সংবাদমাধ্যম বন্ধ করলে সরকারকে অন্তত ৬ মাস ওই মিডিয়ার সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বহন করতে হবে। স্বাধীন বিচার বিভাগের মতো করেই সরকার যেন নিবন্ধন ইস্যু বা অন্য কোনভাবেই মিডিয়ার ওপর কোন ধরনের হস্তক্ষেপ অথবা খবরদারি করতে না পারে সংস্কারের মাধ্যমে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ৫) বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত সংস্কার চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর বর্তমানে প্রিন্ট পত্রিকার প্রচার সংখ্যা ও বিজ্ঞাপন হার নির্ধারণ করে থাকে। এখানে অনেক শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। যেসব পত্রিকা দৈনিক ৫০০ কপিও ছাপা হয় না, সেসব পত্রিকা লাখ লাখ কপি ছাপানোর ভুয়া তথ্য দেখিয়ে টাকার বিনিময়ে বেশি বিজ্ঞাপন রেট নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অর্থের বিনিময়ে রেট আপ-ডাউন করানো বন্ধের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। এছাড়া ৯০০ টাকা রেট দিয়ে এখনকার সময়ে কতটুকু টিকে থাকা যায় সেটিও বিবেচ্য বিষয়। এখনকার মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনায় রেট আরও অন্তত ৫০ শতাংশ বাড়ানো যায় কিনা সেটিও ভেবে দেখা যেতে পারে। একই কথা রেডিও, টেলিভিশন ও অনলাইন মাধ্যমের জন্যও প্রযোজ্য। সেসব মিডিয়ার জন্যও বিজ্ঞাপন নীতিমালা করা সময়ের দাবি। এছাড়া সামগ্রিক মিডিয়াকে শিল্প ঘোষণা করে এই শিল্পের বিকাশে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সরকারি বিজ্ঞাপনের বিল দ্রæততম সময়ের মধ্যে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া বিগত দিনে আমরা দেখেছি, সরকারের পছন্দমতো সংবাদ না করলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হুমকি দিয়ে বিজ্ঞাপন বন্ধ করা হয়েছে। সংবাদের কারণে কোনো গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপন বন্ধ করাকে অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা যেতে পারে। এটি প্রমাণ হলে অপরাধীদের কঠোর শাস্তি বা যে পদেই থাকুক না কেন পদচ্যুত করার বিধান থাকতে হবে। ৬) মিডিয়া সিটি তৈরি বাংলাদেশে মিডিয়া হাউজগুলো পুরো শহরজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও এটি কোনো আদর্শ পন্থা নয়। সেক্ষেত্রে মিডিয়া সিটি তৈরি করা যেতে পারে। সেখানে স্বল্পমূল্যে একই ভবনে একাধিক মিডিয়া হাউজের অফিস থাকবে। এটা উৎকৃষ্ট পদ্ধতি হতে পারে। দেশের সবগুলো সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠান এক এলাকায় থাকলে সব দিক থেকেই সুবিধা রয়েছে। সংবাদমাধ্যমের অফিস ছাড়াও সেখানে বা পাশাপাশি কোথাও সংবাদকর্মীদের জন্য আবাসন ব্যবস্থাও তৈরি করা যেতে পারে। ৭) ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী সাংবাদিক ইউনিয়ন সংবাদকর্মীদের অধিকার রক্ষায় সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু দুঃখজনকভাবে হলেও সত্য যে, ’৯০ পরবর্তী কথিত গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর সময়ে ঐক্যবদ্ধ ইউনিয়ন দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে। সংবাদকর্মীদের অধিকার রক্ষার বদলে সাংবাদিক ইউনিয়নগুলো হয়েছে দলীয় লেজুড়বৃত্তির আঁতুড়ঘর। নির্লজ্জভাবে দলীয় লেজুরবৃত্তি করাই হয়েছে তাদের একমাত্র প্রধান কাজ। সাংবাদিকতার আজকের দুর্দিনের জন্য এটিও অন্যতম কারণ। সেজন্য সাংবাদিক ইউনিয়নকে পেশাজীবী সংগঠন করতে হবে। এই সংগঠনগুলো যাতে কোনভাবেই দলীয় রাজনীতির হাতিয়ার হতে না পারে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এসব বিষয়গুলো ছাড়াও পেশাজীবী সাংবাদিক, মালিকপক্ষসহ পেশা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনা করে আরও প্রয়োজনীয় বিষয় নির্ণয় করে সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। এর উদ্দেশ্য হলো: সাংবাদিকতা যেন সবসময় সঠিকপথে থাকে। কোন অশুভ শক্তি যেন সাংবাদিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে। হোক সেটা সরকার, মালিকপক্ষ, সাংবাদিক বা যেকোন পক্ষ থেকেই। কেউ যেন সাংবাদিকতার গতিপথ রুদ্ধ করতে না পারে কিংবা গতিপথ পাল্টে দিতে না পারে। গণমানুষের জন্যই হোক পেশাদার গণমাধ্যম, এটাই সংস্কারের মূল উদ্দেশ্য হতে হবে। লেখক: সাংবাদিক; প্রধান সমন্বয়ক, মিডিয়া মনিটর।ইমেইল: ahsankamrul91@gmail.com

পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞ: এ জাতিকে মেধাশূন্য করতে চেয়েছিল তারা
এনএম ফখরুদ্দীন: বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করার জন্য এ দেশের শিক্ষক সমাজ, কবি, সাহিত্যিক, গবেষক, সাংবাদিক, প্রকৌশলী,চিকিৎসক, স্থপতি,ভাষ্কর, সমাজসেবী, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার, সংস্কৃতিসেবী, সংগীতশিল্পী, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, চিত্রশিল্পী, সংগীতশিল্পী প্রমুখ বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ছিল অনন্য। মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের অবদান অসামান্য। পাকিস্তানি পাক হানাদার বাহিনী যখন বুঝতে পেরেছিল, তাদের পক্ষে যুদ্ধে জয়ী হওয়া সম্ভব নয়, তখন তারা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে নবগঠিত দেশকে সামাজিক,সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে দূর্বল ও পঙ্গু করার নীলনকশা এঁকেছিল। তাদের পরিকল্পনা ছিল জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। ১৯৭১ সালের ১০-১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই অল্প সময়ে তারা বাছাই করে করে হত্যা করেছিল এ দেশের প্রথম শ্রেণির বহু বুদ্ধিজীবীকে। এ হত্যাযজ্ঞ বড়ই মর্মান্তিক! একটি জাতিকে জ্ঞানহীন ও মেধাশূন্য করতে তারা শেষ চেষ্টাটা করেছিল এমন নোংরা হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে। তাদের এই নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রেক্ষাপট ও কারণ কি ছিল আসুন দেখি। ব্রিটিশ আমলে পরাধীনতার বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের প্রতিটি সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন এ দেশের বুদ্ধিজীবীরা। ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন এবং ৬৯’-এর গণ-অভ্যুত্থানে তারা ছিলেন অনুপ্রেরণাদানকারী। কেউ কেউ সামনের কাতারে। বাঙালি জাতির ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ, অত্যাচারের বিষয় সাধারণ মানুষকে অবগত করেছিলেন তারা। বাংলাদেশ থেকে যে বিপুল পরিমাণ সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে- এ কথা সবাই জানত। কিন্তু, অর্থনীতিবিদরা বিভিন্ন সারণীর মাধ্যমে যে সত্যটাকে জনগণের সামনে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছিল। তারাই সর্বপ্রথম পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে দুইটি স্বতন্ত্র অর্থনীতি চালুর কথা বলেছিলেন। বাঙালি সাংবাদিকরা তুলে ধরেছেন আন্দোলনের প্রতিটি খবর শিল্পী-সাহিত্যিকরা গল্প-উপন্যাস, নাটক, গানসহ লেখনীর মাধ্যমে জনগণের গণতান্ত্রিক মৌলিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের প্রতি সচেতন করে তুলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা কখনো স্বতন্ত্র, কখনো একই সঙ্গে করেছেন আন্দোলন। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অবদান রেখেছেন বুদ্ধিজীবীরা। বিভিন্ন তথ্য ও গবেষকদের লেখা থেকে জানা যায়; ভারতে আশ্রয় নেওয়া বুদ্ধিজীবীরা গড়ে তোলেন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’ যার সভাপতি ছিলেন ড. আজিজুর রহমান মল্লিক। তিনি পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) উপাচার্য হয়েছিলেন। এ ছাড়া, তাকে সভাপতি ও জহির রায়হানকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয় বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম পরিষদ। বুদ্ধিজীবীদের সংগঠন মুজিবনগর সরকারের অধীনে পরিকল্পনা সেল গঠন করেন। বিশ্বের বুদ্ধিজীবীদের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সরবরাহ ও বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় সংসদীয় পার্টির সঙ্গে সাক্ষাৎ সাহায্যের আবেদন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বক্তব্য প্রদান, শরণার্থীদের উৎসাহ প্রদান ইত্যাদি ক্ষেত্রে তারা ভূমিকা রাখেন। শরণার্থীশিবির শিক্ষক সমিতির উদ্যোগে ৫৬টি স্কুল খুলে শরণার্থীদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করে। বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, যা বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামীদের প্রেরণার উৎস ছিল। এভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখেন। স্বাধীনতাবিরোধী চক্র বুঝতে পেরেছিল, তাদের পরাজয় অনিবার্য। তারা আরও মনে করেছিল যে, বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা বেঁচে থাকলে এ মাটিতে বসবাস করতে পারবে না। তাই, পরিকল্পিতভাবে জাতিকে মেধাহীন ও পঙ্গু করতে দেশের বুদ্ধিজীবীদের বাসা ও কর্মস্থল থেকে রাতের অন্ধকারে পৈশাচিক কায়দায় চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে হত্যা করে। অনেকে ভাগ্যবশত মৃত্যু এড়াতে পেরেছিলেন। পরে বিক্রমের সঙ্গে যুদ্ধেও অংশ নিয়েছেন কিংবা মুজিবনগর সরকারের পক্ষে বিদেশে জনমত গঠনে কাজ করেছেন। দিল্লি ও কলকাতার লেখক বুদ্ধিজীবীরাও সে সময় বাংলাদেশের পক্ষে কলম ধরেছেন। জনমত গঠনে ভূমিকা রেখেছেন। শাবানা আজমির বাবা বিখ্যাত উর্দু কবি কাইফি আজমি নিজের টাকা খরচ করে লঙ্গরখানা খুলেছিলেন। তাদের সেই ভূমিকার কথা বিস্মৃত হওয়ার নয়।১৯৭২ সালে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সংকলন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানা যায়, শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা এক হাজার ৭০। তবে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের চার ধাপে প্রকাশিত তথ্য মোতাবেক এখন পর্যন্ত শহিদ বুদ্ধিজীবী হিসাবে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পেলেন ৫৬০ জন শহিদ বুদ্ধিজীবী। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় যাদের নাম এসেছে, তাদের মধ্যে সাহিত্যিক রয়েছেন ১৮ জন, দার্শনিক একজন, বিজ্ঞানী তিনজন, চিত্রশিল্পী একজন, শিক্ষক ১৯৮ জন, গবেষক একজন, সাংবাদিক ১৮ জন, আইনজীবী ৫১ জন, চিকিৎসক ১১৩ জন, প্রকৌশলী ৪০ জন, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারি ৩৭ জন, রাজনীতিক ২০ জন, সমাজসেবী ২৯ জন, সংস্কৃতিসেবী, চলচ্চিত্র, নাট্যকার প্রমুখ। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যশোর ও মানিকগঞ্জের বুদ্ধিজীবী বেশি। তার মধ্যে যশোরের ৩৭ জন ও মানিকগঞ্জে ৩৬ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী, হত্যার শিকার হওয়া বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে নওগাঁর ২৮ জন ও ২৫ জন সিরাজগঞ্জের। তার পরের অবস্থানেই ঢাকায় শহিদ বুদ্ধিজীবীরা। গবেষকরা বলছেন, ‘ঢাকা, চট্টগ্রামের বাইরে বহু বুদ্ধিজীবী নিজ এলাকাতেই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। শহিদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ৩৮৬ জন মুসলমান, ১৬৭ জন হিন্দু, তিনজন বৌদ্ধ ও তিনজন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী ছিলেন।’ তাদের মধ্যে বেশিরভাগ ছিলেন মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষক। এর পরেই পেশার দিক থেকে আছেন চিকিৎসক, আইনজীবী, প্রকৌশলী, সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী, সংস্কৃতিসেবী ও শিল্পীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। চার বারে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পাওয়া ৫৬০ জন শহিদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় আছেন ভারত ও ইতালির নয়জন শহিদ বুদ্ধিজীবী। ৪৬ জন শহিদ বুদ্ধিজীবীর এলাকার ঠিকানা পাওয়া যায়নি। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৬১টি জেলাতেই বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের তথ্য পাওয়া যায়। নিহত বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় শীর্ষ কয়েকজনের নাম আলতাফ মাহমুদ শহীদুল্লা কায়সার, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুর, সিরাজুদ্দীন হোসেন, গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, আবদুল আলীম চৌধুরী, সেলিনা পারভীন, মেহেরুন্নেসা, নিজামুদ্দীন আহমেদ, চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান, দর্শনশাস্ত্রের গোবিন্দ চন্দ্র দাশ, বাংলা সাহিত্যের মুনীর চৌধুরী, আনোয়ার পাশা ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী; ইতিহাসশাস্ত্রের আবুল খায়ের, শিক্ষা ক্যাডারের সিরাজুল হক খান ও ফাইজুল মাহী প্রমুখ। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অতি পরিচিতমুখ জহির রায়হান ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি নিখোঁজ হয়েছিলেন। নিখোঁজ হওয়ার আগে তিনি বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক বুদ্ধিজীবী হত্যা করতে সক্ষম হয়নি। তবে, পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কিছুটা ব্যর্থ হলেও তারা বাঙালিকে মেধাশূন্য করার জন্য নির্ভূলভাবে গোপন তালিকা প্রনয়ন করেছিল কিন্তু।’বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দীন আহমেদ ১৪ ডিসেম্বরকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। আর সেই থেকেই ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, তত দিন প্রতিজন বাঙালীর হৃদয়ে এ নৃশংস হত্যাযজ্ঞের হৃদয়বিদারক কাহিনী স্মরণে অমর থাকবে। লেখক: অধ্যক্ষ, বোয়ালখালী হাজী মো. নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম।

জুলাই শ্রেণি সংগ্রামে মওলানা ভাসানী
উপমহাদেশের নানা ঘটনা প্রবাহের বাঁক বদলের ইতিহাসে বারবার আলোচনায় এসেছেন যেকজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন মানুষ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। মওলানা ভাসানী ছিলেন শ্রেণি বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। আমাদের শ্রেণি সংগ্রামের আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু দুঃখজনক এই যে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে সব থেকে উপেক্ষার শিকার হয়েছেন সেই তিনিই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যাদের অগ্রগণ্য ভূমিকা ছিল, যাঁরা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহযোদ্ধা তাঁদের প্রত্যেককেই স্বার্থান্বেষী কায়েমি রাজনৈতিক শক্তি ইতিহাস থেকে দূরে সরে রেখেছে বারবার। বিশেষত একাত্তর পরবর্তী জিয়াউর রহমান, মুহাম্মদ এরশাদ, বেগম খালেদা থেকে শেখ হাসিনা পর্যন্ত যে কটি সরকার গঠিত হয়েছে, তাদের সবার হাতেই আমাদের জাতীয় ইতিহাস কুক্ষিগত হয়েছে, কাটছাঁট করা হয়েছে আমাদের জাতীয়তার ভিত্তিপুরুষদের অবদানকে। এর প্রধানভাগজুড়েই ইতিহাসের আড়ালে ফেলে দেওয়া হয়েছিল মওলানা ভাসানীকে। সব শাসকই নিজেদের রাজনৈতিক তত্ত্ব ও বয়ান নির্মাণ করতে গিয়ে ‘থোড় বড়ি খাড়া/খাড়া বড়ি থোড়’ টাইপের রাজনৈতিক দর্শনের বিকাশ ঘটিয়েছে। একাত্তর কেন্দ্রিক তাদের রাজনৈতিক অর্জনের বায়াসটা বহুমুখী না হয়ে একমুখী হয়ে উঠেছিল। যেখানে আমরা সব মানি, কিন্তু ‘তালগাছটা আমারই’ প্রতিপাদ্যের ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এর মধ্যে আমাদের ইতিহাস পাঠে প্রজন্মকে মওলানা ভাসানী থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও বিএনপি জেনারেল জিয়াউর রহমানকে অতিরঞ্জিতভাবে মহিমান্বিত করতে গিয়ে আমাদের ইতিহাসের অনেক প্রবাদপ্রতিম মানুষকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। যার ফলে আমরা পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস পাঠ থেকে বঞ্চিত থেকেছি এবং খণ্ডিত ইতিহাস পাঠ করে হয়ে উঠেছি ইতিহাস মূর্খ। আমাদের মূর্খামিতা আমাদেরকে অসহিষ্ণু এবং কায়েমি সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। তারপরও বারবার স্বমহিমায় উজ্জ্বল তারকার মতো ইতিহাসের কাঠগড়ায় হাজির হয়েছেন শ্রেণি সংগ্রামের মহানায়ক মওলানা ভাসানী। ভাসানীর জীবন সংগ্রামের পুরোভাগজুড়েই বাংলার খেটে খাওয়া মানুষেরা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল। আমাদের তথাকথিত সভ্য সমাজে যারা নিম্ন শ্রেণির মানুষ বলে আখ্যায়িত, বিশেষত কৃষক শ্রমিক ক্ষেতমজুর রিকশা চালক কামার কুমার জেলে তাঁতি মুদি দোকানীসহ নান শ্রেণি পেশার মানুষ তারাই ছিলেন মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক লড়াইয়ের বড় শক্তি। রাজনৈতিক শহুরে কেন্দ্র থেকে দূরে থাকা এসব মানুষের মাঝেই তিনি সময় অতিবাহিত করেছেন এবং খেটে খাওয়া মানুষের মাঝে রাজনৈতিক চিন্তাবোধের বিকাশ ঘটিয়েছেন ক্রমাগত। তাঁর রাজনৈতিক জীবনে পুঁজিপতিরা কখনোই মিত্র হয়ে ওঠেনি কিংবা তাঁর সখ্যতাও তাদের সঙ্গে ছিল না। তাঁর সকল সম্পর্কের কেন্দ্রই ছিল এইসব গ্রামীণ হারজিরজিরে নিরন্ন মানুষেরা। তিনি তাদের কাছেই হয়ে উঠেছিলেন একাধারে অবিসংবাদিত রাজনৈতিক নেতা অন্যদিকে বাংলার সহজীয়া ধারার আলেম, পীর। মানুষ তাঁকে নেতা ও পীর জ্ঞান করত এবং তাঁর জীবন যাপনে আকৃষ্ট হয়ে তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের দীক্ষা গ্রহণ করত। এটা ছিল শ্রেণি সংগ্রামে মওলানা ভাসানীর সবচেয়ে বড় অর্জন। মানুষের আস্থা অর্জন এবং তা বহাল রেখে রাজনৈতিক কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের। এক্ষেত্রে মওলানা ভাসানী আমাদের জন্য রোল মডেল। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ মাত্রই এজন্য পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে ভাসানীতেই তাড়িত। আমরা যদি এই জুলাই আন্দোলনের কথা বলি, তবে ভাসানীর কথা আগে বলতে হয়। এই আন্দোলনে ভাসানীর উত্তরসূরীরাই অগ্রগণ্য ভূমিকা রেখেছে এবং এই আন্দোলনকে সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। এই আন্দোলনে সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল একদম সাধারণ ঘরের শিক্ষার্থী, যাদের বংশ বা পরিবার পরম্পরায় কোনো দলীয় রাজনীতি সম্পৃক্ততা নেই, নেই রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ বা উচ্চাকাঙ্ক্ষা। এই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বড় শক্তি ছিল পেটের দায়ে গ্রাম থেকে ছুটে আসা শহুরে রিকশা চালক, পরিবহন শ্রমিক, ফুটপাতের নিরন্ন দোকানি, বাদাম বিক্রেতা, গ্রাম থেকে উঠে আসা সদ্য শহুরে মধ্যবিত্ত এবং কেরানি টাইপ কতিপয় চাকুরে। মোটাদাগে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে এরাই ছিল আমাদের সব চেয়ে বড় শক্তি। এই শক্তিকে কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দল মাঠে নামাতে পারেনি, তারা নেমেছে অগোচরে বেড়ে ওঠা তাদের শ্রেণি সংগ্রামের চেতনাগত বিবেক ও বোধের তাড়না থেকে। এসব মানুষের ভেতর পূর্ব পুরুষদের শ্রেণি সংগ্রামের মৌখিক বয়ান তাদের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে দৈনন্দিন নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়েই। এই শ্রেণি চেতনা মওলানা ভাসানীর চেতনারই ধারাবাহিকতা। মজলুম এই জননেতা মওলানা ভাসানী ব্রিটিশ শাসনের অধীন বাংলা ও আসাম প্রদেশে ১৯২৭-এর দশকে জমিদার-মহারাজা বিরোধী কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার মাধ্যমে নিজের সংগ্রামী জীবনের যাত্রা শুরু করেছিলেন। এই সংগ্রাম বৃটিশ ও বৃটিশ পূর্ব থেকে- রাজা শিবচন্দ্র রায় ও দেবি চৌধুরাণীদের কৃষক প্রজা বিদ্রোহ, নূরুল দ্বীন ও আদিবাসী কানুদের সংগ্রাম থেকে, ইলা মিত্রদের তেভাগা আন্দোলন থেকে, কমরেড মণি সিংহ ও কুমুদিনী হাজংদের টংক আন্দোলনসহ ছোট বড় নানা রকম আন্দোলন সংগ্রাম থেকে উৎসারিত চেতনা। ধাপে ধাপে তা আমাদের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির রক্তে রন্ধ্রে সঞ্চারিত হয়ে আসছে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ এবং আমাদের তথাকথিত রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কাঁদা ছোড়াছুড়ির সংস্কৃতির মধ্যে থেকেই রাজনৈতিক সংস্কৃতির উপাদানগুলো সাধারণ মানুষ ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে নিজেদের মাঝে তুলে নিয়েছে। যার ফলে শাসনের নামে যখনই শোসনের খড়গটা তিব্র হয়েছে তখনই জন বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে সাধারণ জনতা। এই সংগ্রামী জীবনবৃত্তে আপনাআপনি ভাসানী দর্শন মূর্ত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতার বিস্ফোরণ আমরা জুলাই আগস্টে দেখেছি। মানুষের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে যখন প্রতারণা করা হয় তখনই কিন্তু আমাদের অগোচরেই শ্রেণি শোষণের চিত্র সুস্পষ্ট হয় এবং শ্রেণি সংগ্রাম বিপ্লব বা লড়াইয়ে গড়ায়। মওলানা ভাসানী তাঁর এক বক্তৃতায় বলেছিলেন ‘বহু রক্তের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা এসেছে। কোন ব্যক্তিবিশেষ, কোন বিশেষ দল দেশ স্বাধীন করেনি। এই দেশের কামার, কুমার, শ্রমিক, চাষি, জেলে, মধ্যবিত্ত, ছাত্র, যুবক বুকের রক্ত দিয়া বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছে। লক্ষ মানুষের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতাকে কোন বিশেষ দল কোন ব্যক্তিবিশেষের সম্পত্তিতে পরিণত করা যাবে না। গণতন্ত্রের নাম নিয়া গণতন্ত্রের টুটি টিপে ধরা চলবে না। অপরাধী যারা তাদের বিচার করে শাস্তি দাও। কিন্তু বাঙ্গালির নামে বিনা বিচারে কাউকে আটক করে রাখা যাবে না। কোন প্রকার জুলুমকে বাংলার মানুষ বরদাস্ত করবে না। তোমরা যদি ক্ষমতার অহংকারে বাংলার মজলুম মানুষের দাবীকে অস্বীকার করতে চাও, তবে মনে রেখো ঝড় আসছে। যে ঝড় আসছে সে ঝড় বিপ্লবের ঝড়। এই দুর্যোগ বিপ্লবের নমুনা, ‘এই দুর্যোগ আল্লাহর রহমত’। মওলানা ভাসানীর এই কথাগুলো আমাদের জাতীয় জীবনে বারবার সত্য হয়ে ফিরে এসেছে। পঁচাত্তর পরবর্তী সময় থেকে আজ অদ্যাবধি এই কথাগুলো চরম সত্য হিসেবেই প্রমাণিত। আমরা নব্বইয়ের এরশাদের বিরুদ্ধে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন দেখেছি, বিএনপির অপশাসনে বিরুদ্ধে আন্দোলন দেখেছি, সর্বশেষ আমরা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সাক্ষ্য হলাম। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এসব ঘটনার মূল কারণ কিন্তু মানুষের অবমূল্যায়ন, অগণতান্ত্রিকতা এবং শ্রেণি শোষণ। যা মওলানা ভাসানী বারবার বলে গিয়েছেন এবং রাজনৈতিক নেতাদের সতর্ক করে দিয়েছেন। তারপরও তারা এর থেকে কোনো শিক্ষা নেয়নি। ফলে বারবার আমাদের জীবন দিতে হয়েছে, রাজপথে রক্ত ঢালতে হয়েছে। এর মধ্য দিয়েই এখানে মওলানা ভাসানী পুনর্বার ফিরে আসছেন মুক্তির বারতা নিয়ে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানেও তিনি ছিলেন আমাদের অদৃশ্য শক্তি ও প্রতিবাদী মানসকাঠামোর কেন্দ্রবিন্দু। যে জন্য আমরা নতুন প্রজন্মের দেয়াল চিত্র ও গ্রাফিতির মধ্য দিয়েই মওলানা ভাসানীকে চিত্রায়িত হতে দেখেছি অসাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষায়। লেখক: কবি ও সমাজচিন্তক।

চট্টগ্রামের ভাষার গানের সম্রাট শ্যাম সুন্দর বৈঞ্চব স্মরণে
শাহীন চৌধুরী: শ্যাম সুন্দর বৈঞ্চব ছিলেন একজন নান্দনিক কন্ঠ শিল্পী ও গানের সাধক। চট্টগ্রামের ভাষায় রচিত গানকে তিনি একটি আলাদা মাত্রা তৈরি করে দিয়ে গেছেন। গান যে কেবল শোনার নয়, এটিকে মানুষের মনে রাখার মত একটা অবস্থান তিনি তৈরি করেছেন। তার উপস্থাপনা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা ও নান্দনিক। তিনি গান গাওয়ার সময় তার রসটাকে বুঝতেন ও সেভাবে নিজস্ব ঢঙ্গে গাওয়ার চেষ্টা করতেন। যার ফলে, গানের ভাব ও বিষয় মানুষের খুব সহজ হয়ে যেত। তাই, চট্টগ্রামের গান বলতে শ্যাম সুন্দর বৈঞ্চবের নামটায় আগে আসে। তার গায়কী বহু গীতিকারকে গান লেখায় অনেক বেশি উদ্বুদ্ধ করত। শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণরেব জন্ম ১৯২৭ সালের ১৫ জুন। নন্দীর হাটের সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম। বাবা জয়দাশ ছিলেন আধ্যাত্মিক গানের সাধক। মুলত বাবার হাত ধরে তার গানে আসা। ছোটবেলায় নানা কৌতুক মিশ্রণে গান গাওয়া তার স্বভাবজাত অভ্যাস ছিল বিধায় পরবর্তী তাকে গান গাওয়ার ক্ষেত্রে আলাদা পরিচিতি দিয়েছে। অল্প বয়সে বাবা মারা যাওয়াতে লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে জীবিকার তাগিদে তাকে নামতে হয়। ১৯৬৩ সালে বাংলাদেশ বেতারে ‘গুরা বউ বউরে’ এ গানটি গেয়ে তিনি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে শেফালী ঘোষের সাথে পরিচয় হওয়ার পর তাদের জুটি কেবল বাংলাদেশে নয়, বিশ্বে জনপ্রিয়তা তৈরি করতে সক্ষম হয়। তারা আঞ্চলিক গানের সম্রাট ও সমাজ্ঞী হিসেবে আজও মানুষের মনিকোটায় বেঁচে আছেন। বাংলাদেশ বেতারে এ জুটির প্রথম গান ‘নাউয়ুর গেলে বাপর বাড়ি, আইস্যু তাড়াতাড়ি’। দুইজনে প্রায় ২৯টি দেশে গান গেয়েছেন। শ্যাম সুন্দর বৈঞ্চব মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘরে বসে থাকেননি, আকাশবাণীতে গান গেয়ে যোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করতেন। গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক সত্য সাহা তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তিনি নানাজনের গান গেয়েছেন; তাদের মধ্যে এমএন আকতার, আবদুল গফুর হালী, সৈয়দ মহিউদ্দিন অন্যতম। চলচ্চিত্রেও বহু গান গেয়েছেন। সৈয়দ মহিউদ্দিন ছিলেন একেবারে তার পরিবারের একজন সদস্যের মত। যে কারণে অসংখ্য জনপ্রিয় গান তারা সৃষ্টি করেছেন। চট্টগ্রামের প্রকৃত আঞ্চলিক ঢং ও ভাষার ব্যবহার সৈয়দ মহিউদ্দিনের গানে প্রাধান্য পেত। শ্যাম সুন্দর বৈঞ্চব নিজেও বহু গান রচনা ও সুর করেছেন। তার জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে তোঁয়াত্তে ক্যান লার, আঁরে হত ভাড়াইবা, বিয়ার পর নিয়ুম তোঁয়ারে, আঁর বাইক্কা টেঁয়া দে, আঁর বউরে আঁই কিলাইয়ুম, ও জেডা ফইরার বাপ, চল আঁরা ধাই, বানুরে জ্বি --, দেশে গেলে কইয়েনগো ভাইজান, আঙ্গো বাড়ি নোয়াখালীসহ এ রকম বহু গান।তার পাঁচ ছেলে ও পাঁচ মেয়ে। জীবদ্দশায় এ গুণী শিল্পী রাষ্ট্রের কোন পদক পাননি। এমনিতে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন তাকে পদক দিয়ে সন্মানিত করেছেন। মৃত্যুর আট বছর পর ২০০৮ সালে তিনি রাষ্ট্রেীয় একুশে পদকে পেয়েছিলেন। বেঁচে থাকতে এমন কোন পদককে তিনি তুচ্ছ করে গানকে উচ্চমাত্রায় নেয়ার ক্ষেত্রে সাধনা করে গেছেন। সরল ও সাদামাটা জীবনে গানই তার আত্মার খোরাক ছিল। যত দিন চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থাকবে, তত দিন শ্যাম সুন্দর বৈঞ্চব মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবেন। দুঃখ হয় আমাদের চট্টগ্রামে একটা টেলিভিশন কেন্দ্র আছে! কিন্তু, বহু জনের ছবি টাঙানো থাকলেও শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব ও শেফালী ঘোষের ছবি স্থান পায়নি। এ টেলিভিশনের ঢাকা কেন্দ্রিকতা আমাদের ব্যথিত করে।এ গুণী সুর, গানের সম্রাট দীর্ঘ দিন অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু, কারো কাছে সাহায্য নিয়ে বেঁচে থাকার করুণা চাননি। ২০০০ সালের ৪ ডিসেম্বর তিনি আমাদের ছেড়ে যান। আজ ৪ ডিসেম্বর তার ২৪তম মৃত্য বার্ষিকীতে জানায় বিনম্র শ্রদ্ধা। তিনি বেঁচে থাকবেন তার সৃষ্টিতে। লেখক: অভিনেতা, নাট্যকর্মী, চট্টগ্রাম।

জুলাই গণ অভ্যুত্থান ও স্বৈরাচারের পতন
এনএম ফখরুদ্দীন: ২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্ট ২০১৮ সালের সরকারের কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেওয়ার প্রতিবাদে ও কোটা বাতিলের দাবীতে দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থী ও চাকুরী প্রত্যাশীরা বিক্ষোভ করে এবং আন্দোলনকারীরা সরকারকে দাবী মানতে ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়। ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে অংশ নেয় এবং তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। ২-৬ জুলাই দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ হয়। ৭ জুলাই ‘বাংলা ব্লকেড’ ঘোষিত হয়। এরপর সারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্থানে রাজপথে আলাদাভাবে এই আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত অংশ নেয়। ছাত্রদের এই আন্দোলনের সাথে একের পর এক বিভিন্ন পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিমনা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল সংহতি প্রকাশ করতে থাকে। ফলে, এক পর্যায়ে এই আন্দোলন গণ অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। ১৪ জুলাই ঢাকায় পদযাত্রা ও রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। ওই দিন কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্যের প্রতিবাদে মধ্যরাতে ঢাবির ক্যাম্পাস এলাকায় শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়া এই আন্দোলন দমাতে সরকার কঠোর অবস্থানে অটল থাকায় পুলিশের গুলিতে ২০০’র বেশি ছাত্র-ছাত্রী আহত হওয়ার খবর আসে। এরপর থেকে একের পর এক সহিংসতার ঘটনা ঘটতে থাকে। ১৭ জুলাই ইউজিসি সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। সরকার সারা দেশে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রাখে। ১৮ জুলাই কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ১৯ জুলাই সরকার কারফিউ ও অনির্দিষ্টকালের জন্য সভা, সমাবেশ ও মিছিল বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়। ২৩ জুলাই পর্যন্ত ছয় দিন ইন্টারনেট সেবা অচল রাখা হয়। ২৪ জুলাই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু হলেও মোবাইল ইন্টারনেট অফ থাকে। এ দিকে, দেশে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী নিহত,অগণিত আহত ও ভুরিভুরি গণ গ্রেফতারের খবর ছড়িয়ে পড়ে। ২৬ জুলাই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামসহ তিন সমন্বয়ককে আটক করা হয়। ২৯ জুলাই পর্যন্ত আরো তিন জন সমন্বয়ক গ্রেপ্তারসহ বহু নাটকীয় ঘটনার পাশাপাশি হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ৩০ জুলাই সরকার ঘোষিত শোক দিবসকে প্রত্যাখ্যান করে ছাত্র জনতা। সেদিন আন্দোলনকারীরা শোকের কালো ব্যাজের বদলে সকলের ফেইসবুক আইডিতে লাল প্রোফাইলের ছবি ছড়িয়ে দিয়ে অন্য রকম প্রতিবাদ জানায়। এই লাল রংটি রাজপথে রঞ্জিত শত শত আহত ও নিহত শিক্ষার্থীদের লাল রক্তের প্রতীকী রং হিসেবে চিহ্নিত হয়। ৩১ জুলাই ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ (ন্যায় বিচারের জন্য পদযাত্রা) কর্মসূচি চলে। এ দিকে, ডিবির অফিসে হেফাজতে থাকা ছয় সমন্বয়ক আটক অবস্থায় অনশন কর্মসূচি শুরু করলে তাদেরকে শেষ পর্যন্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সরকার। ছয় সমন্বয়কের মুক্তির পর সব হিসাবনিকাশ উলটপালট হয়ে যায়।সারা দেশে ছাত্র জনতার উপর হত্যা, গণ গ্রেপ্তার, হামলা-মামলা, গুম-খুন ও শিক্ষকদের উপর হামলার প্রতিবাদে ১ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা নয় দফা দাবী ঘোষণা করে। অবস্থা বেগতিক দেখে ৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী আলোচনার প্রস্তাব দেন। কিন্তু, সমন্বয়করা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জানান, ‘গুলি আর সন্ত্রাসের সাথে কোন সংলাপ হয় না!’ সংলাপের পরিবর্তে শিক্ষার্থীরা এক দফা, এক দাবী নিয়ে মাঠে নামে। তাদের দাবী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ। এই এক দফার দাবীতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী, শিশু, কিশোর, তরুণ-তরুণী, আবাল-বৃদ্ধ-বর্ণিতা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জড়ো হয়। সেদিন ৩ আগস্ট বিকাল পাঁচটার দিকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম উপস্থিত সকলের পক্ষ হয়ে প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রী সভার পদত্যাগের এক দফা দাবী আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন। এ দিকে, রংপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম একজন সমন্বয়ক বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের মৃত্যু ও ঢাকার উত্তরায় আন্দোলনকারীদের মাঝে পানি সরবরাহ করা অবস্থায় মুগ্ধের নিহত হওয়ার মত কিছু হৃদয় বিদারক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দেশবাসী প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে।আন্দোলনকারীদের দমাতে বিভিন্ন স্থানে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করার নিউজ ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকার শনির আখড়ায় বিল্ডিংয়ের ছাদে খেলা করা অবস্থায় হেলিকপ্টার থেকে গুলিতে শিশু হত্যার খবরও আসে। চট্টগ্রামের ষোলশহর, মুরাদপুর, বহদ্দারহাট ও চট্টগ্রাম কলেজ এলাকায় গুলিতে ও সংঘর্ষে পথচারীসহ নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। তাছাড়া আন্দোলনের বহু লোমহর্ষক দৃশ্য ও সহিংসতার ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হতে লাগল। দ্রুত আরও হতাহত বৃদ্ধির খবর ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। ৪ আগস্ট ঢাকার শাহবাগ এলাকা এবং সিটি কলেজ এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। একই দিন চট্টগ্রাম সিটির নিউমার্কেট এলাকায়ও ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এভাবে সারা দেশে আরো বহু হতাহতের ঘটনা চলতে থাকে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলন দমাতে সরকার ৫, ৬ ও ৭ আগস্ট তিন দিনের কারফিউ ও সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেন। কিন্তু, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা এসব অবজ্ঞা করে নতুন কর্মসূচি ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ ঘোষণা করে। প্রথমে ৬ আগস্ট পালন করার কথা থাকলেও পরে তা ৫ আগস্ট করা হয়। তাই, ৫ আগস্ট কারফিউ অমান্য করে বেলা ১১টার পর সারা দেশে থেকে শিক্ষার্থীরা ও সাধারণ জনগণ ঢাকার শাহবাগে জমায়েত হতে থাকে। তারপর শাহবাগ থেকে আন্দোলনকারীরা গণভবনের দিকে পদযাত্রা শুরু করে। শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট দুপুর দুইটার দিকে পদত্যাগ করে এবং আড়াইটার দিকে হেলিকপ্টারযোগে ভারতে পালিয়ে যান। এভাবে স্বৈরাচারের পতন হয়। ২০২৪ সালের জুলাই গণ অভ্যুত্থানের (১৮ জুলাই থেকে ৩৬ জুলাই পর্যন্ত) এই রক্তাক্ত ইতিহাস বাঙালি জাতির নিকট চিরস্মরণীয় থাকবে। লাল প্রোফাইলের এই কাহিনীতে যে গণহত্যা ও নির্যাতন হয়েছিল, তা একাত্তরের কাহিনীকেও যেন হার মানিয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে এখন পর্যন্ত এক হাজার ৫৮১ জন নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গিয়েছে। আহতদের সংখ্যা অগণিত। কতই মর্মান্তিক! কতই না হৃদয় বিদারক ঘটনা! আমি চব্বিশের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত ও আহত সবাইকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি ও শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। লেখক: অধ্যক্ষ, বোয়ালখালী হাজী মো. নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ, শাকপুরা, বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম।

দুটি দিবসের প্রস্তাব, ছুটিও চান পিনাকী
দুটি দিবসে ছুটির প্রস্তাব করেছেন সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট ও লেখক পিনাকী ভট্টাচার্য। বুধবার (১৬ অক্টোবর) নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে এ প্রস্তাব দেন তিনি। ফেসবুকে পোস্টে পিনাকী লিখেছেন, ‘বাতিল হচ্ছে আট জাতীয় ছুটি। আমি ১৫ আগস্টের ছুটি চাই। ওইদিন হবে ‘নাজাত দিবস’। বাকশালের জিঞ্জির থেকে জাতির মুক্তির দিবস। আর পাঁচই আগস্ট ফ্যাসিবাদ পতন দিবস বা মহান পলায়ন দিবস।’ ফেসবুক পোস্টে পিনাকী আরও লিখেছেন, ‘কে কে আমার প্রস্তাব সমর্থন করেন?’ এদিকে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে বাতিল করছে জাতীয় শোক দিবস, শিশু দিবস ও ঐতিহাসিক ৭ মার্চসহ আটটি দিবস। গত সেপ্টেম্বরে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে সরকার এসব জাতীয় দিবস বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বাতিল হওয়া আটটি দিবসের মধ্যে পাঁচটিই শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যদের জন্ম ও মৃত্যু সংক্রান্ত। এর মধ্যে ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম দিবস ও জাতীয় শিশু দিবস, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার ভাই শহীদ ক্যাপ্টেন শেখ কামালের জন্মবার্ষিকী, ৮ আগস্ট শেখ হাসিনার মা বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মবার্ষিকী, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস, ১৮ অক্টোবর শেখ হাসিনার ছোট ভাই শেখ রাসেল দিবস। এ ছাড়া বাতিলের তালিকায় রয়েছে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, ৪ নভেম্বর জাতীয় সংবিধান দিবস ও ১২ ডিসেম্বর স্মার্ট বাংলাদেশ দিবস।

রিজার্ভ চুরির তদন্ত রিপোর্ট কতবার পিছিয়েছে জানা নেই
সাগর রুনি হত্যার তদন্ত রিপোর্ট একশো বারেরও বেশী পিছিয়েছে। কি করে আশা করা যায় যে, একই লাইনআপ রেখে এই বিচারটা হবে! বেহেস্ত যাওয়া সহজ। কিন্তু এই বিচার অসম্ভব! বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করার সময় কতবার পিছিয়েছে জানা নেই। কারণ যারা এর সুবিধা ভোগী তারা যে নিজে চেয়ারে বসে এর বিচার করবে না, এটা নিয়ে অগ্রসর হবে না, এটা জানাই। তাই কোন আগ্রহ নাই। সেদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগকৃত লোকদের বিদায় নিতে বলে সাধারণ চাকুরেরা। কারণ তারা একটা স্বচ্ছ এবং দুর্নীতিমুক্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেখতে চায়। দুর্নীতি এবং দুর্নীতিবাজদের চেহারা ও দাপট দেখতে দেখতে এরা ক্লান্ত। বিরক্ত। ক্লান্ত না তারাই যারা এদের কাছ হতে প্রচুর সুযোগ নিয়েছে। পা চেটেছে। মাসে মাসে বিদেশ ট্যুর বাগিয়ে নিয়েছে। অনেকে আবার বিদেশে গিয়ে হোটেল সঙ্গীও হয়েছে কারো কারো। হ্যাঁ। বুঝেই বলছি। কোন রাগ বা অভিমান থেকে না। আজ সকালে রমনায় কয়েকজন জুনিয়রের সাথে দেখা। কথা প্রসঙ্গে জানালো, বিতাড়িতদের ভেতর হতে দুজন নাকি, একজন উপদেষ্টার বাসায় গেছে। তার পা ধরেছে ফিরে আসতে! ওরাই জানালো, ২০০ জনের একটা লিষ্টও করেছে এইচআরডি, যারা তাদের বিতাড়িত করেছে, তার মধ্য হতে। এদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিবে! তেল বের করে ছাড়বে! সত্য হলে ব্যাপারটা উদ্বেগের! বেশ উদ্বেগের! এরা যে কোন কিছুই করতে পারে। গোপালগঞ্জ এবং মাদারীপুরের দুজন নেতা গোছের কর্মকর্তা নাকি তাতে উৎসাহ দিচ্ছে। এদের মধ্যে একজন এইচআর এই কাজ করে! ডিজি কাজী ছাইদুর রহমানের নির্দেশেই নাকি তা করছে! আচ্ছা ধরা যাক এই ২০০ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলো ফিরে এসে। সুবিধা ভোগীরা চুপ থাকলো বা পেছন হতে এদের লাত্থি মারলো, তাতে কি এই কম্পাউন্ডটা সহীহ শুদ্ধ হয়ে যাবে! উত্তরটা হচ্ছে না। ডিজি কাজী ছাইদুর রহমান এর বিরুদ্ধে ঐ সময় হওয়া আট মিলিয়ন ডলার রিজার্ভ চুরির সহায়তাকারী হিসেবে অভিযোগ রয়েছে। ফিরে এসে উনি কি চাইবে যে তার বিরুদ্ধে আসা তদন্তটা রিপোর্টটা আলোর মুখ দেখুক! উত্তরটা হচ্ছে না! দ্য গ্রেট আবু ফারাহ মোঃ নাসের ফিরে এলেন। যে সাবেক গভর্নর ফজলে কবির এর সহায়তা নিয়ে এস আলম এর মতো একটা দানব সৃষ্টি করেছে। দেশের ব্যাংকিং সেক্টর শেষ করে দিয়েছে। সে কি চাইবে যে তার বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগের তদন্ত হউক! উত্তর হচ্ছে না। জনতা ব্যাংকের টিম লিড দেয়ার সময় একবার ঐ ব্যাংকের এমডি সালাম সাব, দ্যা মোস্ট করাপ্ট ম্যান ইন ব্যাংকিং সেক্টর এবং একজন ডিএমডি, আসাদ নাম বোধ হয়, একটা দালাল এবং আমার টিমের সাথে ত্রিপক্ষীয় মিটিং হয় বোর্ড রুমে। এ মিটিংয়ে দরবেশ এবং এনন টেক্সের ব্যাপারে শক্ত অবস্থান নেয় আমার টিম। জনতার এমডির কথা শুনে মেজাজ হারাই। আশ্চর্য জনক ব্যাপার হলো, মি. ফারাহ তাদের পক্ষ নিয়ে আমাকে রীতিমতো নাজেহাল করে ছাড়ে! মনে হচ্ছিলো, এই লোক কি বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিজি, না জনতা ব্যাংকের এমডির সহকর্মী! এতো দালাল হয় কি করে! মিটিংয়ের মাঝেই ফজলে কবির সাব এর কল আসে দুই থেকে তিনবার! সে ফিরে আসলে কি সবাইকে নিয়ে ইমামতি করবে! উত্তরটা হচ্ছে না। মি. মাসুদ বিশ্বাস একজন আপদমস্তক, আপাদপেটওয়ালা দুর্নীতিবাজ! এটা সবাই জানে। এর জন্য কোন গবেষণা বা তদন্তের দরকার নেই। ব্যাংক কম্পাাউন্ডে গিয়া নাম বললেই যে কেউ এক নিঃশ্বাসে বলে দেবে, এইডা একটা চোর! প্রায় দেড় যুগ ধরে ক্ষমতার সুযোগ নেয়া এরা সবই একেকটা রাসেল ভাইপার। সবাইকেই এটা বুঝা উচিত। বিপদের মধ্যে এরা অলস ভান করে পড়ে থাকবে। আর সুযোগ পেলেই এমন ছোবল দেবে যে জানটা আর হইধামে থাকবে না! এরা কখনোই- "সুখের আশায় নাঙ্গ ধরিয়া ভাতার হারাবে না!" একটু সাবধানে। শেষ লাইনটা মিস লিটনের গানের কলি।যারা বেশী রুচিশীল তারা হয়তো মিস লিটনের গান শুনেন না। ছেলে মানুষ। মেয়েদের সুরে গান গায়। আমি শুনি। লেখক: গোলাম বহলুল, অতিরিক্ত পরিচালক বাংলাদেশ ব্যাংক।

কোটা জটিলতা নিরসনের জন্য আপিল বিভাগের রায়ের অপেক্ষা করা কি একান্ত জরুরি?
কিছুদিন থেকে শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। চারপাশের সব কিছু দেখে হাসপাতালের বেডে শুয়ে অনেক কিছুই ভালো লাগছে না। এই পরিবেশ-পরিস্থিতি কোনোভাবেই কাম্য ছিল না স্বাধীন বাংলাদেশে এত দিন পর। সাত ছাত্রের বেদনাদায়ক মৃত্যু স্তম্ভিত করেছে আমাদের সবাইকে। রংপুরের ঘটনাটি কেউই মানতে পারছেন না। ঘটে যাওয়া দুঃখজনক সব ঘটনাবলির বিচার এখন সময়ের দাবি। বিশ্বাস করি দ্রুত তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আমরা শান্তি ও স্বস্তির বাংলাদেশ দেখতে চাই। আর এ কারণে আমাদের কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের দাবিকে ইতিবাচক বিবেচনায় নিতে হবে। দ্রুততম সময়ে তা বাস্তবায়ন করে নিরসন করতে হবে চলমান সংকটের। অন্যথায় স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জনই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একজন লেখক হিসেবে মনে করি কোনো কিছু অসম্ভব নয়। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নিলেই সম্ভব। একজন সংবিধান বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বললাম। জানতে চাইলাম কোটা জটিলতা নিরসনের জন্য আপিল বিভাগের রায়ের অপেক্ষা করা কি একান্ত জরুরি? আমাকে সেই বিশেষজ্ঞ বললেন, রাষ্ট্র ও সরকার জরুরি মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এই সংবিধান, বিচার বিভাগ জনগণের জন্য। আমাদের কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের দাবি নিয়ে আর সময়ক্ষেপণ নয়। দ্রুত সিদ্ধান্তে আসতে হবে। বন্ধ করতে হবে সব রক্তপাত, সংঘাত, সংঘর্ষ। আদালতের ওপর নির্ভরশীলতা নিয়ে আমার একজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ বন্ধু জানালেন, সরকার চাইলে এক ঘণ্টার মধ্যে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে কোটা বিষয়ে অধ্যাদেশ প্রণয়ন করে বর্তমান রক্তপাত বন্ধ করতে পারে। কোটা বিষয়ে অধ্যাদেশ প্রণয়ন হাইকোর্টের রায়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে না। এমনকি কেউ যদি মনে করেন অধ্যাদেশ প্রণয়ন হাইকোর্টের রায়ের সাংঘর্ষিক বা আপিল বিভাগে বিচারাধীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ হবে, তাদের উদ্দেশ্যে সবিনয়ে বলতে চাই, রাষ্ট্রপতির (প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে) যে কোনো বিষয়ে অধ্যাদেশ প্রণয়নের সাংবিধানিক ক্ষমতা হাইকোর্ট বা আপিল বিভাগ খর্ব করতে পারে না। তবে অধ্যাদেশটি সংবিধানসম্মত কীনা তা আদালত বিচার করতে পারে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ বন্ধু আরও বললেন, কোটা বিষয়ে আমার জানা মতে, কোনো আইন (জাতীয় সংসদে পাস করা আইন বা অধ্যাদেশ) নেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে কোটা বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে অধ্যাদেশ (আইন) প্রণয়ন করা আবশ্যক। আদালতের রায়ের অপেক্ষা করা বা সংসদের পরবর্তী অধিবেশনের অপেক্ষা করা বর্তমান সংঘর্ষকে আরো দীর্ঘায়িত করতে পারে। সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষকদের মধ্যে যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে তা গৌরবের প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটসহ সব বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংস করে দিবে। সংবিধানের আর্টিকেল ৯৩ রাষ্ট্রপতিকে অর্ডিন্যান্স (আইন) প্রণয়নের যে বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করেছে। ৯৩(১) অনুচ্ছেদে রয়েছে ‘সংসদ ভাঙিয়া যাওয়া অবস্থায় অথবা উহার অধিবেশনকাল ব্যতীত কোনো সময়ে রাষ্ট্রপতির নিকট আশু ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি বিদ্যমান রহিয়াছে বলিয়া সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হইলে তিনি উক্ত পরিস্থিতিতে যেরূপ প্রয়োজনীয় বলিয়া মনে করিবেন, সেইরূপ অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারি করিতে পারিবেন এবং জারি হইবার সময় হইতে অনুরূপভাবে প্রণীত অধ্যাদেশ সংসদের আইনের ন্যায় ক্ষমতাসম্পন্ন হইবে : তবে শর্ত থাকে যে, এই দফার অধীন কোনো অধ্যাদেশে এমন কোনো বিধান করা হইবে না, (ক) যাহা এই সংবিধানের অধীন সংসদের আইন-দ্বারা আইনসঙ্গতভাবে করা যায় না;(খ) যাহাতে এই সংবিধানের কোনো বিধান পরিবর্তিত বা রহিত হইয়া যায়; অথবা(গ) যাহার দ্বারা পূর্বে প্রণীত কোনো অধ্যাদেশের যে কোনো বিধানকে অব্যাহতভাবে বলবৎ করা যায়।(২) এই অনুচ্ছেদের (১) দফার অধীন প্রণীত কোনো অধ্যাদেশ জারি হইবার পর অনুষ্ঠিত সংসদের প্রথম বৈঠকে তাহা উপস্থাপিত হইবে এবং ইতঃপূর্বে বাতিল না হইয়া থাকিলে অধ্যাদেশটি অনুরূপভাবে উপস্থাপনের পর ত্রিশ দিন অতিবাহিত হইলে কিংবা অনুরূপ মেয়াদ উত্তীর্ণ হইবার পূর্বে তাহা অননুমোদন করিয়া সংসদে প্রস্তাব গৃহীত হইলে অধ্যাদেশটির কার্যকরতা লোপ পাইবে।’’ লেখক হিসেবে এত সংবিধান বুঝি না। দেশটা বুঝি। মানুষের কষ্ট বুঝি। দেশের কোনো খারাপ কিছু চোখে পড়লে মনটা কেঁদে উঠে। সব কিছু এলোমেলো মনে হয়। বাংলাদেশ একটা কঠিন সময় অতিক্রম করছে। আর কোনো মায়ের কোল খালি হতে দেওয়া যাবে না। সংঘাত তৈরি করে তৃতীয় কোনো সুযোগ সন্ধানীকে মাঠে নামতে দেওয়া যাবে না। তাই দেশের স্বার্থে, আগামীর সুন্দর বাংলাদেশ ধরে রাখার জন্য মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিনয়ের সঙ্গে আবেদন দ্রুত উদ্যোগ নিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোমলমতি ছাত্রছাত্রীরা আমাদের সন্তান, আমাদের আগামী। রংপুরের বেদনাবিধুর ঘটনাটি কেউই মেনে নিতে পারছে না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে হিসেবে আপনি পারেন অনেক কিছু করতে। রংপুরসহ সব হত্যার বিচারের ব্যবস্থা নিন। আর যত দ্রুত সম্ভব আদালতের জটিলতাকে সরিয়ে সংবিধানে আপনাকে দেওয়া ক্ষমতাবলে সিদ্ধান্ত নিন। খেয়াল রাখুন এ ঘটনায় কেউ যাতে অপব্যবহার না করতে পারে। বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে, এগিয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্ক বন্ধ করতেই সংকটের দ্রুত নিরসন প্রয়োজন।

বিমান একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, লিল্লাহ বোডিং নয় : পলাশ রহমান
ইতালি : পত্রিকায় দেখলাম ঢাকা থেকে ২শ যাত্রী নিয়ে রোমে এসেছে বাংলাদেশ বিমান। প্রশ্ন হলো- এই ২শ যাত্রী কারা? এতগুলো যাত্রী কোথায় পেলো বিমান? রোম বা ইতালি থেকে যারা দেশে যান তাদের শতভাগ যাত্রীই রিটার্ন টিকেট করে যান। সুতরাং রোম থেকে অন্য কোনো এয়ারে দেশে গিয়ে- ফিরেছেন বিমানে, তা যেমন হবে না, একই ভাবে ওই ২শ জন নতুন যাত্রী হওয়ারও সুযোগ কম। কারণ একদিনে ২শ নতুন যাত্রী ঢাকা থেকে রোম সফর করার কথা নয়। যারা ঢাকা থেকে রোমে এসেছেন প্রথম ফ্লাইটে তাদের প্রায় ১শ জন ভেনিসে এসেছিলেন শনিবার। তারা একটা রেষ্টুরেন্ট ভাড়া করে ইফতারের আয়োজন করেন। ব্যানারে লেখেন- মিট দ্যা প্রেস। কিন্তু স্থানীয় সাংবাদিকদের অভিযোগ বিমানের কর্মকর্তারা তাদের সাথে বা কম্যুনিটির সাথে কোনো কথা বলেননি। সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার সুযোগ রাখেননি। রাজনৈতিক ঢংগে কিছু বক্তৃতা শুনিয়ে তারা শেষ টেনেছেন। এমন কী প্রবাসীদের সাথে বসে ইফতারিও করেননি, করেছেন আলাদা জায়গায়। ২০১৫ সালে ঢাকা-রোম রুটের বিমান সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায়। কারণ লোকসান হচ্ছিলো। ৯ বছর পরে তা ফের চালু হয়েছে। এবার লোকসান না হওয়ার নিশ্চয়তা কী? ব্যবসায়িক ডিজাইন কী? আগে কেনো লোকসান হয়েছিলো, তা কী চিহ্নিত করা হয়েছে? সেগুলোর সমাধানে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে? কেনো বিমানের টিকেট কিনতে গেলে পাওয়া যায় না, অথচ সিট ফাকা থাকে? ভেনিসসহ বাংলাদেশিবহুল শহরগুলোর সাথে কী কোনো ভাবে বিমানকে কানেক্ট করা হবে? যেমন, এক টিকেটে ভেনিস থেকে একজন যাত্রী কী রোম হয়ে ঢাকা যেতে পারবে? কথিত ২শ যাত্রীর আড়ালে কী কোনো আদম ব্যবসা হয়েছে? বিমানের অনুষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ কেনো প্রবাসী আওয়ামীলীগ নেতাদের হাতে ছিলো? অন্যান্য সামাজিক, রাজনৈতিক দলের নেতাদের দেখা যায়নি কেনো? সরকারী দল করে না, এমন যাত্রী কী বিমানের দরকার নেই? বিমান কী রাষ্ট্রয়ী প্রতিষ্ঠান, নাকী দলীয় প্রতিষ্ঠান? এমন একগাদা প্রশ্ন পেটে নিয়ে দম আটকে বসে ছিলেন সাংবাদিকরা। প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ তাদের দেয়া হয়নি। কেউ কেউ বলে ফেলেছেন, প্রশ্ন করা না গেলে এ আবার কেমন তরো ‘মিট দ্যা প্রেস’? একটা প্রেস রিলিজ পাঠিয়ে দিলেই তো হতো। এত টাকা খরচ করার কী দরকার ছিলো? বিমানের বিরুদ্ধে যাত্রীদের মোটা দাগে অভিযোগ তিনটি। টিকেট না পাওয়া, সময় মতো ফ্লাইট না ছাড়া এবং সার্ভিস খারাপ। আমরা সোস্যাল মিডিয়ায় দেখেছি বিমানের মধ্যে কারেন্টের ব্যাড দিয়ে মশা মারতে। আমার এক বন্ধু জানিয়েছেন, ডায়াবেটিকের শরীর নিয়ে বিমানের সারপোকার কামড় খেয়ে তাকে দীর্ঘ দিন চিকিৎসা নিতে হয়েছে। এই অভিযোগগুলো যে সত্যি তার বড় প্রমাণ হলো বিমানের মধ্যে যাত্রীদের ছবি তোলা, ভিডিও করা নিষেধ করেছে কর্তৃপক্ষ। যাত্রীরা কেনো ছবি তুলতে পারবে না? কী লুকাতে চায় কর্তৃপক্ষ, তা বুঝতে বেশি বুদ্ধির দরকার হয় না। সবাই পারলে বিমান কেনো সময় মতো ফ্লাইট ছাড়তে পারে না? ঘাপলা কোথায়? বিমানের টিকেট পাওয়া যায় না কেনো? যাত্রীরা বলেন, কিনতে গেলে টিকেট নেই, বিমানে চড়লে দেখা যায় শতশত সিট খালি? ঘটনা কী? অন্যান্য দুর্নীতির বাইরে সম্ভবত এখানেই লুকিয়ে আছে বিমানের লোকসান গোনার অন্যতম কারণ। বিমান হয়তো এখনো লটম্যান বিক্রি করে। এজেন্টদের কাছে বড় সংখ্যার সিট দিয়ে রাখে এবং তারা ওগুলো আটকে রাখে। শেষ পর্যন্ত সব সিট তারা বিক্রি করতে পারে না। লোকসান গুনতে হয় বিমানকে। এই পদ্ধুতিতে এয়ারলাইনগুলো ব্যবসা করতো অনেক আগে। এখন আর কেউ করে না। প্রযুক্তি এখন অনেক এডভান্স। টিকেট বুকিং দিয়ে বেশি সময় রাখা যায় না। পেমেন্ট না দিলে সফটওয়্যার অটোমেটিক বুকিং ক্যানসেল করে দেয়। এমন কী বেনামেও টিকেট কিনে রাখা যায় না। যাত্রীর নামের বানান দুই অক্ষরের বেশি সংশোধন করা যায় না। অর্থাৎ বুকিং দিয়ে সিট আটকে রাখার দিন অনেক আগে ফুরিয়ে গেছে। হয়তো বিমানের বেলায় ফুরায়নি এখনো। ফলে টিকেট নিকতে গেলে নেই, অথচ সিট ফাকা থাকে। বিমান কর্তৃপক্ষ বলেন, নন পিক সিজনে সিট খালি যায় বা যেতে পারে। কিন্তু টিকেট কিনতে চাইলে কেনো পাওয়া যায় না, সে ব্যাখ্যা তারা দেন না। এতেই বোঝা যায়- বিমানের বোয়িং নতুন বা আধুনিক হলেও সফটওয়্যার (মানুষগুলো) আগের মতোই আছে। এখানে একটা বিষয় পরিস্কার বুঝতে হবে- বিমান কোনো আবেগ বা আলগা দেশপ্রেমের জায়গা না। এটা একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এর কোটি কোটি টাকার লোকসান দেশের মানুষকেই গুনতে হয়। দেশের মানুষের মাথায় উচ্চ সুদে ঋণের বোঝা চাপিয়ে বোয়িং কিনতে হয়। বিমান কোনো লিল্লাহ বোডিং নয়। আশা করি লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে বিমানকে ঢাকা-রোম রুটের ফ্লাইট ফের বন্ধ করতে হবে না। তবে তাদের বিজনেস ডিজাইন খুব বেশি চিন্তা করে করা হয়েছে বলে মনে হয় না। বিমান সপ্তাহে ৩টা ফ্লাইট পরিচালনা করবে ঢাকা-রোম রুটে। অর্থাৎ বিমানে যেতে চাইলে যাত্রীদের ওই তিন দিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। মাসে ১২টা ফ্লাইটের জন্য রোমে একগাদা কর্মকর্তা/কর্মচারি, অফিস-টফিস পালতে হবে। তাছাড়া ফ্লাই এবং ল্যান্ডের সময়ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কে চাইবে বিকল্প থাকার পরেও রাত একটা/দেড়টায় ঢাকায় নামতে? এত রাতে ঢাকায় নেমে যে বিপদে পড়বে একজন যাত্রী, সে দায় কে নেবে? বিমান কী পারবে অন্যান্য এয়ারলাইনের তুলনায় কম দামে (অন্তত বেশি না) টিকেট বিক্রি করতে? বিমান কী পারবে যাত্রীদের লাগেজ ওয়েট নিয়ন্ত্রণ করতে? সত্যিকারার্থে বিমানে বাংলাদেশিরা কেনো যায় জানেন? অন্য এয়ারে লাগেজের ওজন এক কেজি বেশি হলেও বাড়তি টাকা দিতে হয়। কিন্তু বিমানে দলের পরিচয়, মামা, চাচার পরিচয়, হাম্বিতাম্বি বা হাতের মুঠে হালকা কিছু গুজে দিয়ে পার পাওয়া যায়। (অতীতে এমন হয়েছে) এগুলো বন্ধ করতে না পারলে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিমান চলবে না। পত্রিকায় দেখেছি, ইরানের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থাকায় বিমান ইরানের আকাশ পথ ব্যবহার করতে পারছে না। অন্য পথে যেতে হলে সময় এবং খরচ দুইটাই বেড়ে যায়। এই সমস্যার সমাধান কী হয়েছে? কীভাবে হয়েছে, তা জানা যায়নি। যদি খরচ বাড়িয়ে বিমান চালাতে হয়, তবে শুরুতেই তো লোকসানের মধ্যে পড়লো বিমান, লাভ করবে কীভাবে? ব্যানারে মিট দ্যা প্রেস লিখলেও বিমান কর্তৃপক্ষ ভেনিসে মূলত ইফতার পার্টি করেছেন, আর সরকারের কিছু গুণকীর্তন শুনিয়েছেন কম্যুনিটিকে। এর বাইরে কেনো তারা এই আয়োজন করেছেন তা পরিস্কার নয়। অনেকে বলাবলি করেছেন, রাষ্ট্রীয় খরচে তাদের বিশাল বহরের ভেনিস সফর হালাল করতে এই আয়োজন করা হয়েছে। কারণ বিমানের যদি প্রচার প্রচারণা করতেই হয়, রোমসহ আসপাশের বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকায় করবে, ভেনিসে কী? এত মানুষ নিয়ে কিসের প্রচার? রোম থেকে ভেনিসের দুরত্ব ৫শ কিলোমিটারের বেশি। ভেনিস এয়ারপোর্ট থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩টা ফ্লাইট (আমরিাত, তুর্কি) ছাড়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে। কে যাবে রোমে বিমানের যাত্রী হতে? শেখ হাসিনা দেশে ইফতার মাহফিলে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন কৃচ্ছ্রসাধনের জন্য। বিদেশে এসে তার নেতা-আমলারা কী করলেন? কতো কী কৃচ্ছ্রসাধন করলেন? এর জবাবদিহিতা কী তিনি জনগণকে দেবেন? ভেনিসে বিমানের অনুষ্ঠানে সবেচেয়ে বেশি অস্থির ছিলেন রোম আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক। ঢাকার এমপি, সচিবদের আদর-যত্ন দিতে তার মাত্রাতিরিক্ত অস্থিরতা সবার চোখে পড়েছে। সাংবাদিকদের সাথেও খারাপ ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। এমন কী ভেনিস বাংলাদেশ প্রেস ক্লাবের সভাপতি কথা বলতে চাইলে, সেখানেও তিনি বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। স্বাগতিক কম্যুনিটির প্রতিনিধি হিসাবে ভেনিস আওয়ামীলীগের সভাপতিকেও দু’মিনিট কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়নি। যা অনেকের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। ঢাকাওয়াচ/টিআর

দেশ প্রেমের অমর কাব্য : তুহিন মাহামুদ
বাঙ্গালি জাতির বড় পরিচয় “তিনি একজন বাঙ্গালি ” আর এই বাঙ্গালির রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে মোড়ানো শাশ্বতকালের এক উন্নত সংস্কৃতি। যে সংস্কৃতির পথ ধরে অহংকার মাখা হৃদয় নিয়ে মাথা উঁচু দাঁড়িয়েছে বিশ্বের দরবারে। বাঙ্গালি জাতির ওপর বার বার আঘাত এসেছে!অসংখ্যবার এই সংস্কৃতির ওপর অপসংস্কৃতির ধাক্কা লেগেছে!কখনও কখনও রক্তাক্ত আবার কখনও কোনঠাসা হয়েছে। কিন্তু আদর্শচূত হয়নি বরং দিনে দিনে আরও শাণিত তলোয়ারের মত ধারালো চক চক হয়ে উঠছে। ব্রিটিশ সামাজ্রবাদের আগ্রাসনে অনেকটা শব্দ ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও সেটাকে বুকের মধ্যে আটকে রেখে বাঙ্গালির রুপ, রস কাঁদা মাটির মত সংস্কৃতির সাথে মিশিয়ে ভিন্ন মাত্রায় যোগ হয়েছে। সমাদৃত হয়েছে বিশ্ব সংস্কৃতির কোলে। আমরা হয়েছি উন্নত সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। যার বহি:প্রকাশ ঘটে প্রবাসের মাটিতে নিজস্ব সংস্কৃতির আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে আমরা যখন বাংলা কথা বলি। বিশ্বের মধ্যে আমরাই একমাত্র জাতি। যে জাতি তার ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে। এটি ইতিহাস বিরল রক্তের ওপর পা রেখে বাঙ্গালি জাতি ভাষার জন্য লড়াই করেছে এবং জয়ী হয়েছে। মাতৃত্বের টান আর দেশপ্রেমের গভীর ভালোবাসায় জীবনকে তুচ্ছার্থক ভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে সংস্কৃতিকে রক্ষা করেছে। তবুও বাঙ্গালি জাতি শান্তিতে ঘুমাতে পারেনি!আঘাত এসেছে দেশের ওপর, অস্তিত্ব রক্ষায় আবার রক্তের সাগরে মুক্তির জন্য সাতার কাটতে হয়েছে। জীবন দিতে হয়েছে অসংখ্য নারী-পুরুষ,শিশু-কিশোর আবাল বৃদ্ধ বণিতা সকলকে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা নেই যে বাঙ্গালি জাতির মত এত রক্ত, এত প্রাণ দিতে হয়েছে। শেয়ালের মত নারীর দেহ লুটেপুটে খেয়েছে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীরা। তবুও বাঙ্গালি জাতি মাথা নিচু করেনি বরং আরও দেশ প্রেমে উজ্জ্বিবিত হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে প্রতিবাদী রূপে । বাঙ্গালি জাতির ইতিহাস বড় নির্মম। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে সময়ের ভাঁজে জড়িয়ে আছে আন্দোলন ও সংগ্রামের ইতিকথা!এই সংগ্রামের মাধ্যমেই সাফল্য অর্জন করেছে যুগে যুগে!!আমরা তারই পথ ধরে আজকে এখানে এসে দাঁড়িয়েছি। আমার বড় পরিচয় আমি বাঙ্গালি আমি বাংলাদেশী! বাঙ্গালি হিসেবে গর্ববোধ করি,কেননা আমার রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য! আমি বাংলাদেশী আমি বীরত্ব অনুভব। করি, কারন আমার রয়েছে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক রক্তাক্ত ইতিহাস। যে ইতিহাসের গৌরবময় গোড়ায় দাঁড়িয়ে আত্নাংহকারে লাল সবুজের পতাকা উড্ডায়ন করি নির্মল বিশ্বাকাশে। আমাদের সংস্কৃতির ঊর্বরতায় বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটেছে!সুগম হয়েছে জাতীসত্ত্বা বিকাশের বিস্তৃত পথ!আর তারই চেতনার দীপ্ততায় সমুজ্জ্বল রয়েছে আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গন। আমরা খু্ঁজে পাই নতুন পথের ঠিকানা। যে পথ আমাদের বাঁচতে শেখায় চেতনাকে জাগিয়ে তোলে উজ্জ্বলিত করে সংকটময় অমানিশার ঘরে। ১৯৭১ সাল ২৫ মার্চের কালো রাত্রিতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী যে বর্বরোচিত হত্যাকান্ড ঘটায় তা ইতিহাসের বিরল!নীরিহ ঘুমন্ত বাঙ্গালি জাতির ওপর ঝাপিয়ে পরে নির্বিচারে হত্যা করা হয় বাঙ্গালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের!মেধাশূণ্য কঙ্কাল রাস্ট্রে পরিণত করে বাঙ্গালী জাতিকে নিঃশেষ করতে চেয়েছিলো। কিন্তু বাংলার মুক্তিকামী দামাল ছেলেরা ঝাপিয়ে পরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর!আর এর নেতৃত্ব যিনি দিয়েছেন তিনি সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ দেশের সোনার ছেলেরা জীবনের মায়া ত্যাগ করে দেশ উদ্ধারের জন্য যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত এবং দু’লক্ষ মা বোনের সংভ্রমের বিনিময় অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। বিশ্বের মানচিঁত্রে স্হান পায় স্বাধীন স্বার্বভৌম রাস্ট্র” বাংলাদেশ” । এ দেশ আমার, আপনার আমাদের সকলের, কিন্তু যাদের আত্নত্যাগ আর প্রাণ বিসর্জনের মধ্যে দিয়ে যে বাংলাদেশের জন্ম, সে বাংলাদেশে বার বার আঘাত এসেছে। তবুও আমরা বিচলিত হইনি। আমাদের সামনে অপার সম্ভবনা রয়েছে! তরুন সমাজ আজ দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্ব স্ব অবস্হানে থেকে কর্ম সংস্হান খুলেছে । প্রবাসীরা রেমিটেন্সের মাধ্যমে উল্লেখ যোগ্য ভূমিকা রাখছে । যে যেভাবেই দেখুক আর বলুক দেশে সত্যই অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটেছে তা অনিস্বীকার্য। আমাদের দেশের সেনা বাহিনী সত্যিই গর্বের । এরা দেশের গর্বিত সন্তান, তাদের কে উৎসাহিত এবং কার্যকর করার জন্য বঙ্গবন্ধুর তনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার সাবমেরিন এনেছে । এটি সময়োপযোগী প্রশংসনীয় একটি কার্যকর পদক্ষেপ । আমাদের সমাজে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে “ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম একজন যোদ্ধা” , ঠিক তেমনি আমাদের দেশে নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, সেনাবাহিনী রয়েছে কিন্তু শত্রু মোকাবেলা করার জন্য তাদের হাতে কোন ব্যবস্থা নেই । আজ সাবমেরিন এসেছে আগামিতে আরও উন্নত কিছু আসবে যা বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষায় কাজ করবে। আমাদের দেশ, আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে এমন কিছু আমরা তা সহ্য করবো না!আমাদের বড় সাহস ও শক্তি আমাদের দেশপ্রেম, মাতৃত্বের টান আর রক্তে ভেজা লাল সবুজের পতাকা । লেখক: তুহিন মাহামুদ মিলান, ইতালি। ঢাকাওয়াচ/টিআর

দেশের মাটির স্পর্শে জাগুক প্রাণ
ভোরের আলো সবে পুবদিকে উঁকি দিয়েছে। ছুটেছি কৃষকের মাঠের দিকে। আমি একা নই, সঙ্গে ২০ খুদে শিক্ষার্থী। তাদের কারও কারও চোখে এখনো ঘুম লেগে আছে। কেউ কেউ নতুন কিছুর উত্তেজনায় উৎফুল্ল। যাদের চোখে ঘুমের লেশ। তাদের পুরোপুরি জাগিয়ে তুলতে শুরু করলাম গল্প। মাটি ও মানুষে গল্প। কৃষি ও কৃষকের গল্প। বলছি গত সপ্তাহের কথা। চার দশকেরও বেশি সময় টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করার সুবাদে আমাকে কৃষকের মাঠে যেতে হয়। কৃষকের মতোই আমার মাঠে যাওয়ার বিষয়টিও প্রায় নিত্যকার। মাঠের ফসল, গ্রামীণ জীবন, কৃষকের ভালোমন্দ, দেশের খাদ্যপণ্যের বাজার, আধুনিক প্রযুক্তি আর সব মানুষের আশা-নিরাশার জায়গাটি তুলে আনাই আমার কাজ। বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন ব্যবস্থার সব জায়গাই আমার মোটামুটি দেখা। তারপরও গ্রামের প্রতি আমার কৌতূহল যায়নি। কয়দিন পেরিয়ে গেলেই মনটা বড় টানে। ছুটে যাই গ্রামে যাই। গ্রামে যেতে যেতেই আমার বার বার মনে হয়েছে শুধু আমি গ্রামে গেলে তো হবে না, সব শ্রেণি-পেশার মানুষকেও গ্রামে যাওয়া দরকার। বিশেষ করে শহরের সব শ্রেণিরই গ্রামমুখী হওয়াটা খুবই জরুরি। দীর্ঘদিন নগরমুখী চিন্তা আর ইট-পাথরের নাগরিক জীবনের আধুনিকতা খুঁজে খুঁজে আমরা অন্তঃসারশূন্য এক জীবনে এসে পৌঁছেছি। এতে করে আমরা যেন শিকড়হারা হয়ে যাচ্ছি। একটা প্রজন্ম বেড়ে উঠছে শহরের বুকে যাদের অধিকাংশই মাটির স্পর্শ পায়নি। তারা জানে না, মাটি যখন ফলে-ফসলে পূর্ণ হয় তখনই রচিত হয় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। সেখানে রয়েছে কৃষকের লালিত স্বপ্ন। তাদের শ্রম আর ঘামের বিনিময়ে উৎপাদন হচ্ছে দেশের মানুষের খাদ্য। তারা নীরবে ঘুরিয়ে যাচ্ছে আমাদের উন্নয়নের চাকা। নতুন প্রজন্ম এগুলো না জানা মানে, আমরা যে ভবিষ্যৎ রচনা করছি তা অপূর্ণাঙ্গ। আজকের পরজন্মই একদিন রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশ নেবে। তারা জানবে না কী করে রোদ-ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে কৃষক কেন তার জীবনকে নিবেদন করে কৃষিকাজে! শহর-নগরের আধুনিক কিশোর-তরুণদের কাছে পেলেই এই ভাবনাগুলো ওদের মাঝে তুলে ধরি। মনে আছে ২০১০ সালের ডিসেম্বরে রাজধানীর ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে গিয়ে ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের একঝাঁক শিক্ষার্থীর মাঝে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিই, আমার সঙ্গে গ্রামে যেতে রাজি আছ কে? দেখি অনেকেই সাহস করে হাত তুলেছে। তখনই তাদের ভিতর থেকে বাছাই করে চারজনকে গ্রামে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিই। এভাবেই শুরু ‘ফিরে চলো মাটির টানে’ কার্যক্রমের। আজ শহরের ছেলেরা কম্পিউটার আর মোবাইলে বুঁদ হয়ে ভার্চুয়াল পৃথিবীর মানুষ হয়ে আছে। শহর-নগরে তাদের ছোটাছুটি করার জায়গা নেই। পর্যাপ্ত মাঠ নেই খেলাধুলা করার। আমার চিন্তা ছিল এই তরুণদেরই যদি একজনকে কৃষক বা কৃষি শ্রমিকের ভূমিকায় কয়েক দিনের জন্য নিয়োজিত করা যায়, তাহলে তার মধ্য দিয়ে ভালো কিছু আসতে পারে। অর্থাৎ তার মাথায় এমন কিছু ঢুকবে, এমন এক পরিবেশে সে সিক্ত হবে, যা তার সারা জীবনের এক অনন্য শিক্ষা হয়ে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গ্রামে গিয়ে একেবারে আত্মহারা হতে থাকল। তাদের অভিজ্ঞতাগুলো অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার কারণে কয়েক বছরের মধ্যে সারা দেশেই শিক্ষার্থীদের গ্রামে যাওয়ার প্রবণতা ও আগ্রহ দেখতে পাচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভাবনা-চিন্তায় অনেকটা পরিণত। এই বয়সের মধ্যে তাদের জীবনের একটি লক্ষ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। সে কারণে কৃষকের মাঠে গিয়ে কৃষকের প্রতি তাদের একটি সহমর্মিতা ও আন্তরিকতা তৈরি হলেও তারা সেটিকে গভীরভাবে কাজে লাগানোর সুযোগ পায় কম। বড় জোর তারা তাদের একাডেমিক অর্জনটাকে কৃষির পক্ষে কাজে লাগানোর একটি লাভজনক সুযোগ খুঁজতে পারে। কিন্তু শিশুদের মাঠে নিয়ে যেতে পারলে তাদের মনের গভীরে কৃষি কৃষক ও গ্রাম একটি স্থায়ী আসন নিয়ে নিতে পারে। এই চিন্তা থেকেই ২০১১ সালে শুরু করেছিলাম ফিরে চলো মাটির টানে জুনিয়র। পঞ্চম শ্রেণির ২০ জন ছেলেমেয়েকে কৃষকের খেতে নিয়ে আলু রোপণ ও আলু তোলার কাজে যুক্ত করে দেখলাম, এর ফলাফল দারুণ। শিশুরা একদিনেই তার মাথার মধ্যে এঁকে ফেলে কৃষকের ভালোমন্দ। আমাদের শিশুদের গ্রামে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। ফসল রোপণ ও ফসল তোলার যে আনন্দ তা যদি তারা বুঝত তাহলে ব্যক্তিজীবনে ওদের কোনো ব্যর্থতা থাকত না। কৃষকের পরিশ্রমকে ওরা যদি আবিষ্কার করতে পারত, তাহলে বুঝত জীবনে কোনো কিছুই সহজে আসে না। এর জন্য প্রয়োজন হয় কঠোর পরিশ্রম ও সাধনার। ১৫১৬ সালে থমাস ম্যুর কৃষির গুরুত্ব অনুধাবন করে কল্যাণ রাষ্ট্রের যে রূপরেখা ও পরিকল্পনা এঁকেছিলেন, তার গুরুত্ব ফুরিয়ে যায়নি। যে রাষ্ট্রের নাগরিকরা সুখী ও সুন্দর। সেখানে নারী-পুরুষ সবার আছে কৃষিবিষয়ক সাধারণ জ্ঞান। পেশা যাই হোক না কেন, ফসল তোলার মৌসুমে যেতে হবে ফসলের মাঠে। সভ্যতার উত্তরণ যতই ঘটুক না কেন, যতই আমরা আধুনিক পৃথিবীর দিকে এগিয়ে যাই না কেন, কৃষির বিকল্প কিছু নেই। সভ্যতার সূচনা তো কৃষি থেকেই। দিন শেষে আমাদের ফিরে যেতে হবে কৃষির কাছেই। দেখতে দেখতে অনেক দিন হয়ে গেল। ২০১১ সালে শুরু হয়েছিল ফিরে চলো মাটির টানে জুনিয়র। শুরুতে অংশ নিয়েছিল রাজধানীর সি ব্রিজ স্কুল। ইংরেজি মাধ্যম বা ভার্সনের শিশুদের নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে, এদের চিন্তা-চেতনায় বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতির চেয়ে বেশি প্রাধান্য পায় ইংরেজি ভাষা আর পশ্চিমা সংস্কৃতি। পর্যায়ক্রমে রাজধানীর ভালো ভালো ইংলিশ মিডিয়ামের শিশুদের নিয়ে গেছি মাঠে। আমি বিশ্বাস করি, যে শিশুরা এই কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে জীবনের সেরা এক অভিজ্ঞতা হিসেবে তারা লালন করছে কৃষকের মাঠে যাওয়ার দিনটিকে। এবার গত ২ ডিসেম্বর রাজধানীর ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ২০ জন শিশু শিক্ষার্থীকে নিয়ে যাই মুন্সীগঞ্জের রুহিতপুর গ্রামে। সে গল্পই বলছিলাম। সাধারণত এত ভোরে শহরের এই শিশু-কিশোর কখনো ঘুম থেকে জাগে না। ঘুম ঘুম সকালে অন্যরকম এক কৌতূহল থাকে তাদের মধ্যে। কৃষি ও কৃষক নিয়ে তাদের মনে থাকে হাজার প্রশ্ন, অনন্ত জিজ্ঞাসা। এই বয়সে স্কুল, ক্লাস, বাসা আর গেমসের বাইরে অন্য এক ভুবন তাদের জন্য। গাড়িতে চলতে চলতে তারা দেখছে দূর গ্রামের আড়াল থেকে সূর্য ওঠা। আমরা যাচ্ছি কৃষক শামসুল হক মোল্লার আলুর খেতে আলু রোপণ করতে। আরেক কৃষক দেলোয়ার হোসেন শিশুদের জন্য বাড়িতে তৈরি করে রেখেছিলেন নানা রকমের পিঠা। সকালে মিষ্টি রোদে পিঠার উৎসব। পাটিসাপটা, ভাঁপা, পোয়া, চিতই, পুলি কোনটার কী নাম তাদের জানা নেই। কিন্তু এত পিঠা একসঙ্গে দেখে তারা উচ্ছ্বসিত। উঠোনে পাতা টেবিলে এতসব পিঠার আয়োজনে তারা মোহিত। তারা দেখল গ্রামের মানুষের আতিথেয়তা। খাওয়া-দাওয়া শেষে। বাড়ির চাচিরা বসলেন আলুর চোখ কাটতে। দারুণ আগ্রহ নিয়ে তারা দেখলো-কীভাবে আলুর চোখ কাটে! মনে মনে বিস্ময় আলুরও চোখ হয়। কৃষক দেলোয়ার হোসেন বুঝিয়ে দিলেন, আলুর চোখ মানে চোখ নয়, আলুর যে অংশে চারা গজায় সে অংশকে বলে আলুর চোখ। তারা পর্যায়ক্রমে শিখল আলু রোপণের জন্য আলুবীজ প্রস্তুতির কাজ। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা রাসেল সিকদার শিখিয়ে দিলেন কীভাবে রোপণ করতে হয় আলুর বীজ। কৃষকের বাড়ি থেকে বের হয়ে সারি বেঁধে চললাম মাঠে। এবার আলু রোপণের পালা। শিক্ষার্থীরা মাঠে নেমেই গায়ে মাটি মাখাল। দেখলাম মাটির স্পর্শে তারা কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠল। নিজেদের জীবনের সঙ্গে যুক্ত করে নিয়েছে কৃষকের শক্তি। তারা জীবনের প্রথম কৃষকের মাঠে কৃষকের ভূমিকায় কাজ করল। যে শিশুদের নিয়ে সকালে রওনা হয়েছিলাম, এ যেন তারা না, মাটি ভিতরে কিছু একটা পাল্টে দিয়েছে তাদের। শিক্ষার্থীরা সরাসরি কথা বলল কৃষকের সঙ্গে। কীভাবে ফসল ফলায়? কী পরিমাণ লাভ? কী কী অসুবিধার ভিতর দিয়ে কৃষকদের যেতে হয়? এসবই ছোট্ট শিশুরা জানতে চাইল। আলু রোপণ শেষে আমরা ফিরে আসলাম। আবার আলু ফলনের পর মার্চের প্রথম সপ্তাহে ওদের নিয়ে যাব আলু তুলতে। এই শিশু-কিশোরের কেউ হয়তো কৃষক হবে না। কেউ হয়তো প্রকৌশলী হবে, কেউ চিকিৎসক, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ শিল্পোদ্যোক্তা, কেউ চিত্রকর, কেউ চিত্রনির্মাতা। নানান পেশায় তারা চলে যাবে। যে যেখানেই যাক, যে পেশায় যুক্ত হোক। এদের ভিতর কেউ যদি কৃষির এই ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা মনে রেখে কৃষির উন্নয়নে সামান্যতম কাজ করে তাদের নিজ নিজ জায়গা থেকে। কিছু না হোক, ফল ফসল উৎপাদনকারী কোনো কৃষকের হাতে হাত রেখে এটুকু যদি বলে, ‘আমি জানি, কৃষি খুব কষ্টের কাজ, এক মহান কাজ।’ তাহলেই সফল হবে এ উদ্যোগ। এটাই হবে সার্থকতা। লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ঢাকাওয়াচ/স

নির্বাচনি খেলায় এরশাদীয় তরিকা
প্রবচন আছে, এক নদীতে দুবার স্নান করা যায় না। এর নিগূঢ় অর্থ হচ্ছে, নদী প্রবহমান। এই প্রবচন রচনার সময় বাংলাদেশের নদীর ভবিষ্যৎ দশা প্রসঙ্গ হয়তো বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এদিকে কারোরই অজানা নয়, আমাদের অনেক নদীই আর প্রবহমান নয়। আবার হারিয়েও গেছে অনেক নদী। যাও আছে তাও আবার যায় যায়। অনেকগুলো উন্নয়নের নামের সর্বনাশা তাণ্ডবে মরণদশায় ভুগছে! ফলে নদী নিয়ে প্রবচন এখন আর আমাদের দেশে প্রযোজ্য নয়। এটি হতাশার। তবে আর একটি আশার কথা আছে। আর এটি প্রবচন নয়। বিজ্ঞান বলে, কোনো কিছুই মৌলিক সৃষ্টি হয় না, রূপান্তর হয় মাত্র। কিন্তু হতাশার কথা হচ্ছে, বিজ্ঞানের এ সূত্রের বিরূপ প্রভাব রাজনীতিতে দৈত্যের মতো অনুপ্রবেশ করেছে। যা পাকিস্তানের শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের উত্তরাধিকার হিসেবে আমাদের দেশে কপিপেস্ট করেছেন জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল এরশাদ। তবে এ ক্ষেত্রে জেনারেল এরশাদের সাফল্য আকাশচুম্বী। বলা হয়, আদর্শিক পিতা আইয়ুব খানকেও অনেকখানি ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন জেনারেল এরশাদ। ’৭১-এ পরাজিত চক্রের থিংক ট্যাংকের নীলনকশায় ’৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনা ঘটানোর পর দেশ উল্টো রথে চলতে শুরু করে। এ ধারায় যেসব অপকর্ম হয়েছে তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে রাজনীতিকে মূল পর্যন্ত নষ্ট করে দেওয়া। এ ধারা একনাগাড়ে চলতে থাকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। জেনারেল এরশাদের পতন এবং ’৯১-এর সংসদ নির্বাচনের পর রাজনীতিতে যে ধারার সূচনা হয়েছিল তা কিন্তু স্থায়ী হয়নি। সঙ্গে আরও বলে রাখা ভালো, ’৯১-এর সংসদ নির্বাচনও ’৭১-এ পরাজিত শক্তির প্রতিভূ চক্র প্রভাবিত ছিল। যা ছিল খুবই সূক্ষ্ম। যে কারণে সেই নির্বাচনের ব্যালটে জাহাজ প্রতীক ছিল অনেকটা নৌকার আদলে। যাকে ‘বড় নৌকা’ ভেবে অনেকেই সিল মেরেছেন। আরও অনেক কারসাজিতে সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেতে পারেনি। যে খেলা আগেভাগে আঁচ করতে পারেনি আওয়ামী লীগ। বরং নেতারা ছিলেন মসনদে বসার আবেশে বিভোর কিন্তু স্বপ্নভঙ্গের পর দেখলেন তাদের হাসি অন্যেরা হাসে। একটি সিনেমা ছিল, ‘কার হাসি কে হাসে।’ স্মরণ করা যেতে পারে, ’৯১-এর নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে ‘সূক্ষ্ম কারচুপির’ অভিযোগ তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এরপর কখনো সূক্ষ্ম আবার কখনো স্থূল কারচুপির মধ্য দিয়েই এগিয়েছে বাংলাদেশের নির্বাচন। আর এ কারচুপির বিরূপ প্রভাবে রাজনীতি কেবল কলুষিত হতেই থেকেছে। এর মধ্যে ’৯৬ সালে কোনো রকম ক্ষমতায় আসে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগ এবং সেটি ছিল খুবই নাজুক সরকার। তবে এই দশা কাটিয়ে এবং ২০০১ সালের পরাজয়ের ধারাকে পাল্টে দিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ গঠিত সরকার দ্রুত শক্ত ভিত্তি সৃষ্টি করতে পেরেছে। ফলে ২০১৪ সালের খেলা সামলিয়ে ২০১৮ সালে পাল্টা খেলা খেলে ২০২৪ সালের দোরগোড়ায় পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে এবার বিদেশিদের হস্তক্ষেপে আওয়ামী লীগের জন্য খেলা খুবই কঠিন হয়ে গেছে। আর এ খেলার জন্য অনেকটাই নির্ভর করতে হয়েছে এরশাদীয় তরিকার ওপর। যে কারণে রাজনীতির কিছু আবর্জনা দিয়ে নতুন দল গঠন করতে হয়েছে। যাদের না আছে ভোট, না আছে দল। এমনকী এদের অতীত বলেও কিছু নেই। ফলে ভোটের মাঠে কচুরিপানাসম উপযোগহীন এরা। অথচ এদের দায় নিতে হচ্ছে প্রাচীনতম দল আওয়ামী লীগকেই। অনেকেই মনে করেন, বিএনপি নির্বাচন থেকে দূরে থাকার কারণে সরকার যে মাত্রায় বেকায়দায় পড়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি হাসির পাত্র হয়েছে হেনোতেনো নামে হরেক কিসিমের দল ও জোট নির্বাচনি মাঠে নামিয়ে। অবশ্য এই ফাঁদে ১৯৯৬ সালেই পা দিতে হয়েছিল আওয়ামী লীগকে। আর এবার নিমজ্জিত হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। তবে এও বলা হচ্ছে, বিভিন্ন বাস্তবতায় ১৯৯৬ সালে যা অনিবার্য ছিল তার রেস টানতে হয়েছে ২০০৯ ও ২০১৪-এর সরকারের আমলেও। তবে এটা ২০২৪ সালের নির্বাচনে এড়ানো যেত। যা করা গেছে ২০১৮ সালের সরকার গঠনের সময়। কিন্তু তা করা হয়নি। বরং উল্টোই একটু বেশি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। যা দগদগে ঘায়ের মতো দৃষ্টান্ত হয়েছে আছেন মেজর শাহজাহান ওমর। বরিশাল অঞ্চলে দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা আওয়ামী চক্করে নাজেহাল হয়ে আওয়ামীবিরোধী হয়ে গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পরপরই। ৪৫ বছর বিএনপির ব্যানারে থাকার পর আওয়ামী লীগে গাঁটছড়া বেঁধেছেন এবার। অনেকেই এ বিষয়টিকে তার ফিরে আসা বলছেন। কিন্তু এ কাজটি করা হয়েছে খুবই কাঁচাভাবে। অদ্ভুত মামলায় জামিন পাওয়ার এক দিন পরেই বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক ঘুচিয়ে ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর ঘোষণা করলেন, নির্বাচন করবেন নৌকা মার্কা নিয়ে। হঠাৎ কেন শাহজাহান ওমরের এমন ডিগবাজি? এ কাণ্ডের যুক্তি হিসেবে তাঁর কথা কি খুব একটা গ্রহণযোগ্য? আর এ প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের ১ ডিসেম্বর বলেছেন, ‘কৌশলগত কারণে ঝালকাঠি-১ আসনে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী ব্যারিস্টার মেজর (অব.) শাহজাহান ওমরকে নৌকার প্রার্থী করা হয়েছে।’ প্রশ্ন হচ্ছে, কোন কৌশল? কিন্তু জানা কথা, এ প্রশ্নের উত্তর মিলবে না। ফলে যার যার মতো করে এর উত্তর তৈরি করা হচ্ছে। যার সঙ্গে মিলে যায় সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের তরিকা। কারাগার থেকে বেরিয়ে ব্যারিস্টার মওদুদ যখন এরশাদ সরকারে যোগদান করেন তখন তাঁর পিঠে লাঠির আঘাতের দাগ বিরাজমান ছিল বলে রটনা আছে। আর একজন ব্যারিস্টার, আবুল হাসানাত জেনারেল এরশাদের সঙ্গে যোগদানের দুই দিন আগে বলেছিলেন, ‘এরশাদের সঙ্গে গেলে মানুষ আমার মুখে থুথু দেবে!’ এদিক থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান ওমর কিঞ্চিত আলাদা। তিনি আগে নয়, বাগাড়ম্বর করেছেন আওয়ামী খাতায় নাম লেখানোর পর। এটা সবারই জানা। কিন্তু মানুষ এখন কোন দিকে থুথু দিচ্ছে তা হয়তো জানা নেই। এদিকে স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা মেনন-রব-ইনুদের কেবলই দরপতন হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে। এদের মধ্যে অসময়ের কলরব হিসেবে পরিচিত আ স ম আবদুর রব জেনারেল এরশাদের সময় একটি চাকরি প্রত্যাশা করে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়েছিলেন। হয়তো তিনি তাঁর মতোই আর এক ‘খলিফা’ আবদুল কুদ্দুস মাখনের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেছিলেন। উল্লেখ্য, আবদুল কুদ্দুস মাখন সে সময় মাফিয়া ডন আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের কোম্পানিতে চাকরি করতেন। এদিকে আ স ম রবের ভাগ্য ভালো, তিনি এই মাপের চেয়ে অনেক বড় মাপের চাকরি পেয়েছিলেন। তাকে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার চাকরি দিয়েছিলেন সামরিক সরকার। সে সময় তাঁকে গৃহপালিত বিরোধীদলীয় নেতা বলা হতো। রাজনীতির কী পরিহাস! এই আ স ম রবকেই মন্ত্রী করেছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তাঁর ’৯৬-এর সরকারের। এ সময় রবের অতীত হয়তো বিবেচনায় নেওয়া হয়নি, হয়তো গভীরভাবে ভাবা হয়নি তার ভবিষ্যৎ। কেবল তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মিটানো হয়েছে। একই ধারায়ই হয়তো আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখেই এবার ‘হেনমূল, তেনমূল, অর্শ্বমূল’ নামের দলগুলো মাঠে নামানো হয়েছে। আর এদের আস্ফালন দেখে হয়তো মেনন-ইনু-দিলীপরা ভিতরে ভিতরে শিশুতোষ অস্থিরতা বোধ করছেন। শুধু তাই নয়, মিরসরাইতে ইউপি চেয়ারম্যান হওয়ার মতো ভোট না থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু কন্যার দয়ায় দীলিপ বড়ুয়া কেবল সংসদ সদস্য নন, মন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছে। আর আমাদের দেশে মন্ত্রী হওয়া মানেই অনেক ক্ষেত্রে আলী বাবার স্বর্ণ গুদামের দ্বার খুলে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। বলা হয়, বাম নেতা দীলিপ বড়ুয়া এই কামে মোটেই পিছিয়ে ছিলেন না। এখন জোট নেতাদের নামে সংসদীয় আসন বরাদ্দ দিতে বিলম্ব হওয়ায় যারা অস্থির হয়ে উঠেছেন তাদের মধ্যে বেশি অস্থিরতায় ভুগছেন দীলিপ বড়ুয়া। শুধু তাই নয়, একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জ্ঞান দেওয়ার উত্তেজনায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতি অত সোজা না!’ এর আগে তিনি আরও বলেছেন, ‘কাউয়া আওয়ামী লীগাররা আমাদের বলে একজইন্যা পার্টি।’ আওয়ামী লীগে কে ‘কাউয়া’ কে কাক, কে কুকিল সেটি ইতিহাসই বলে দেবে। তবে অতীত যা বলে তা কিন্তু খুব একটা নিরাপদ নয়। স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনালগ্ন থেকেই আওয়ামী লীগকে উজান ঠেলে আগাতে হয়েছে। আর ১৫ আগস্টের পর দলটি টিকে গেছে অতি সাধারণ মানুষের ভালোবাসা এবং তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের রক্ত-ঘামে। যা বহুবার বঙ্গবন্ধুকন্যা স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেছেন। এটিই বাস্তবতা। আর ‘এক নেতার এক দল’ আসলে কোনো কাজেই আসে না। বিপদের সময় এরা নিশ্চুপ হয়ে যায়। নিজেদের গুটিয়ে নেয় শামুকের মতো। আর বিপদ ঘনীভূত হলে যাত্রাগানের বিবেকের মতো ‘সত্য ভাষণ’ দেন। যে ধারায় রাতে ভোট হওয়ার কথা এবং নিজের ভোট নিজে না দিতে পারার ক্ষোভ বড় গলায় উচ্চারণ করেছেন রাশেদ খান মেনন। অবশ্য ক্যাসিনো কাণ্ডের নানান খবরের পালে জোর হাওয়া লাগলে রাশেদ খান মেননের জোসের হাওয়া কোথা থেকে যেন বেরিয়ে যায়। অবশ্য তার জীবনের হাওয়াই একবার বেরিয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল বেগম খালেদা জিয়া সরকারের সময় সর্বহারা গ্রুপের গুলি খেয়ে। সেবার তিনি ভাগ্যক্রমে বেঁচেছেন। উল্লেখ্য, তাঁর নিজের এলাকা বরাবরই সর্বহারা উপদ্রুত। এর সুবিধা-অসুবিধা দুই আছে। যেমন ’৭৩ সালের সংসদ নির্বাচনে বরিশাল শহরের ভোট কেন্দ্রে যে জালাল সর্দার কর্তৃক তিনি অপদস্থ হয়েছেন সেই জালাল সর্দার নবগ্রাম রোডের নিজ বাড়িতে সর্বহারার গ্রুপের গুলিতে নিহত হয়েছেন। আসলে রাজনীতির ঐতিহ্যের ধারক হোক অথবা হোক ভুঁইফোঁড়, জনবিচ্ছিন্ন নেতারা আসলে কোনো কাজে লাগে না। এরা পরগাছা। আশ্রিত হিসেবে এরা কেবল নেয়। দেয় না কিছুই। এরা শীতের পাখিরও অধম। শীতের পাখিরা মাছ-শস্য খেয়ে সাবার করলেও মল ত্যাগ করে যায়। গরু মেরে জুতো দানের মতো হলেও কিছু দেয়। কিন্তু রাজনীতিতে শীতের পাখিরা কিছুই দেয় না, রেখে যায় না কিছুই। যে নামেই আখ্যায়িত করা হোক না কেন এরা আসলে রাজনীতির আগাছা। এরপরও রাজনীতির আগাছাদের কেন বৃক্ষসম সমাদর করেন আওয়ামী লীগ প্রধান? এই সমাদরের ধারা আরও কত বছর চলবে- কঠিন সময় সামনে রেখে এ মোটেই কোনো সাধারণ প্রশ্ন নয়। অনেকের বিবেচনায়ই এটি মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন! লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ঢাকাওয়াচ/স