
বাংলাদেশের পাঠানো আনুষ্ঠানিক নোট ভারবাল দিল্লির দরজায় পৌঁছালেও স্পষ্ট হয়ে উঠছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে ভারত আপাতত কোনো অবস্থান নিতে আগ্রহী নয়। আইসিটি কর্তৃক শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে অনুপস্থিতিতে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পর পাঁচ দিন পেরোতেই ঢাকা নতুন করে প্রত্যর্পণ অনুরোধ পাঠায়, যা দীর্ঘদিন ধরেই অনুমান করা হচ্ছিল।
১৭ নভেম্বর রায় ঘোষণার পর থেকেই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার কঠোর ভাষায় ভারতকে অভিযুক্ত দুই ব্যক্তিকে ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর হাসিনা ভারতেই আশ্রয় নেন এবং সেখান থেকে নিয়মিত বিবৃতি ও সাক্ষাৎকার দিয়ে চলেছেন, যা ঢাকার অন্তর্বর্তী সরকারের বিরক্তির কারণ হয়ে উঠেছে।
গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকার বারবার প্রত্যর্পণের দাবি জানালেও ভারত সেসবের কোনো উত্তর দেয়নি। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে পাঠানো প্রথম আনুষ্ঠানিক অনুরোধের জবাবে দিল্লি কেবল নোট ভারবাল পাওয়ার কথা স্বীকার করেছিল। দ্বিতীয় অনুরোধেরও এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া মেলেনি। ট্রাইব্যুনালের সাম্প্রতিক রায়ের পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া তাদের অবস্থান সম্পর্কে কিছুটা ইঙ্গিত দেয়। তারা শুধু জানিয়েছে যে রায়টি তারা ‘খেয়াল করেছে’ এবং বলেছে, ‘ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হিসেবে ভারত বাংলাদেশি জনগণের শান্তি, গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি ও স্থিতিশীলতার সর্বোত্তম স্বার্থে অঙ্গীকারবদ্ধ। এই লক্ষ্য অর্জনে আমরা সব পক্ষের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে কাজ করে যাব।’
প্রত্যর্পণ অনুরোধ নিয়ে তবু কোনো মন্তব্য আসেনি দিল্লির পক্ষ থেকে। মনোহর পারিক্কর ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসিসের গবেষক স্মৃতি এস পট্টনায়ক মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সীমিত ক্ষমতা বিবেচনায় ভারত অপেক্ষা করতে চায় নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব নেওয়া পর্যন্ত।
বাংলাদেশে হাসিনার দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকা মানুষদের কাছে আইসিটির এই রায় অনেকটা প্রতীকী ন্যায়বিচার। তবে তিনি ভারতে অবস্থান করায় রায় কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না, ফলে তাঁকে ফিরিয়ে আনার দাবি অনেকের কাছেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
দুই দেশের মধ্যে ২০১৩ সালের প্রত্যর্পণ চুক্তি থাকলেও ভারতে হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর সমর্থন বাস্তবে খুবই কম এবং মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর তা আরও কমেছে। ভারতের প্রায় সব রাজনৈতিক দলই তাঁর প্রত্যর্পণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এর পেছনে কাজ করছে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার পরিবারের সঙ্গে ভারতের বহু দশকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে দিল্লির ভূমিকা এবং ১৯৭৫ সালের পর হাসিনা পরিবারের ভারতে আশ্রয় নেওয়ার ইতিহাস।
হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলে দুই দেশের রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা দৃঢ় হয়েছে। ইসলামপন্থী ও ভারতবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে তাঁর কঠোর অবস্থান দিল্লিতে বিশেষভাবে প্রশংসিত ছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের কাছে এমন একজন ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু’কে মৃত্যুদণ্ডের মুখে ঠেলে দেওয়া শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই নয়, ভারতের অন্যান্য মিত্রদের কাছেও নেতিবাচক বার্তা বহন করবে।
চুক্তি অনুযায়ী সহযোগিতা বাধ্যতামূলক হলেও এর একটি ধারায় বলা আছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপরাধে প্রত্যর্পণ প্রত্যাখ্যান করা যায়। যদিও হত্যা বা ইচ্ছাকৃত হত্যার মতো অভিযোগকে রাজনৈতিক অপরাধ ধরা হবে না, তবু হাসিনার বিরুদ্ধে এসব অপরাধ সরাসরি প্রমাণ করা কঠিন বলেই ভারত যুক্তি তুলতে পারে যে বিচারটি নিরপেক্ষ হয়নি বা আইসিটির বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ।
ধরা যাক ভারত ইতিবাচক সাড়া দিল, তবুও সামনে অপেক্ষা করছে দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া। ভারতের আদালতে পূর্ণাঙ্গ প্রত্যর্পণ শুনানি হবে, যেখানে হাসিনা তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের জবাব দেওয়ার সুযোগ পাবেন।
অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা স্বার্থে বাংলাদেশ ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বাংলাদেশে নতুন সরকার গঠিত না হওয়া পর্যন্ত দিল্লি এ বিষয়ে চূড়ান্ত অবস্থান নেবে; এমন সম্ভাবনা কম। এদিকে বাংলাদেশে নির্বাচনী প্রচার শুরু হলে রাজনৈতিক দলগুলো ভারতের প্রতি হাসিনার ঘনিষ্ঠতা এবং তাঁকে ফেরত না দেওয়ার সম্ভাবনাকে ইস্যু করে সমালোচনা করাই স্বাভাবিক।
হাসিনার পতনের পর থেকেই দুই দেশের সম্পর্কে দূরত্ব বাড়ছে, আর প্রত্যর্পণ ইস্যু সেই উত্তেজনাকে আরও তীব্র করতে পারে।
লেখক: সুধা রামচন্দ্রন, দক্ষিণ এশিয়া সম্পাদক, দ্য ডিপ্লোম্যাট