
যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবীয় এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা একটি নৌঘাঁটি পুনর্নির্মাণ করছে, যা ভেনেজুয়েলার অভ্যন্তরে সম্ভাব্য সামরিক অভিযান নিয়ে জল্পনা সৃষ্টি করেছে। রয়টার্সের সাম্প্রতিক ভিজ্যুয়াল তদন্তে দেখা গেছে, পুয়ের্তো রিকোর রুজভেল্ট রোডস ঘাঁটিতে গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে পুনর্নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই উদ্যোগ কৌশলগত গুরুত্ব বহন করছে।
২০ বছর আগে বন্ধ হওয়া ঘাঁটিতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কর্মীরা বর্তমানে ট্যাক্সিওয়ে ও রানওয়ে সংস্কার করছেন। স্যাটেলাইট চিত্র ও স্থানীয় সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, পুরনো অবকাঠামো ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এক সময় বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মার্কিন নৌঘাঁটিগুলোর মধ্যে একটি রুজভেল্ট রোডস ২০০৪ সালে বন্ধ হয়েছিল। এখন এটি পুনরায় সক্রিয় করার পদক্ষেপকে বিশেষজ্ঞরা কৌশলগত মহড়া হিসেবে দেখছেন।
একজন মার্কিন কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, ‘ঘাঁটিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। এটি সরঞ্জাম সংরক্ষণ এবং দ্রুত মোতায়েনের জন্য বিশাল জায়গা প্রদান করতে পারে।’
রয়টার্সের স্যাটেলাইট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শুধু রুজভেল্ট রোডস নয়, যুক্তরাষ্ট্র পুয়ের্তো রিকো ও মার্কিন ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জের অন্যান্য বিমানবন্দরেও সংস্কার কাজ করছে। এসব স্থানে মোবাইল এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ার, রাডার সিস্টেম, জ্বালানি সংরক্ষণাগার ও গোলাবারুদের জন্য নিরাপদ স্থান তৈরি করা হচ্ছে।
পুয়ের্তো রিকো ও মার্কিন ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ ভেনেজুয়েলা থেকে মাত্র ৫০০ মাইল দূরে অবস্থিত। তিনজন মার্কিন সামরিক কর্মকর্তা এবং তিনজন সামুদ্রিক বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, এসব স্থাপনার উন্নয়ন এমন প্রস্তুতির ইঙ্গিত দেয় যা যুক্তরাষ্ট্রকে ভেনেজুয়েলার অভ্যন্তরে দ্রুত অভিযান পরিচালনায় সক্ষম করতে পারে।
সিএসআইএস-এর ফেলো ক্রিস্টোফার হার্নান্দেজ-রয় বলেন, ‘আমার মনে হয়- এই পদক্ষেপগুলো মূলত মাদুরো সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশল। হয়তো এতে সেনাবাহিনীর ভেতরে ভাঙন তৈরি হবে, যা যুক্তরাষ্ট্র চায়।’
ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো বারবার অভিযোগ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র তার সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা করছে।
গত আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে অন্তত ১৩টি যুদ্ধজাহাজ, একটি পারমাণবিক সাবমেরিন এবং পাঁচটি সহায়ক জাহাজ মোতায়েন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে বিশাল বিমানবাহী রণতরী ‘জেরাল্ড আর. ফোর্ড’, যা প্রায় ১০ হাজার সৈন্য এবং ৭৫টিরও বেশি যুদ্ধবিমান বহন করতে সক্ষম।
একই সময়ে মার্কিন বিমানবাহিনী এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান, বি-৫২ বোমারু বিমান এবং গুপ্তচর বিমান পাঠাচ্ছে। ফ্লাইট ট্র্যাকিং তথ্য অনুযায়ী, এসব বিমান নিয়মিত ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছাকাছি টহল দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এটি ১৯৯৪ সালের ‘অপারেশন আপহোল্ড ডেমোক্রেসি’ পর ক্যারিবীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক উপস্থিতি। সেই সময় হাইতিতে প্রায় ২০ হাজার সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছিল।
গত দুই মাসে যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মাদকবাহী জাহাজের বিরুদ্ধে অন্তত ১৪টি অভিযান চালিয়েছে, যাতে ৬১ জন নিহত হয়েছেন। হোয়াইট হাউস বলেছে, এসব অভিযান মূলত ‘মাদক সন্ত্রাসবাদ দমন’ কার্যক্রম। অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, এটি ভেনেজুয়েলার সীমান্তের কাছে সামরিক উপস্থিতি বাড়ানোর একটি অজুহাত।
হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের সামুদ্রিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ব্রেন্ট স্যাডলার বলেন, ‘এই কার্যক্রম শুধু মাদকবিরোধী অভিযানে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বৃহত্তর কৌশলগত উপস্থিতির অংশ, যা ভবিষ্যতের সামরিক পদক্ষেপের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে প্রস্তুত রাখছে।’ তিনি আরও জানান, যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে ক্যারিবীয় অঞ্চলে অন্তত আটটি যুদ্ধজাহাজ, কয়েকটি ট্যাঙ্কার, হাসপাতাল জাহাজ এবং একটি সাবমেরিন নেভিগেশন সিস্টেম পরীক্ষামূলকভাবে স্থাপন করেছে।
পেন্টাগন ও পুয়ের্তো রিকো প্রশাসন রয়টার্সকে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য দেয়নি। তবে মার্কিন ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জের গভর্নর আলবার্ট ব্রায়ান জুনিয়র বলেন, ‘এই অঞ্চলে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি নিরাপত্তা জোরদার করবে এবং মাদক ও অস্ত্র পাচার ঠেকাতে সহায়তা করবে।’
যুক্তরাষ্ট্র এখনও প্রকাশ্যে ভেনেজুয়েলার দিকে কোনো পদক্ষেপ ঘোষণা করেনি। তবে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত সপ্তাহে বলেন, ‘পরের জায়গাটা হবে।’ এই মন্তব্য অনেকের কাছে ইঙ্গিত বহন করছে যে ওয়াশিংটন ক্যারিবীয় ঘাঁটিগুলো সক্রিয় করে ভেনেজুয়েলার দিকে বড় কোনো সামরিক প্রস্তুতি নিতে পারে।
সূত্র: রয়টার্স