
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের চাপের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় নেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশ ছাড়ার পর থেকে তিনি বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সক্রিয় হয়ে নানা মন্তব্য প্রকাশ করছেন। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ফেব্রুয়ারিতে ভারতের কাছে জানিয়েছিল, মিথ্যা ও উসকানিমূলক এই বক্তব্যের মাধ্যমে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছেন এবং ভারতের উচিত বিষয়টিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা। একই সঙ্গে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদও জানানো হয়।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাল্টা বক্তব্যে জানায়, শেখ হাসিনা যদিও ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন, তবে তিনি ব্যক্তিগত পর্যায়ে এই মন্তব্যগুলো করছেন। তাদের দাবি, “ব্যক্তি হিসেবে” দেওয়া বক্তব্যে ভারত সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। এমনকি এ ধরনের মন্তব্যের জন্য ভারতকে দায়ী করলে বা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতার জন্য চাপ দিলে তা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর হবে বলে মনে করিয়ে দিল্লিতে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাই কমিশনারকেও তলব করা হয়।
এরপর ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা তীব্র হয়। বিষয়টি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যেও কথাবার্তা হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ডিসেম্বরে ভারত সরকারকে শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর জন্য চিঠি পাঠানোর প্রস্তাব জানায়।
বাংলাদেশের দাবি, জুলাই গণহত্যায় অভিযুক্ত শেখ হাসিনাকে ভারত আশ্রয় দিয়েছেন, যা কোনো দোষের বিষয় নয়, তবে বিদ্যমান প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী তাকে বিচারের জন্য ঢাকায় হস্তান্তর করা উচিত। এই প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগে যদি ভারত তাঁকে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিতে দেয় এবং তিনি দলীয় নেতা-কর্মীদের উসকানি দিয়ে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করেন, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
তবে ‘কূটনৈতিক তিক্ততার’ মাঝেই শেখ হাসিনা নিয়মিত অনলাইনে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছেন। কখনও তা রেকর্ড করা, কখনও সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছে।
এপ্রিল মাসে ব্যাংককে বিমস্টেক শীর্ষ সম্মেলনের সময় শেখ হাসিনার ‘মুখ খোলার’ বিষয়টি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে তুলে ধরেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। মোদির বক্তব্য ছিল, বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে কারও মুখের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব নয় এবং শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটছে।
ভারতের যুক্তি হলো, গণঅভ্যুত্থানের সময় ‘বিশেষ পরিস্থিতি ও সুরক্ষার প্রয়োজনে’ তিনি ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে ভারত আশ্রয় দিলেও তিনি কোনো রাজনৈতিক বন্দি নন। রাজনৈতিক বন্দিদের ক্ষেত্রে ভারতে ফোন বা অনলাইন ব্যবহার সীমিত থাকে, কিন্তু শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। তিনি অবাধে নিউজপেপার এবং টেলিভিশন চ্যানেল ব্যবহার করতে পারছেন এবং তার ব্যক্তিগত মোবাইল প্রথম দিন থেকেই তার হাতে রয়েছে।
এখনো প্রমাণ হিসেবে, ২৯ অক্টোবর একযোগে তিনটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে (রয়টার্স, এএফপি ও দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট) তিনটি পৃথক সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। যদিও সাক্ষাৎকারগুলো লিখিত বা ই-মেইল মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে, তবে ভারতের অনুমোদন ছাড়া তা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কয়েক মাস আগে ভারতে সশরীরে তার দল আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎও ভারতের অনুমোদন ছাড়া হয়নি। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ও দিল্লিতে এসে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।
এই ঘটনাক্রম বিশ্লেষকরা দেখছেন, গণঅভ্যুত্থানের পর ভারতের প্রাথমিক বিধিনিষেধ ধীরে ধীরে শিথিল হচ্ছে। অনেকেই এটিকে ‘আনলকিং’ বলে অভিহিত করছেন। তবে প্রশ্ন ওঠে, এ অনমনীয়তা ভারত কোন বার্তা দিতে চাইছে।
দিল্লিতে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের বিষয় নিয়ে গবেষণা করা মনোহর পারিক্কর ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসিসের (আইডিএসএ) সিনিয়র ফেলো স্ম্রুতি পট্টনায়ক মনে করেন, ভারতের এই ব্যবস্থার উদ্দেশ্য হলো আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক রাখার চেষ্টা। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারগুলো ভারত সরকারের অগোচরে হয়নি, এটি স্পষ্ট। তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চলেছে যেখানে আওয়ামী লীগ কোনো ‘স্পেস’ পাচ্ছে না। ঐকমত্য কমিশন সংস্কার নিয়ে কাজ করেছে, জুলাই সনদ পর্যন্ত সই হয়ে গেছে, অথচ সেখানে আওয়ামী লীগের কোনো ভূমিকাই নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ হলো বাংলাদেশের একটি বড় রাজনৈতিক শক্তি যাদের সঙ্গে ভারতের ঐতিহাসিক সম্পর্ক আছে। সেই দলটি যখন সেখানে মুখ খোলার সুযোগ পাচ্ছে না, তখন শেখ হাসিনাকে আরও বেশি প্রকাশ্যে বলতে দেওয়া হচ্ছে। কারণ, এখনও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে শেখ হাসিনাই শেষ কথা।”
ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাই কমিশনার রিভা গাঙ্গুলি দাসও এই ধারণার সঙ্গে একমত। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার বক্তব্য মূলত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মনোবল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে। সামনেই নির্বাচন আসছে, ফলে হাতে খুব বেশি সময় নেই। “আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা দেশে নেই, সামনের নির্বাচনে তারা লড়ার সুযোগ পাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে ভারতে থাকা শেখ হাসিনার পক্ষে যতটুকু সম্ভব করা সম্ভব, সেটিই তিনি করছেন। তার হোস্টরাও এতে আপত্তি জানাচ্ছে না।”
কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, ভারতের এমন সিদ্ধান্ত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও উত্তেজনাপূর্ণ করতে পারে।
দিল্লির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ, জেএনইউ-এর সাবেক অধ্যাপক ড. বলদাস ঘোষালের মতে, ভারতের দাবি শেখ হাসিনার বক্তব্য মানে তা ভারতের নয়, সব ক্ষেত্রে সত্য নয়। “ভারতের পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে যা বলা সম্ভব নয়, তার অনেক কথাই শেখ হাসিনার মুখ দিয়ে বলানো হচ্ছে। আমি মনে করি, শেখ হাসিনার এই সাক্ষাৎকারগুলোর মধ্য দিয়ে ভারত বাংলাদেশে কিছু ঘটনা নিয়ে আক্রমণাত্মক অবস্থান নিতে চাইছে। যেমন, পাকিস্তানের সামরিক জেনারেল বা সরকারি কর্মকর্তাদের সফর, কিংবা সেভেন সিস্টার্স নিয়ে উসকানিমূলক মন্তব্য।”
তিনি মনে করেন, ভারতের উদ্দেশ্য দুটি। প্রথমত, শেখ হাসিনার কথাগুলো বাংলাদেশে কী প্রভাব ফেলে তা পর্যবেক্ষণ করা। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগের হতাশ নেতাকর্মীদের দেখানো যে শেখ হাসিনা দলের হাল ধরে রেখেছেন এবং ভারতও তার পাশে রয়েছে।
শেখ হাসিনার এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ভারতের কিছু স্বার্থও বাস্তবায়িত হচ্ছে, এমন ধারণা বিশেষজ্ঞদের।
সূত্র: বিবিসি বাংলা