
রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় জামানত ছাড়াই ঋণ দেওয়ার খেসারত গুনছে দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (এনবিএফআই)। ঋণগ্রহীতাদের হদিস না মেলায় বাড়ছে খেলাপি ঋণ, আর তার চাপ পড়ছে আমানতকারীদের টাকায়। ফলে পুরো খাত এখন মারাত্মক সংকটে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চ শেষে এনবিএফআই খাতে মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭৭ হাজার ৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ২৭ হাজার ৫৪১ কোটি, যা মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৭২ শতাংশ। এক বছর আগের জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২৪ হাজার ৭১১ কোটি টাকা, অর্থাৎ এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ হাজার ৮৩০ কোটি।
খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠরা পরিচালক পদে থেকে নিজেদের ঘনিষ্ঠদের নামে জামানত ছাড়াই ঋণ অনুমোদন করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতার আর হদিসই মিলছে না। এতে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
পুরোনো সংকটের নতুন রূপ
অর্থনীতিবিদদের মতে, পি কে হালদারের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনাই এ খাতের বড় ক্ষতির কারণ। তার নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগই খেলাপি ঋণের চাপে ধসে পড়েছে। উদাহরণ হিসেবে পিপলস লিজিংয়ের প্রায় সব ঋণই খেলাপি। বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের খেলাপি ঋণ প্রায় ৯৫ শতাংশে পৌঁছেছে। এছাড়া ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, ফিনিক্স ফাইন্যান্স, ফার্স্ট ফিন্যান্স ও আভিভা ফাইন্যান্সসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের হার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে আরও প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যাবে এবং সাধারণ আমানতকারীরা হারাবেন তাদের কষ্টার্জিত অর্থ।
৯ প্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত
অতিরিক্ত খেলাপি ঋণ, মূলধন ঘাটতি ও আমানত ফেরত দিতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক ৯টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এগুলো হলোঃ
পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস ,ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, আভিভা ফাইন্যান্স, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট , ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স কোম্পানি, প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে সরকারের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ক্ষুদ্র আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়াকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। রেজল্যুশন ডিপার্টমেন্ট গভর্নরের অনুমোদন নিয়ে অবসায়নের কাজ শুরু করেছে। এছাড়া কর্মরত কর্মচারীদের চাকরিবিধি অনুযায়ী সব প্রাপ্য সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।
খাতের সার্বিক চিত্র:
দেশে প্রথম এনবিএফআই চালু হয় ১৯৮১ সালে আইপিডিসির মাধ্যমে। বর্তমানে দেশে ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম চালাচ্ছে, যাদের লাইসেন্স ও নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ২০টি প্রতিষ্ঠানকে সমস্যাগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এই সমস্যাগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের মোট ঋণ ২৫ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২১ হাজার ৪৬২ কোটি খেলাপি, যা ৮৩ দশমিক ১৬ শতাংশ। অন্যদিকে জামানত হিসেবে রাখা সম্পদের মূল্য মাত্র ৬ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের মাত্র ২৬ শতাংশ।
অন্যদিকে তুলনামূলক স্থিতিশীল অবস্থায় থাকা ১৫টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশের নিচে। এর মধ্যে পাঁচটির খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশেরও কম।