
দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে জনতা ব্যাংক পিএলসি অন্যতম। গত কয়েক বছর ধরে ব্যাংকটি বিভিন্ন ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারি ও বিতর্কের কারণে পিছিয়ে পড়েছিল। আওয়ামী লীগের ক্ষমতার পতনের পরবর্তী পর্যায়ে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হয়েছেন মো. মজিবর রহমান। তিনি গত নভেম্বর মাসে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তাঁর মেধা, বিচক্ষণতা ও প্রজ্ঞা দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে ব্যাংকটিতে নানা সাফল্য বয়ে এনেছেন। ব্যাংকটির আমানত, হিসাবধারীর সংখ্যা, বিনিয়োগ, রেমিট্যান্স প্রবাহ, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ও খেলাপি ঋণ আদায়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সূচকে অগ্রগতি হয়েছে।
সম্প্রতি ব্যাংকটির আগামীর পদক্ষেপ জানতে ঢাকাওয়াচ-এর বিজনেস এডিটর ফরিদ উদ্দিন শ্রাবণের সাথে মুখোমুখি হয়েছিলেন জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মজিবর রহমান। কথা হয় জনতা ব্যাংকের বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে।
ঢাকাওয়াচ: গ্রাহকের আস্থা ফেরাতে কি কি পদক্ষেপ নিচ্ছেন?
মজিবর রহমান: জনতা ব্যাংক তার পণ্য ও সেবার গুণমানের বিষয়ে অত্যন্ত বিচক্ষণ। ব্যাংকে একদল মেধাবী কর্মকর্তা রয়েছেন, যারা নতুন উদ্ভাবনী পণ্য এবং সেবা দিতে সক্ষম। ব্যাংকে অনুপ্রাণিত এবং উদ্যোমী কর্মকর্তারা রয়েছেন, যারা নতুন ব্যবসা অর্জন করতে সক্ষম। সর্বোপরি ব্যাংকের দক্ষ পরিচালনা পর্ষদ একটি ভাল কর্পোরেট সুশাসন বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। গ্রাহকের চাহিদা মাফিক অর্থ পরিশোধ করতে কখনোই ব্যর্থ হয়নি জনতা ব্যাংক। গ্রাহকেরদের জন্য ট্রেড অপারেশন অটোমেশন করা, কর্পোরেট ব্যাংকিং-এ নতুন নতুন সেবার সংযোজন করা, ব্যাংকের গ্রাহক সেবার মান উন্নয়ন, নিরাপদ ও নির্ভুল সেবার নিশ্চয়তার বিভিন্ন ধরনের সেবা চালু রয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভরশীল আধুনিক ব্যাংকে রূপান্তরিত; ডিজিটাল তথ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
ঢাকাওয়াচ: প্রান্তিক মানুষের জন্য ক্ষুদ ঋণ দিতে অনেক ব্যাংক তেমন আগ্রহ দেখায় না, সেক্ষেত্রে আপনার ব্যাংকের অবস্থান ও উদ্যোগ কী?
মজিবর রহমান: দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কটেজ, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অবদান অনস্বীকার্য। সার্বিক গুরুত্ব ও ঋণ ঝুঁকি বিবেচনায়, জনতা ব্যাংক ছোট ছোট উদ্যোক্তাদেরকে অর্থায়নে বেশ উদ্যোগী ভূমিকায় রয়েছে। আমরা প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে প্রচলিত নিয়মাচারের আলোকে ঋণদানে সচেষ্ট আছি। এছাড়া কৃষি ঋণ নিয়ে আমরা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছি।
ঢাকাওয়াচ: জনতা ব্যাংকের বর্তমান অবস্থা কেমন?
মজিবর রহমান: জনতা ব্যাংক একটি শক্তিশালী ও জনপ্রিয় ব্যাংক। স্বাধীনতার পর থেকে এই ব্যাংক মানুষের সেবা দিয়ে আসছে। গত ৮ মাসে ১৪ হাজার কোটি টাকা আমানত বেড়েছে। বর্তমানে আমানতের পরিমাণ ১ লাখ ২৩ হাজার হয়েছে। এছাড়া হিসাবধারীর সংখ্যা বেড়েছে। পুরো ব্যাংকখাতই চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেও আমানত বৃদ্ধি ও হিসাবধারীর সংখ্যা বৃদ্ধি মানেই গ্রাহকের পুরোপুরি আস্থা রয়েছে এই ব্যাংকটির উপরে। এই আস্থা নিয়ে সামনে অনেক দূর এগিয়ে যাবো আমরা। জনতা ব্যাংকে টাকা তুলতে এসে কোনো গ্রাহক কখনো ফেরত যাননি। গ্রাহকের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তাদের আমানতের নিরাপত্তা। জনতা ব্যাংক সেটা সব সময় নিশ্চিত করেছে।
ঢাকাওয়াচ: খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি এখন কী অবস্থায় আছে?
মজিবর রহমান: খেলাপি ঋণ আদায়ে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। তবে চাইলে বড় খেলাপিদের কাছ থেকে দিনে দিনে খেলাপি ঋণ আদায় সম্ভব না। এখানে একটা আইনের জটিলতা রয়েছে। সেই জটিলতা ভাঙতে সময়ের ব্যাপার। তবে ছোট ছোট গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে। এসব কার্যক্রম প্রতিদিন নিয়মিতভাবে ফলোআপ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে খেলাপি ঋণ আদায় নিশ্চিত করতেও সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
ঢাকাওয়াচ: রেমিট্যান্স আহরণে কেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন?
মজিবর রহমান: আমি আসার পর রেমিট্যান্স আহরণে অনেক গুরুত্ব দিয়েছি, ফলে আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর অন্যতম হাতিয়ার রেমিট্যান্স। গত বছর যে রেমিট্যান্স এসেছে, গত সাত মাসে তার চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসছে জনতা ব্যাংকে। রেমিট্যান্স আসাতে আমাদের ডলারের সক্ষমতা বাড়ছে, আমাদের যে হিউজ পরিমাণ এলসি পেমেন্ট বাকি ছিল সেটা পরিশোধ করতে পেরেছি। খেলাপি বাদে বাকি এলসি পেমেন্ট একেবারে শূন্যের কোটায় নিয়ে আসছি। সরকারের বড় বড় এলসি গুলো এককভাবে আমরা খুলতেছি।
ঢাকাওয়াচ: ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে কী বলতে পারেন?
মজিবর রহমান: স্বল্প সুদের আমানত, অটো চালান, ফরেন রেমিট্যান্স বৃদ্ধি এবং শ্রেণিকৃত ঋণ আদায় ও হ্রাস, অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ে জোর দেয়াসহ প্রয়োজনীয় বিভিন্ন বিষয়ে জোর দেয়া হয়েছে। এছাড়া ব্যাংকের ভালো ও নির্ভরযোগ্য বোর্ড অফ ডিরেক্টরস রয়েছে। বোর্ড ও ব্যবস্থাপনা পরিষদের মধ্যে স্বচ্ছতা আছে। অনেক পরিকল্পনা। একটি ভালো ব্যাংক তৈরি করতে যা যা পরিকল্পনা দরকার, সব ধরণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। আমাদের ব্যাংকিং সেবাকে ‘গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড’-এ উন্নীত করার লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছি। দেশে ব্যাংকিং কার্যক্রমের মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলে শিল্প প্রতিষ্ঠান, শ্রমঘন শিল্প প্রতিষ্ঠান, উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার লক্ষ্যে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছি, পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চল ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি। এছাড়া আমাদের প্রধান লক্ষ্য ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। জনতা ব্যাংক একসময় একটি ব্র্যান্ড ব্যাংক ছিল, আমরা সেই অবস্থান পুনরুদ্ধারে কাজ করছি। আমাদের পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে, নতুন পণ্য ও সেবা চালু করে আমানত বাড়ানো। এছাড়া বেশি করে উপশাখা চালু করা। তাছাড়া করপোরেট ঋণ বিতরণে আপাতত বিরতি, পরিবর্তে কৃষি, এসএমই ও নিরাপদ খাতকে অগ্রাধিকার, উদ্ভাবনী ব্যাংকিং সেবা চালু করা এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে আমাদের উপস্থিতি আরও শক্তিশালী করা। ব্যাংকিংয়ের পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোত্তম সেবা নিশ্চিত করা।