
শহীদ ওসমান হাদির ভাই ওমর বিন হাদি বলেছেন, যদি শহীদ ওসমানের রক্তের ঋণ শোধ করতে হয়, তবে বাংলাদেশকে একটি ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন, আধিপত্যবাদের প্রভাবমুক্ত ও ন্যায়পরায়ণ বাংলাদেশই ওসমানের মৃত্যুর প্রকৃত মূল্যায়ন। "এক শহীদের রক্তকে কেন্দ্র করে যে স্বপ্ন বোনা হয়েছিল, সেই স্বপ্নকে রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় রূপ দিতে হবে।"
শুক্রবার (২৬ ডিসেম্বর) রাজধানীর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী প্রদর্শনী কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সদস্য সম্মেলন-২০২৫ এ বক্তৃতায় ওমর বিন হাদি এসব কথা বলেন।
বক্তব্য শুরুতেই তিনি স্মৃতিচারণ করেন, "সম্মেলনে দাওয়াত পেয়েছি শুনে মা আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। বললেন, বাবা, তোমার যাওয়ার দরকার নাই। আমি একটা ছেলেকে হারিয়েছি, তোমাকে আর হারাতে পারব না।" তিনি জানান, মা ভয় পেয়েছিলেন যে ওসমানের বিচারের দাবিতে সক্রিয় হলে তারও ক্ষতি হতে পারে।
তিনি বলেন, "আমি আম্মাকে না বলেই বাসা থেকে বের হয়েছি। আজ আমি ওসমানের ভাই হিসেবে নয়, বরং ওসমানের গর্বিত ভাই হতে চাই।"
ওসমান হাদির স্মৃতিচারণ করে ওমর হাদি বলেন, শাহবাগে ‘নারায়ে তাকবির’ স্লোগান দিয়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার সময় তাকে অনলাইনে কাফনের ছবি পাঠিয়ে হুমকি দেওয়া হতো। তিনি জানান, মেসেঞ্জারে কাফনের কাপড়ের বক্স পাঠিয়ে পরিবারকেও ভয় দেখানো হতো। প্রথম দিকে ওসমান এসব শেয়ার করতেন, পরে আর শেয়ার করেননি।
তিনি আরও স্মরণ করেন, ২০১২ সালে বাবার মৃত্যুর পর দুই ভাই একসাথে পথ চলেছেন। জুলাই আন্দোলনের সময় রামপুরায় তারা পুলিশি বাধা, ভয় ও অনিশ্চয়তার মধ্যেও রাজপথে দাঁড়িয়েছিলেন। ৫ আগস্টের পর তারা ব্যক্তিগত ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে ‘ইনকিলাব মঞ্চ’ প্রতিষ্ঠায় যুক্ত হন।
ওমর বলেন, ওসমান প্রায়ই তাকে ক্যামেরার আড়ালে থাকার পরামর্শ দিতেন। "ভাই, আমি যদি শহীদ হয়ে যাই, আন্দোলন আপনাকেই চালিয়ে যেতে হবে। চেষ্টা করবেন ক্যামেরার আড়ালে থাকতে, যাতে মানুষ বুঝতে না পারে আপনি আমার ভাই।"
তিনি জানান, ভাইয়ের এই নির্দেশই তাকে এতদিন আড়ালে রেখেছিল। কিন্তু হত্যার বিচার এবং ন্যায়বিচারের দাবিই তাকে আজ সামনে এনেছে। শহীদ ওসমানের হত্যার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, এটি ছিল পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। খুনিরা দুই সপ্তাহ আগে থেকে নজরদারি করছিল। একাধিকবার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরও শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে ফেরার পথে ওসমান গুলিবিদ্ধ হন। পরবর্তী শুক্রবার রাতে সিঙ্গাপুরে তিনি শহীদ হন।
ওমর বলেন, "যে স্বাধীন বাংলাদেশে খুনিরা হত্যার ৬ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়, আর আল্লামা সাঈদী, যিনি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী, তাকে ভারতের কারাগারে রাখা হয়, সেই দেশে স্বাধীনতার অস্তিত্বের প্রশ্ন উঠে।"
ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, "ওসমানের চিন্তা ও আদর্শ ৫৬ হাজার বর্গমাইলের প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছে দিতে হবে। আমরা আর পরিবারের কান্না, আহাজারি দেখতে চাই না।"
তিনি উল্লেখ করেন, ১৬ বছর ধরে মানুষের বাক্স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়েছে। "আজও নির্বাচন বা পরবর্তী সরকারের অজুহাতে অনেকেই মানুষের কণ্ঠরোধ করতে চায়। কিন্তু এই দেশের মালিক জনগণ। কোনো সরকার আসবে, তা জনগণই নির্ধারণ করবে।"
আঁতাত ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সতর্ক করে তিনি বলেন, "যদি পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র বা অভ্যন্তরীণ কোনো শক্তি কারো সঙ্গে আঁতাত করে পুনরায় ফ্যাসিবাদ কায়েমে সহযোগিতা করে, তবে আল্লাহর কাছে দায়ী থাকবেন।"
ওমর হাদি আরও বলেন, "ওসমানের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশকে আধিপত্যবাদের প্রভাবমুক্ত করতে হবে এবং এখানে ইনসাফ কায়েম করতে হবে। এটাই আমার ভাইয়ের প্রতি প্রকৃত সম্মান।"
সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম, সঞ্চালনা করেন সেক্রেটারি সাদ্দাম হোসেন। দেশ-বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন। সকাল ৮টায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন জামায়াতে ইসলামের আমির ডা. শফিকুর রহমান।
উপস্থিত ছিলেন জামায়াতে ইসলামের নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান, মাওলানা আব্দুল হালিম, নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন ও মোবারক হোসাইন। এছাড়া আট রাজনৈতিক দলের নেতারা, জামায়াতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতা ও ছাত্রশিবিরের বর্তমান ও সাবেক বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দও উপস্থিত ছিলেন।