
দক্ষিণ লেবাননের দেরদঘায়ার খ্রিস্টানরা ধারবাহিক ইসরায়েলি হামলা এবং বিস্ফোরণের শঙ্কা নিয়েও উদযাপন করেছে ক্রিসমাস, তারা নিজেদের বিশ্বাস, সম্প্রদায় ও ঐতিহ্যের বেপারে গভীরভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ঐতিহাসিকভাবেই লেবানন হাজার বছরের ধর্মীয় এবং বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির ভূমি। আব্রাহামীয় ধর্মগুলোর পবিত্র ব্যক্তি এবং তাদের ঘটনাপ্রবাহের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে লেবাননের বিভিন্ন স্থান। ইসরায়েলের সাথে দীর্ঘ বৈরিতা, যুদ্ধ এবং ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরু হবার পর নতুন করে ধ্বংসলীলা চলছে এই পবিত্র ভূমিতে।
এমন পরিস্থিতিতেই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা উদযাপন করেছে হাজার বছরের উৎসব ক্রিসমাস। সকাল ৯টায় প্রার্থনা শুরু হয়। শীতের তীব্র বাতাসে মাত্র ২০–৩০ জন মানুষ ছোট্ট চ্যাপেলে জমায়েত হন। স্পিকার থেকে বাজানো আরবি ক্রিসমাস গান এ প্রার্থনার মধ্যে আনন্দের সুর ছড়িয়ে দেয়।

দেরদঘায়ার- দক্ষিণ লেবাননের এই ছোট গ্রামটি মূলত খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ। রবিবারের প্রার্থনায় অংশগ্রহণকারীর মধ্যে বেশিরভাগই বয়স্ক, তবে কিছু শিশু ও তরুণও উপস্থিত ছিলেন, যারা ক্যাথলিক দাতব্য প্রতিষ্ঠান কারিতাসের পোশাক পরে এসেছিলেন। স্থানীয় পুরোহিতের বাসস্থানে তৈরি অস্থায়ী চ্যাপেলটি ব্যবহার করা হয়, কারণ গ্রামের স্থায়ী গির্জা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। গত বছর ইসরায়েলি বোমা হামলায় ধ্বংস হয়ে যায় মেলকাইট গ্রীক ক্যাথলিক সেন্ট জর্জ গির্জা। হামলায় কমপক্ষে দুইজন নিহত হন এবং গির্জার প্রধান প্রার্থনা কক্ষ পাথর ও কংক্রিটের স্তূপে পরিণত হয়।

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েল সীমান্তবর্তী এলাকায় বোমা হামলা চালাতে শুরু করে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে সহিংসতা তীব্র হয়, হাজার হাজার বোমা বিস্ফোরণ ও বিমান হামলায় দক্ষিণ লেবানন এবং বৈরুতের দক্ষিণ শহরতলির বেশিরভাগ অংশ ধ্বংস হয়। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে প্রায় দশ লক্ষ মানুষ তাদের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। ইসরায়েলি হামলায় ৪,০০০ এরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।
দেরদঘায়ার রাস্তায় শহীদের পোস্টার ঝুলছে, যেখানে শহীদের তালিকায় রয়েছেন সিভিল ডিফেন্সের একজন খ্রিস্টান স্বেচ্ছাসেবক ও কিছু হিজবুল্লাহ সদস্য। প্রার্থনার সময় কয়েকজন নির্মাণ শ্রমিক ধ্বংসপ্রাপ্ত গির্জার ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার করার চেষ্টা করেন। বাইরে বাতাসে দুলছিল প্লাস্টিকের ক্যান্ডি বেত এবং হাসিখুশি সান্তা মূর্তিগুলি। কয়েকজন মণ্ডলী বোমার আওয়াজকে যুদ্ধবিমানের শব্দ ভেবে ভুল করেছিলেন।

দেরদঘায়ায় বড়দিন উদযাপনের প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্থানীয় সমাজকর্মী জর্জেস এলিয়া । তার এই কর্মসূচি বা প্রচেষ্টার অংশ হিসবে রয়েছে- পার্শ্ববর্তী মুসলিম গ্রামগুলির স্কুল পরিদর্শন এবং সান্তার সাজে মোটরবাইকে চেপে উপস্থিতি। দক্ষিণ লেবাননের বেশিরভাগ বাসিন্দা শিয়া, তবে এখানে খ্রিস্টান, সুন্নি ও ড্রুজ সম্প্রদায়ও রয়েছে। যুদ্ধের উদ্বেগ সত্ত্বেও বিভিন্ন সম্প্রদায় শহরগুলোকে ক্রিসমাস উদযাপনের জন্য সাজিয়ে তুলেছে।
দেরদঘায়ার আরও দক্ষিণে সীমান্তবর্তী খ্রিস্টান অধ্যুষিত গ্রামগুলো ইসরায়েলি হামলার ফলে বিশেষ্ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তুলনামূলক কম ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাো এখন প্রায় প্রতিদিনের বোমার আওয়াজে আচ্ছন্ন, দূর থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা যায়।
দেইর মিমাস গ্রামের ২৬ বছর বয়সী ছাত্র রামি বলেন, “আমরা এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।” গত বছরের হামলার সময় সে উত্তরে পালিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু অনেকেই গ্রামের মধ্যে থেকে গিয়েছিলেন। তারপর থেকে রামি ও তার পরিবার বাড়ি ফিরেছেন, যদিও ছুটির দিনগুলোতে অনেক আত্মীয় গ্রামে আসেন না।
যুদ্ধ ও বোমা হামলার আতঙ্ক সত্ত্বেও, দেরদঘায়ার খ্রিস্টানরা এবারের বড়দিন উদযাপন করে তাদের বিশ্বাস ও ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার সংকল্প দেখিয়েছেন।