
বিশ্বখ্যাত ইসলামি বক্তা ড. জাকির নায়েকের সম্ভাব্য বাংলাদেশ সফর আগামী নভেম্বরের শেষের দিকে; দেশজুড়ে আলোচনার ঝড় তুলেছে। অর্থপাচার এবং ঘৃণামূলক বক্তব্যের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তার আমন্ত্রণ এবং সমাবেশ আয়োজনকে ঘিরে উভয় দিকেই উদ্বেগ ও বিতর্ক দেখা দিয়েছে।
সরকারি সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা এবং পিরোজপুরে তার সমাবেশের আয়োজনের জন্য পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) অনুমতি দিয়েছে। সমাবেশের পরিকল্পনা অনুযায়ী এটি হবে তার প্রথম বাংলাদেশ সফর, যা অনুসারীদের কাছে ‘ঐতিহাসিক মুহূর্ত’ হিসেবে বিবেচিত। তবে চট্টগ্রাম ও সিলেটে, যেখানে সুফি মতাদর্শের অনুসারী বেশি; সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি।
পুলিশ জানায়, ঢাকা ও পিরোজপুরে সুফিবাদী এবং মাজারকেন্দ্রিক ধর্মীয় অনুসারী কম থাকার কারণে জাকির নায়েকের মতাদর্শের কারণে সম্ভাব্য ধর্মতাত্ত্বিক সংঘাতের আশঙ্কা কম।
অন্যদিকে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই সফর নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ৩০ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, ‘জাকির নায়েক ভারতের পলাতক আসামি। আমরা আশা করি, তিনি যেখানে যাবেন; সংশ্লিষ্ট দেশ আমাদের নিরাপত্তা উদ্বেগ বিবেচনায় রাখবে এবং উপযুক্ত পদক্ষেপ নেবে।’
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতের এই মন্তব্যের জবাবে জানিয়েছে, বিষয়টি নোট করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এস এম মাহবুবুল আলম বলেন, ‘আমরা ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের বিবৃতিটি লক্ষ্য করেছি।’ তবে তিনি ভারতের পলাতক বা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আশ্রয় না দেওয়ার বিষয়টিও উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘ভারতসহ কোনো দেশই অন্য কোনো দেশের পলাতক বা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আশ্রয় দেওয়া উচিত নয়।’
ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেনও বলেছেন, জাকির নায়েকের সফর অনুমোদন পুরোপুরি স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভর করবে। তিনি বলেন, ‘আমার এ বিষয়ে কোনো কর্তৃত্ব নেই। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অনুমতি দিলে তিনি আসতে পারবেন।’
২০১৬ সালের হলি আর্টিজান হামলার পর আওয়ামী লীগ সরকার তার ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার পর থেকেই এই সফরের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। ওই হামলার সঙ্গে যুক্ত জঙ্গিরা নায়েকের বক্তব্য দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল বলে তদন্তে উঠে এসেছে।
ইমিগ্রেশন পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন ও পিস টিভির প্রতিষ্ঠাতা জাকির নায়েক ২৬ নভেম্বর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছাতে পারেন। পরদিন তিনি ঢাকায় একটি ইনডোর ইসলামিক অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন, যা সম্ভবত আগারগাঁওয়ের কোনো কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত হবে। এরপর ২৮ নভেম্বর পিরোজপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে একটি আউটডোর সমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। আয়োজক সংস্থা স্পার্ক ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট জানিয়েছে, সরকারি অনুমতি ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতায় অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হবে।
তবে বিষয়টি নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন স্থানীয় কিছু কর্মকর্তা। পিরোজপুর-১ আসনের জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী মাসুদ সাঈদী বলেন, ‘আমি তাকে আমন্ত্রণ জানাইনি, তিনিও আমাকে চেনেন না। এখন আমি নির্বাচনী প্রচারে ব্যস্ত, তাই তার পিরোজপুর সফর সম্পর্কে কিছু জানি না।’
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) উপকমিশনার তালেবুর রহমান জানিয়েছেন, ডিএমপিকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি এবং এখনো কোনো অনুষ্ঠানস্থলের অনুমতি দেওয়া হয়নি। পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা জানায়, চলমান নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিবেচনায় আনুষ্ঠানিক অনুমতি এখনো মঞ্জুর হয়নি।
স্পেশাল ব্রাঞ্চের এক কর্মকর্তা, নাম প্রকাশ না করার শর্তে, গণমাধ্যমকে বলেন, সরকার তার ঢাকায় আগমনে আপত্তি করছে না। তিনি বলেন, ‘তিনি বিশ্বজুড়ে সফর করেন। ঢাকায় এলে তাতে কোনো সমস্যা দেখছি না।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘ভারত তার বিষয়ে ভিন্ন অবস্থান নিতে পারে, কারণ তার জন্ম সেখানেই। আমাদেরও অনেক পলাতক আসামি ভারতে রয়েছে, যাদের ফেরত দেওয়া হয়নি। তাই আমরা তাকে অতিথি হিসাবেই দেখছি; বাংলাদেশ সবসময় অতিথিদের স্বাগত জানায়।’
পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আশরাফুল আলম খান এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এদিকে, জাকির নায়েকের ফেসবুক পেজ, ওয়েবসাইট বা অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমগুলোতে এখনো এই সফর সম্পর্কিত কোনো ঘোষণা পাওয়া যায়নি।
৬০ বছর বয়সী ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইসলামি বক্তা জাকির নায়েক তার তুলনামূলক ধর্মতাত্ত্বিক বক্তৃতার জন্য পরিচিত। ২০১৬ সালে অর্থপাচার ও ঘৃণামূলক বক্তব্যের অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার পর তিনি ভারতে আর ফিরে যাননি। একই বছর তার পরিচালিত টেলিভিশন চ্যানেল পিস টিভি ভারতে নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর তিনি মালয়েশিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি পান এবং জানান, ‘ন্যায়বিচার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত’ তিনি ভারতে ফিরবেন না।’