
জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি মঙ্গলবার স্পষ্টভাবে জানান, রোহিঙ্গা সংকটের উৎপত্তি এবং সমাধান দুটোই মিয়ানমারের মধ্যেই নিহিত। তিনি বলেন, মিয়ানমারের সাহসী পদক্ষেপ ছাড়া এই সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।
জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ‘মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি’ বিষয়ে আয়োজিত উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনে গ্রান্ডি উল্লেখ করেন, “এই সংকটের উৎপত্তি মিয়ানমারে। আর সমাধানও সেখানেই।” তিনি আট বছর আগে সেনাবাহিনীর নির্মম অভিযানের কারণে প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেন, যাদের অনেকে এখনও রাখাইন রাজ্যে বাস্তুচ্যুত অবস্থায় রয়েছেন।
গ্রান্ডি আরও বলেন, “বর্তমানে আরাকান আর্মি রাখাইনের অধিকাংশ এলাকা দখল করলেও রোহিঙ্গাদের অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। তাদের জীবনের দৈনন্দিন বাস্তবতা হলো গ্রেফতার ও আটক হওয়ার ভীতি, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষায় সীমাবদ্ধতা, চলাফেরায় নিষেধাজ্ঞা এবং জোরপূর্বক শ্রম ও নিয়োগ। তারা প্রতিদিন বর্ণবাদ ও আতঙ্কের মুখোমুখি হচ্ছে।”
বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, বর্তমানে দেশটি প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে এবং ২০২৪ সালে নতুন সংঘাত শুরু হওয়ার পর আরও দেড় লাখ রোহিঙ্গাকে গ্রহণ করেছে।
গ্রান্ডি বলেন, “অসংখ্য চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বিশ্বকে অনন্য দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে। তারা প্রমাণ করেছে, দায়িত্বহীনতা ও উদাসীনতা যখন স্বাভাবিক হয়ে যায়, তখনও সহানুভূতি সম্ভব। বাংলাদেশ শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে জীবন রক্ষা করেছে।”
তিনি বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ১.২৫ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তার প্রশংসা করেন, কিন্তু মানবিক তহবিলের ঘাটতি এখনো রয়েছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। গ্রান্ডি সতর্ক করেন, পর্যাপ্ত তহবিল না পেলে জরুরি সহায়তা কমাতে হতে পারে, যার ফলে শিশুদের পুষ্টিহীনতা বাড়তে পারে এবং আরও রোহিঙ্গা বিপজ্জনক সমুদ্রযাত্রায় জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে বাধ্য হবে।
“যদি পর্যাপ্ত তহবিল না আসে, তাহলে আমাদের কিছু কাটছাঁট করতে হবে। তবে আমরা শিশুদের অপুষ্টিজনিত মৃত্যু এবং বিপজ্জনক নৌযাত্রায় রোহিঙ্গাদের প্রাণহানির ঘটনা রোধের চেষ্টা করব,” জানান তিনি।
গ্রান্ডি বিশ্ব সম্প্রদায়কে পুনর্বাসন, শিক্ষা এবং শ্রমবাজারে প্রবেশের সুযোগ বৃদ্ধির আহ্বান জানান। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, “শুধুমাত্র মানবিক সহায়তা দিয়ে এই সংকট সমাধান হবে না। আমরা উদাসীনতার পথে চলতে পারি না। একটি জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস হতে দিয়ে সমাধানের আশা করা যায় না।”
তিনি রাখাইন উপদেষ্টা কমিশনের সুপারিশগুলো এখনো প্রাসঙ্গিক উল্লেখ করে বলেন, “রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে এই নির্দেশনাগুলো গুরুত্ব বহন করে। কিন্তু সাহসী পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না।”
গ্রান্ডি প্রভাবশালী দেশগুলোকে আহ্বান জানান, তারা যেন মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মির সঙ্গে কার্যকরভাবে যুক্ত হয়ে মানবিক সহায়তার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে পারেন। পাশাপাশি আস্থা পুনঃস্থাপন করে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতদের জন্য ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই সমাধান গ্রহণে কাজ করা জরুরি।
সংঘাত থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ধারাবাহিক রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ও নতুন পন্থার মাধ্যমে জটিল সংঘাতের গতিপথ পরিবর্তন করা সম্ভব।”
গ্রান্ডি শেষ করেন, “মিয়ানমারের জনগণের জন্য একটি ন্যায়সঙ্গত, বাস্তবসম্মত এবং ভবিষ্যৎমুখী নতুন অধ্যায় শুরু করতে চাই। রোহিঙ্গাদের দুর্দশার স্থায়ী সমাধানে আমাদের সামনে বিকল্প পথ নেই।”