
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দুই নতুন সাক্ষীর জবানবন্দিতে উঠে এলো সরাসরি গুলির বিবরণ। এক শিক্ষার্থী ও এক সাংবাদিক জানালেন—তারা চোখের সামনে গুলি লাগতে দেখেছেন রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের বুকে।
গতকাল বুধবার, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১–এ নতুন করে সাক্ষ্য দেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিনা মুরমু এবং এনটিভির রংপুর প্রতিনিধি এ কে এম মাইনুল হক।
রিনা মুরমু জানান, ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করতে তিনি নিজ চোখে দেখেছেন। তার ভাষায়, "ঘটনার দিন আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেখান থেকে আমি আবু সাঈদকে গুলি করতে দেখেছি। দুজন পুলিশ আবু সাঈদকে গুলি করে। পরে জানতে পারি তাদের নাম আমির ও সুজন চন্দ্র। এরপর আনুমানিক বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে জানতে পারি আবু সাঈদ মারা গেছেন। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, ছাত্রলীগ ও রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের যারা সরাসরি গুলি করেছিলেন, তারা দায়ী। আমি তাদের বিচার চাই।"
এদিকে, এনটিভির সিনিয়র করেসপনডেন্ট মাইনুল হক তার জবানবন্দিতে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেন, কীভাবে তিনি ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন এবং তা লাইভ সম্প্রচার করেছিলেন।
তিনি বলেন, “দুহাত প্রসারিত করে রাস্তায় দাঁড়ানো যুবকের কাছ থেকে মাত্র কয়েক গজের দূরত্বে ১নং গেটের সামনে অবস্থানরত পুলিশ যারা আগে থেকে গুলি করছিলেন, তারা দু হাত প্রসারিত করা যুবককে উদ্দেশ করে গুলি করেন। এই দৃশ্য তখন এনটিভিতে লাইভ সম্প্রচার চলছিল। পুলিশের করা গুলি ওই যুবকের সামনে থেকে বুকে ও পেটে বিদ্ধ হয়।”
মাইনুল জানান, ঘটনার দিন ১৬ জুলাই ২০২৪, দুপুর ২টার আগে থেকে তিনি ও সহকর্মী আসাদুজ্জামান আরমান রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১নং গেটের সামনের পার্ক মোড়ে রিপোর্টিং করছিলেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনের কর্মীরা মিছিল নিয়ে এগিয়ে এলে সেখানে আগে থেকে অবস্থানরত পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে তখন লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস ও গুলিবর্ষণ শুরু হয়।
তিনি আরও বলেন, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আবু সাঈদ পেছনে পড়ে যান এবং তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। এনটিভির লাইভে এই পুরো দৃশ্য সম্প্রচার হয়। পরবর্তীতে তিনি জানতে পারেন, আহত ওই যুবক রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের ছাত্র আবু সাঈদ এবং বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে তার মৃত্যুর খবর আসে।
এই মামলার শুনানি নিচ্ছেন বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন সাক্ষীদের জেরা করেন। প্রসিকিউশন পক্ষে শুনানি পরিচালনা করেন মিজানুল ইসলাম।
৩০ আসামির বিরুদ্ধে বিচার শুরু
এদিকে, একই দিনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২, ছাত্র আবু সাঈদ হত্যায় দায়ের করা পৃথক মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় ৩০ জন আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছেন। ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ এ আদেশ দেন। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন নির্ধারিত হয়েছে ২৭ আগস্ট।
আসামিদের মধ্যে ছয়জন বর্তমানে আটক রয়েছেন। তারা হলেন: এএসআই আমির হোসেন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম, কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়, ছাত্রলীগ নেতা ইমরান চৌধুরী, রাফিউল হাসান রাসেল ও আনোয়ার পারভেজ। অভিযোগ গঠনের সময় তারা আদালতে উপস্থিত ছিলেন। ট্রাইব্যুনাল প্রত্যেক আসামিকে অভিযোগ পড়ে শুনিয়ে দোষী না নির্দোষ জিজ্ঞাসা করলে তারা নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। এরপর ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ থেকে অব্যাহতির আবেদন খারিজ করে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন।
বিচারকাজের অগ্রগতি
আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত এই মামলায় এর আগে কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। ৩ আগস্ট প্রথম সাক্ষ্য দেন খোকন চন্দ্র বর্মণ। এরপর ৪ আগস্ট সাক্ষ্য দেন আহত আন্দোলনকারী আব্দুল্লাহ আল ইমরান ও পারভীন।
উল্লেখ্য, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ঘটে যাওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ১ জুন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল। তার পাশাপাশি মামলার অপর দুই প্রধান অভিযুক্ত সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধেও অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু হয়।
সাবেক আইজিপি মামুন এরই মধ্যে দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হিসেবে আদালতে সহযোগিতা করছেন। গতকালও তিনি ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন এবং তার পক্ষে ছিলেন আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।
আন্দোলন, গুলি, মৃত্যু
আবু সাঈদের মৃত্যু ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই দুপুরে ঘটে, যখন সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে সারা দেশে আন্দোলন চলছিল। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সংগঠক হিসেবে আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন আবু সাঈদ। তার গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। জনস্রোতের চাপে শেষ পর্যন্ত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা।
পরবর্তীতে তদন্ত প্রতিবেদন ও অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে ৩০ জনকে অভিযুক্ত করে মামলার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। ২৮ জুলাই শুনানি শেষে গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার শুরুর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।