টাকা না পেয়ে অটোচালককে বানানো হয় ইয়াবা কারবারি
- কক্সবাজার প্রতিনিধি
- প্রকাশঃ ০৭:১০ পিএম, ১৪ মার্চ ২০২৫

কক্সবাজারের প্রবেশমুখ লিংক রোড সিএনজি স্ট্যান্ড থেকে গত রোববার (৯ মার্চ) সকাল ১০টার দিকে বজল করিম নামে সিএনজিচালিত অটোরিকশার এক চালককে আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) কক্সবাজার শাখা। সে সময় মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা কয়েক ধাপে তার অটোরিকশায় তল্লাশি চালালেও কিছুই পাননি। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঘটনাস্থল থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে ঝাউতলা গাড়ির মাঠে। সেখানে গিয়ে বজল করিমের স্ত্রীকে ডেকে দাবি করা হয় ৫ লাখ টাকা। অন্তত ৫ ঘণ্টা ধরে দরকষাকষি চললেও বজলের স্ত্রী টাকা দিতে না পারায় বিকেল ৩টার দিকে ১ হাজার ৮০০ পিস ইয়াবা দিয়ে ছবি তুলে তা প্রকাশ করা হয়। একাধিক সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ, আটকের সময়, মামলার এজাহার ও একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে কালবেলা। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বজলের স্ত্রীর কাছে টাকা দাবির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন, তবে বজলকে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
বজলকে আটকের পর মাদক উদ্ধারের ঘটনায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কক্সবাজার জেলা শাখার উপপরিদর্শক মো. তায়রীফুল ইসলাম বাদী হয়ে একটি মামলা করেন, যার এজাহারে বলা হয়, ৯ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টায় খবর পেয়ে সহকারী পরিচালক দিদারুল আলমের দিকনির্দেশনায় দুপুর ১টার দিকে বজল করিমকে অটোরিকশায় অবস্থানরত অবস্থায় আটক করা হয়। অটোরিকশা দুপুর দেড়টার দিকে ঝাউতলা গাড়ির মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়। দুপুর ২টার দিকে গাড়ির ভেতরে থেকে ৯ প্যাকেটে ১ হাজার ৮০০ পিস ইয়াবা সদৃশ ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়। কালবেলার অনুসন্ধান, ঘটনাস্থলের একাধিক সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে মামলার এজাহারের সঙ্গে প্রকৃত ঘটনার মিল পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া মাদকদ্রব্যের কর্মকর্তারাও ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন।
একটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ৯ মার্চ সকাল ১০টা ৭ মিনিটে ডিএনসির কর্মকর্তারা সিভিলে বজল করিমকে আটক করে ধরে তার অটোরিকশার কাছে নিয়ে আসেন। ১০টা ১৬ মিনিট পর্যন্ত অটোরিকশায় তল্লাশি চালিয়ে কিছুই পাননি তারা। এরপর কর্মকর্তারা বজলকে নিয়ে ঝাউতলা গাড়ির মাঠের দিকে রওনা হন ডিএনসির কর্মকর্তারা।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত অটোরিকশার লাইনম্যান নুরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ভোর ৫টায় বজল ভাই স্ট্যান্ডে এসে অটোরিকশার সিরিয়াল দেন এবং ৫টা থেকে উনি স্ট্যান্ডেই ছিলেন। দুটি গাড়ির পরই তার সিরিয়াল ছিল। গাড়ি স্ট্যান্ডে রেখে তিনি আশপাশে হাঁটাহাঁটি করছিলেন। এমন সময় মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা তাকে আটক করে গাড়ি চেক করেন। চেক করে কিছু না পেয়ে নিয়ে যেতে চাইলে আমরা বাধা দিই। তখন কর্মকর্তারা বলেন, ‘ওনার কাছে যেহেতু কিছু পাইনি ওনার সমস্যা নাই। প্রাথমিক কিছু জিজ্ঞাসাবাদ আছে, জিজ্ঞাসা করে ছেড়ে দেব।’
লিংক রোড অটোরিকশা মালিক সমিতির সভাপতি আনোয়ারুল ইসলাম বজলকে আটকের কথা শুনেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছিলেন।
তিনি জানান, মাদকের কর্মকর্তারা তাদের ডিবির অফিসার হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন। আনোয়ারুল এ জন্য প্রথমে কক্সবাজার ডিবিতে খবর নেন। পরে তিনি জানতে পারেন বজলকে ঝাউতলা গাড়ির মাঠে নিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। এরপর তিনি সেখানে যান।
আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘আমি গিয়ে জানতে চাই তাকে কেন ধরে আনা হয়েছে। তখন ওখানে থাকা চাকমা (তন্তুমনি চাকমা) অফিসার বলেন, আমি কিছু বলতে পারব না। এটা স্যার (এডি দিদারুল) ডিল করতেছেন। আপনি স্যারের সঙ্গে কথা বলেন। এ ছাড়া আরও কয়েকজন কনস্টেবল আমাকে জানান, ‘ওনার কাছে কিছু পাওয়া যায় নাই। ওনাকে আমরা ছেড়ে দেব। আপনি একটু ওয়েট করেন, স্যার আসুক।’ পরে আমি ওয়েট করতে থাকি, তাদের স্যার আর আসে না। প্রায় ৪ ঘণ্টা পর এডি দিদারুল এসে চোখ গরম করে গালাগাল করতে থাকেন। আর বলেন, ওকে হ্যান্ডকাফ লাগাও। তখন দিদারুলের নিজের হাতে নিয়ে আসা একটি ব্যাগের ভেতর থেকে ইয়াবার প্যাকেট বজলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ছবি তুলতে থাকেন। উনি সঙ্গে করে সাংবাদিক নিয়ে যান, সেই সাংবাদিক ভিডিও করেন। আমি কথা বলতে গেলে দিদারুল আমাকে ধমক দেন।’
একই ধরনের কথা বলেছেন বজলের স্ত্রী রাশেদা বেগম। তিনি বলেন, ‘আমি ঝাউতলা মাঠে গেলে তাদের একজন লোক আমার কাছে প্রথমে ৫ লাখ টাকা দাবি করে। পরে দিদারুল স্যার ৩ লাখ টাকা দিতে বলেন। ৩ লাখ টাকা দিলে আমার স্বামীকে ছেড়ে দেবে বলে জানান। কিন্তু টাকা না দিতে পারায় দিদারুল তার সঙ্গে করে নিয়ে আসা ব্যাগের ভেতর থেকে ইয়াবা বের করে আমার স্বামীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে ছবি তোলেন।’
সহকারী পরিচালক দিদারুলের সঙ্গে করে নিয়ে আসা সাংবাদিকের ভিডিওটি গণমাধ্যমের হাতে এসেছে। সেই ভিডিওতে প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায়। ভিডিওটির প্রথম ৩ সেকেন্ড খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম সেকেন্ডে দেখা যায়, দিদারুলের পাশে থাকা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সিপাহি মো. মনির হোসেন একটি ব্যাগ থেকে ইয়াবা বের করে বজলের হাতে দিচ্ছেন। মনির হোসেনের বাম হাতে ব্যাগ আর ডান হাত দিয়ে ইয়াবা দিতে দেখা যায় হ্যান্ডকাফ পরা বজল করিমের হাতে। এরপর সেখানে একটি বক্তব্যে সহকারী পরিচালক দিদারুল বলেন, আমরা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তাকে কলাতলী থেকে আটক করেছি। তিনি রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে ইয়াবার চালান নিয়ে আসছিলেন। অথচ তাকে আটক করা হয় লিংক রোড থেকে।
এ নিয়ে সহকারী পরিচালক একেএম দিদারুল আলম বলেন, ‘গোপন সংবাদের ভিত্তিতে উখিয়া থেকে মাদকের চালান নিয়ে যাওয়ার সময় অটোরিকশা থামিয়ে বজল মিয়াকে মাদকসহ আটক করা হয় বলে জেনেছি।’
গণমাধ্যমের হাতে থাকা একাধিক সিসিটিভি ফুটেজ ও ভিডিওর বিষয়টি উল্লেখ করে জানতে চাইলে মাদকের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এই বিষয়ে কিছু জানি না। আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মিটিংয়ে ছিলাম। ঘটনাটি জেনেছি দুপুর ১টার দিকে। এমন কিছু হয়ে থাকলে অভিযানে থাকা অফিসাররা করেছে।’
৫ লাখ টাকা দাবির বিষয়টিও অস্বীকার করেন এই কর্মকর্তা।
মামলার বাদী মো. তায়রীফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা তাকে দুপুর ১২টা বা ১টার দিকে স্ট্যান্ড থেকে আটক করি।’
সিসিটিভি ফুটেজে ১০টায় আটকের বিষয়টি উল্লেখ করলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
এরপর ভোর ৫টা থেকে স্ট্যান্ডে থাকা সিএনজি কীভাবে উখিয়া থেকে এলো- এমন প্রশ্নেও তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
এরপর লিংক রোডে আটক করে ৮ কিলোমিটার দূরে ঝাউতলা কেন নেওয়া হলো- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি কোনো ভ্যালিড প্রশ্ন নয়। আমরা মাদক পাইছি, আপনি দরকার হলে আসামি জামিনে বের হলে তার কাছে জিজ্ঞেস কইরেন।’
প্রতিকার চেয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন আটক বজল করিমের স্ত্রী রাশেদা বেগম। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, স্থানীয় বাসিন্দা ও তার আত্মীয় রশিদ আহমদ ওরফে ধলা মিয়ার সঙ্গে তাদের দীর্ঘ দিন ধরে জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ চলছে। ধলা মিয়া এলাকার একজন চিহ্নিত মাদক কারবারি হিসেবে পরিচিত। তিনিই তার স্বামীকে ফাঁসিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাদকের কর্মকর্তারা চাঁদা দাবির পরে রাশেদা বেগম বিষয়টি স্থানীয় সাংবাদিক শাহীন মাহমুদ রাসেলকে জানান। রাসেল বিষয়টি নিয়ে অভিযানে থাকা মাদকের কর্মকর্তা তন্তুমনি চাকমার সঙ্গে কথা বলেন। এতে কাজ না হলে রাসেল সহকারী পরিচালক দিদারুলকে ফোন করেন। তিনি ফোন না ধরায় টেক্সট করেন। এতে ক্ষিপ্ত হন দিদারুল। পরে রাশেদার স্বামীকে মাদক মামলায় ফাঁসিয়েই ক্ষান্ত হননি, সাংবাদিক শাহীন মাহমুদ রাসেলকেও মাদক মামলায় ফাঁসানোর ষড়যন্ত্র করেন। এরপর সেদিন রাতেই এক মাদক কারবারিকে ধরে নিয়ে সাংবাদিক ডেকে মিডিয়ার সামনে তাকে দিয়ে বলান সাংবাদিক শাহীন মাহমুদ রাসেল মাদক কারবারি। পরে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
এ নিয়ে শাহীন মাহমুদ রাসেল বলেন, ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গঠিত তদন্ত টিমের কাছে জবানবন্দি দিতে যাওয়ার পর মঙ্গলবার বিকেলে কক্সবাজার জেলার মূলধারার সাংবাদিকদের সামনে আমার কাছে নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চান এডি দিদারুল। এ ছাড়া বিষয়টি সমাধানের জন্য নানা মাধ্যমে আমাকে মোটা অঙ্কের টাকার প্রস্তাব দেন।’
শাহীন মাহমুদ রাসেল আরো বলেন, ‘আমি সত্যের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম বলেই আমাকে টার্গেট করে মিথ্যা মাদক মামলা দেওয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছে। এডি দিদারুলের বিরুদ্ধে তদন্ত হলেও আমি শঙ্কিত। কারণ তিনি এরই মধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করার চেষ্টা করছেন। আমাকে ইয়াবা মামলায় ফাঁসানোর অপচেষ্টার অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি। কিন্তু এখনো পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় বিচার পাব কিনা সন্দেহ দেখা দিয়েছে।’