চাটমোহরের জমি জবর দখলের অভিযোগ
- পাবনা প্রতিনিধি
- প্রকাশঃ ০৪:৩৫ পিএম, ২৮ মার্চ ২০২৫

পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার হান্ডিয়াল ইউনিয়নে জমি জবর দখলে রাখার অভিযোগ উঠেছে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। বিগত পতিত আওয়ামী সরকারের সময় ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে হুমকি ধামকি দিয়ে বছরের পর বছর ১১ একর ৬০ শতাংশ জমি নিজেদের দখলে রেখেছে প্রতিপক্ষ। ভুক্তভোগীরা বিবাদমান জমি নিয়ে আদালতের একতরফা ডিগ্রি পেলেও মানছেন না প্রতিপক্ষের লোকজন।
অভিযোগের তীর হান্ডিয়াল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রবিউল করিম, তার ভাই আব্দুর রহমান, আব্দুল আজিজ, আব্দুল মজিদ, শামসুল আলম, নজির প্রামাণিক গংয়ের দিকে। তবে তাদের দাবি, তারা কেনাসূত্রে জমির মালিক। এসএ এবং আরএস রেকর্ডও তাদের নামে। তাই যারা জমি দাবি করছেন তাদের অভিযোগের ভিত্তি নাই। এ নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। সেখানেই তারা প্রমাণ করুক তাদের দাবি সত্য নাকি মিথ্যা।
অভিযোগে জানা গেছে, হান্ডিয়াল ইউনিয়নের মারিয়া স্থল মৌজায় ১১ একর ৬০ শতাংশ জমির ডিএস রেকর্ড অনুযায়ী মালিক নুরুল হক সরকার গং। ১৯৫১ সালে ওই জমি নিয়ে খাজনার মামলা করে সরকার পক্ষ। মামলা নম্বর ৩০২/৫১। তার প্রেক্ষিতে জিংক জারী হয় ১৯৫৩ সালে। যার নম্বর ৮১৫/৫৩। এর মাধ্যমে বিবাদমান জমি সম্পূর্ন সরকারের নামে হয়ে যায়। সরকার তখন ওই জমি ১৯৫৪ সালের ২০ মার্চ ডিএস মালিকপক্ষকে না জানিয়ে কোনো নোটিশ না করে নিলাম বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে একই এলাকার বাসিন্দা শশধর হালদারের কাছে বিক্রি করে। এরপর ১৯৫৪ সালের ২০ মে তার নামে জমি অবধারিত বহাল হয়।
বিবাদীপক্ষ বিষয়টি অবগত না থাকার কারণে ডিএস মালিকপক্ষে হিলু সরকার গং ১৯৫৯ সালে জানার পর নিলাম বাতিলের জন্য জেলা পাবনার তৃতীয় মুনসেফি আদালতে ইউএস/ইউ/এস/১৭৪(৩) বিটি এ্যাক্ট আইনে একটি রদ মামলা দায়ের করেন। বিবাদী করা হয় পূর্ব পাকিস্তান সরকার ও জমি ক্রেতা শশধর হালদারকে। পরবর্তী ছোলেনামা শর্ত মোতাবেক শশধরের ৮৫ শতাংশ জমি বাদে বাদ বাকি ১০ একর ৭৫ শতাংশ বাদিপক্ষ হিলু সরকার গংয়ের পক্ষে আংশিক রদরহিত হয় ১৯৬১ সালের ১৪ নভেম্বর।
তারপর ওই জমি ভ্রমাত্মকভাবে এসএ রেকর্ড শশধর হালদারের নামে অন্তর্ভূক্ত হয়। যা ডিএস মালিকপক্ষের ওয়ারিশগণ অবগত ছিল না। ওই রেকর্ডীয় বিষয়ে ১৯৭৬ সালে খাজনা খারিজ করতে গিয়ে বিষয়টি অবগত হয় ডিএস মালিকপক্ষ। ১৯৭৬ সালে উক্ত রেকর্ড সংশোধনের জন্য পাবনার তৃতীয় মুনসেফী আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। যার নম্বর ৮০২/৭৬। পরবর্তী যা আদালত বদলিজনিত কারণে যুগ্ম জেলা জজ আদালতে এই মামলাটি নতুন করে নথিভূক্ত হয়। যার নম্বর ৩৬১/১৯৮২। যাহা চলমান থাকা অবস্থায় বিশেষ কারণে পূর্ণ দাখিল সাপেক্ষে আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে প্রত্যাহার করে সেই শর্ত মোতাবেক অত:পর ১৩৭/১৯৮৪ নম্বর মামলা দায়ের করা হয় একই আদালতে। বাদি ডিএস মালিক পক্ষে ছকির উদ্দিন গং।
রেকর্ড সংশোধনের মামলা চলমান অবস্থায় শশধর হালদার চতুরতার আশ্রয় নিয়ে কিছু জমি অন্যত্র বিক্রি করেন। দলিলমুলে ওই জমি ক্রেতারা জোরপূর্বক দলীয় ক্ষমতাবলে ভয়ভীতি হত্যার হুমকি দিয়ে আংশিক জমি (৮ একর ৬ শতাংশ) জবর দখল করে আসছেন। পরে বাদিপক্ষ নিরুপায় হয়ে ১৯৮২ সালের ২৮ ডিসেম্বর ১৪৪ ধারা মামলা করেন। তারা সেটিও মানেননি। কিন্তু ১৯৮২ সালের ৫২ ধারা অনুযায়ী মামলা চলমান অবস্থায় জমি ক্রয় বিক্রয় করা যাবে না। সে হিসেবে জমিক্রেতাদের দলিলই অবৈধ।
উপজেলা ওয়ারী মামলা ভাগ হয়ে যাওয়ায় মামলাটি চাটমোহর সিনিয়র সহকারি জজ আদালতে এসে ১৪৪/৯৪ নম্বর ধারণ করে। ওই মামলাটির এক পর্যায়ে ১৯৯৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর বাদি পক্ষ ডিগ্রি প্রাপ্ত হয়। অত:পর ডিগ্রির বিরুদ্ধে মিস ছানি মামলা করেন বিবাদীপক্ষ শশধর হালদারের ছেলে শচিন্দ্রনাথ হালদার। মামলা নম্বর ৩৭/৯৫। যা শুনানী শেষে ২০০১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি না মঞ্জুর হয়। ছানি মামলা না মঞ্জুর হওয়ায় বিবাদি শচিন্দ্রনাথ হালদার মিস আপিল দায়ের করেন। যার নম্বর ১০/২০০১। ওই মিস আপিল আদালত কর্তৃক উভয়পক্ষ মুঞ্জুর হওয়ার পর মিস ৩৭/৯৫ নম্বর ছানী মোকদ্দমা বিচারের আদেশ দেওয়া হলে ওই মিস ৩৭/৯৫ নম্বর ছানী মোকদ্দমা গত ২০১১ সালেল ৪ অক্টোবর না মঞ্জুর বাতিল হয়। তারপর বাদিপক্ষ কমিশনার নিয়োগের আদেশ চাইলে আদালত অ্যাডভোকেট আব্দুল হককে কমিশনার নিযুক্ত করেন। তিনি কমিশনার কার্যক্রম সম্পন্ন করে বিজ্ঞ আদালতে গত ২০১২ সালের ১১ জানুয়ারি) কমিশনার রিপোর্ট দাখিল করেছেন।
এ বিষয়ে বাদিপক্ষের ভুক্তভোগী মৃত নইম উদ্দিন সরকারের ছেলে আলমগীর হোসেন বলেন, ‘তারা বছরের পর বছর দলীয় ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে জমিগুলো জবর দখল করে আছে। আমরা আদালতের রায় পেলেও তারা সেটা মানে না। আমাদের জমিও এখনও বুঝিয়ে দেয়নি। আমরা জমির কাছে গেলেই তারা মারতে আসে, হুমকি দিয়ে তাড়িয়ে দেয়। ইউনিয়ন পরিষদের বিচার বসলেও তারা কিছুই মানতো না। আমরা চাই প্রশাসনের কাছে তারা যেন আমাদের ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দেয়।’
আলমগীরের ভাই শিমুল হোসেন বলেন, ‘নালিশী সম্পত্তিতে আমাদের অনেকগুলো ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও তারা জমি ছাড়ছে না। জবর দখল করে আছে। ডিগ্রি পাওয়ার পর তাদের কাছে একাধিকবার গিয়ে বলেছি যে, তোমার আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আমাদের জমিগুলো ফিরিয়ে দাও। কিন্তু তারা আইনের কথা মানে না। তারা তাদের ক্ষমতাবলে বাহুবলে আমাদের বেদখল করে রাখছে। মামলা চলমান অবস্থায় তারা জমি কিনেছে। কিন্তু আইন অনুযায়ী তো মামলা চলা অবস্থায় জমি কেনাবেচা যায় না। তাহলে তাদের দলিল তো অবৈধ। অথচ তারা আইন নিয়মকানুন কিছুই মানে না। প্রশাসনের কাছে দাবি, আপনারা আমাদের কাগজপত্র দেখে সমাধানের ব্যবস্থা করেন।’
অভিযোগের বিষয়ে রবিউল করিম বলেন, ‘তারা তো একের পর এক মামলা করেই আসছে। তারা না জানিয়ে একতরফা ডিগ্রি পেলে তো হবে না। ওটার বিরুদ্ধে আপিল আছে। সেই পথেই গেছি আমরা। ওরা মামলা করছে জমির আগের মালিক শশধর হালদারের নামে। কিন্তু জমি তো আর শশধর হালদারের কাছে নাই। ৫০ বছর আগে থেকে তৃতীয়পক্ষ মানে আমাদের হাতে আছে। এখন শশধর হালদারের মামলা করতে আমরা তো আর জানি না। আমাদের জানাতে হবে তো নাকি। আপিল করেছি সেটা চলমান। তাদের দাবি ভিত্তিহীন।’
আব্দুল মজিদের ছেলে আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘তারা যে ডিগ্রির কথা বলছেন বা যে কাগজপত্র দেখাচ্ছেন তার বিপরীতে আমি বলতে চাই, তারা একতরফা ডিগ্রি নিয়েছেন। বিবাদীকে যে নোটিশ করা হয়েছিল সেই নোটিশগুলো তারা গোপন করেছিলেন। আমরা বর্তমানে যারা ভোগদখলে আছি তারা এটা জানার পরে আদালতে আপিল করেছি। তারা আবার আমাদের শশধর হালদারের পক্ষভুক্ত না করার জন্য আবেদন করেছিল। কিন্তু আদালত সেটা না মঞ্জুর করে। তারপর থেকে আমরা পক্ষভুক্ত হয়ে মামলা মোকাবেলা করছি। সকল পেপারস ডকুমেন্টস আমাদের কাছে আছে। তারা যদি আমাদের সাথে আদালতে মামলা মোকাবেলা করে ডিগ্রি পায় তাহলে আমরা জমি ছেড়ে দেবো।’
দেরাজ উদ্দিনের ছেলে ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘৫৪ সালে নিলাম সূত্রে জমির মালিক ছিলেন শশধর হালদার, সরকারও তাকে জমির দখল বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। ৬২ সালে এসএ রেকর্ডও তার নামে হয়। আবার ৭৮ সালে আর এস রেকর্ডও হয় তার নামে। তারপর শশধর হালদার বিক্রির প্রস্তাব দিলে তার কাছ থেকে জমি কেনার পর আমরা ক্রয়সুত্রে মালিক হই। মোট ৩২ বিঘা জমির মধ্যে যারা মামলার বাদি সেই পক্ষ আবার ১০ বিঘা জমি কিনে নেয়। তাহলে নিলামটা কিন্তু তারাও মেনে নিয়েছিল। একতরফা ডিগ্রি তো কোনো ডিগ্রি না। আমাদের না জানিয়ে করছে। এখন আমরা মামলা মোকাবেলায় গেছি। সেখানে প্রমাণ করুক সমস্যা নাই।’