কেমন আছেন বাগেরহাটের আত্মসমর্পণ করা জলদস্যুরা?
- বাগেরহাট প্রতিনিধি
- প্রকাশঃ ০৭:০১ পিএম, ৩১ মার্চ ২০২৫

বাগেরহাটের রামপাল খেয়াঘাটে নিজের মাহিন্দ্রা পরিষ্কার করছেন ৪৫ বছর বয়সী কামাল শিকারী। কাঁধের গামছা দিয়ে যত্ন করে ধুলোমাখা গাড়িটি ঝাড়ছেন তিনি। পরিচ্ছন্নতার কাজ শেষে যাত্রী নিয়ে ছুটবেন ফয়লা-ভাগা রুটে। মাহিন্দ্রা চালিয়ে যা আয় হয়, তাতেই চলে দক্ষিণ শ্রীফলতলা গ্রামের কামাল শিকারীর চার সদস্যের সংসার।
এক সময় সুন্দরবনের আতঙ্ক হিসেবে পরিচিত ছিলেন কামাল। জলদস্যু হিসেবে জীবন কাটিয়েছেন বছরের পর বছর। সেই জীবন ছেড়ে ২০১৮ সালে আত্মসমর্পণ করেন।
কামাল বলেন, ‘যখন জঙ্গলে ছিলাম, টাকা-পয়সার অভাব ছিল না, কিন্তু রাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারতাম না। অস্ত্র থাকার পরও সব সময় ভয় কাজ করতো- কখন কী হয়ে যায়। আত্মসমর্পণের পর পরিবার নিয়ে ভালো আছি। সরকার মাথা গোঁজার মতো একটি ঘর দিয়েছে। মাহিন্দ্রা চালিয়ে মোটামুটি সংসার চলে। কোনো দিন ভাবিনি পরিবারের সাথে আবারও ঈদ করতে পারব। সমাজ একটা সময় আমাদের খারাপ চোখে দেখতো জলদস্যু বলে ডাকতো। এখন সমাজে আমাদের অনেকটা মেনে নিয়েছে। একটা সময় কেউ কাজ করতেও ডাকত না। তবে সরকার যদি আমাদের দিকে একটু নজর দিত, তাহলে আরও ভালোভাবে বাঁচতে পারতাম।’
কামালের মতোই এক সময় অন্ধকার জগতে ছিলেন আব্দুল হান্নান সরদার। এখন মৎস্য ঘেরে কাজ করেন, বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালন করেন তার স্ত্রী। স্বামী-স্ত্রীর সম্মিলিত আয়েই চলে চার সদস্যের সংসার।
২০১৬ সালে আত্মসমর্পণ করা হান্নান বলেন, ‘অন্ধকার জীবন থেকে আলোর পথে এসেছি। কিন্তু এখনো অনেক প্রতিকূলতা পেরোতে হচ্ছে। সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আমাদের মামলা প্রত্যাহারের, কিন্তু এখনো সে প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়নি। আমাদের অনেকের মাথার ওপর মামলা ঝুলে আছে। আমরা চাই, সাধারণ নাগরিকের মতো বাঁচার সুযোগ দেওয়া হোক।’
রামপাল-শ্রীফলতলা সড়কের পাশে ছোট্ট মুদি দোকান চালান পঞ্চাশোর্ধ্ব সাব্বির শেখ। মা, স্ত্রী, তিন ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে ছয়জনের সংসার তার এই দোকানের আয়েই চলে। সাব্বিরও এক সময় জলদস্যু ছিলেন। ২০১৮ সালে আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু এখনো মামলা থেকে মুক্তি পাননি।
সাব্বির শেখ বলেন, ‘সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। আমরা ভালো আছি, কিন্তু মামলা এখনো রয়ে গেছে। সরকারের কাছে অনুরোধ, দ্রুত মামলা প্রত্যাহার করে আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ দিন।’
তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর র্যাবের পক্ষ থেকে আমাদের ঈদ উপহার দিত। এই বছর আমরা পাইনি। তবুও পরিবার-পরিজন নিয়ে সারা জীবন যেন থাকতে পারি দেশবাসীর কাছে সেই দোয়া চাই। সরকার যদি আমাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতো তাহলে আমরা সাধারণভাবে জীবনযাপন করতে পারতাম। এখনো পর্যন্ত ভয়ে থাকতে হয়।’
এই তিনটি ঘটনার চরিত্র আলাদা হলেও তাদের পরিচয় এক। তারা এক সময় ছিলেন সুন্দরবনের দস্যু। সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তারা আত্মসমর্পণ করেছেন, চেষ্টা করছেন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার। ঈদে নতুন কাপড় কিংবা বিলাসী খাবারের ব্যবস্থা না থাকলেও পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতেই তারা খুশি।
তবে তাদের জীবনে এখনো অনিশ্চয়তার ছায়া। আত্মসমর্পণের সময় দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী হত্যা ও ধর্ষণ মামলার বাইরে থাকা সকল মামলা প্রত্যাহারের কথা থাকলেও, এখনো অনেকের বিরুদ্ধে মামলা ঝুলে আছে। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ৩২৬ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছিলেন। তাদের মধ্যে কিছু লোকের মামলা প্রত্যাহার করা হলেও, বেশিরভাগের বিরুদ্ধে মামলা বহাল রয়েছে।
এদিকে আত্মসমর্পণকারী দস্যুদের পরিবারগুলোও নানা জটিলতার মুখোমুখি হচ্ছে। নামা প্রকাশ করতে না চাওয়া সাবেক জলদস্যুদের স্ত্রীরা বলেন, ‘যখন তারা জঙ্গলে ছিল, প্রতিদিন আতঙ্কে কাটতো আমাদের জীবন। কখনো গ্রেপ্তারের ভয়, কখনো মৃত্যুর শঙ্কা। এখন অন্তত সেই ভয় নেই। কিন্তু মামলা থাকায় নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।’
আত্মসমর্পণকারী দস্যুরা সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা চাই স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে, সমাজের সাধারণ মানুষের মতো বাঁচতে। সরকার যদি দ্রুত আমাদের মামলা প্রত্যাহারের ব্যবস্থা নেয়, তাহলে সত্যিকারের মুক্ত জীবন পাওয়া যাবে।’
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার (২৭ মার্চ) র্যাবের মহাপরিচালকের পক্ষ থেকে আত্মসমর্পণ করা জলদস্যুদের মাঝে ঈদ শুভেচ্ছা, উপহার সামগ্রী ও নগদ টাকা তুলে দেন র্যাব-৬’-এর অধিনায়ক।
র্যাব-৬’-এর অধিনায়ক মুহাম্মদ শাহাদত হোসেন বলেন, ‘র্যাবের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সরকার সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত ঘোষণা করে। বর্তমানে সুন্দরবনে র্যাবের তৎপরতায় দস্যুতার ঘটনা অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণে। আত্মসমর্পণকারী জলদস্যুরা পুনবার্সিত হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত রাখার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বিভিন্ন সময় আত্মসমর্পণকৃত জলদস্যুদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ঘর, দোকান, বাছুরসহ গাভী, জালসহ নৌকা, ইঞ্জিনচালিত নৌকা ইত্যাদি প্রদান করা হয়েছে। র্যাবের এই উদ্যোগ ভবিষ্যতেও চলমান থাকবে। এতে সুন্দরবন অঞ্চলে প্রত্যেকটি মানুষ সুন্দর জীবনের পথে অগ্রসর হতে অনুপ্রাণিত হবে।’