
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিল্পী হেলাল মিয়ার (৬৫) জীবনে সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তা এখন গান বন্ধ হয়ে যাওয়া। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে গান গেয়ে সংসার চালানো এই শিল্পী ও তার পরিবার গত ছয় দিন ধরে কোনো আয়ের পথ পাচ্ছে না, কারণ একদল যুবকের হুমকি।
জন্ম থেকেই হেলাল মিয়া দৃষ্টিশক্তিহীন। শুধু তিনি নন, তার ১৩ সদস্যের বড় পরিবারে নয়জনই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী- স্ত্রী, চার ছেলে, এক মেয়ে এবং তিন নাতি-নাতনি অধিকাংশই চোখের আলোহীন। তবুও কখনো ভিক্ষার পথ বেছে নেননি। সম্মানের সঙ্গে গান গেয়েই দীর্ঘদিন ধরে জীবন চালিয়েছেন।
প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর মুক্তমঞ্চের সামনে তারা পরিবেশন করতেন আধ্যাত্মিক গান- মারফতি, মুর্শিদী, কাওয়ালীসহ নানা ধারার সংগীত। দর্শনার্থীদের দেওয়া উপহারই ছিল তাদের বড় সংসারের একমাত্র উপার্জন। সাধারণ দিনে আয় হতো এক থেকে দেড় হাজার টাকা, আর বিশেষ আয়োজনে তা পাঁচ হাজার টাকাও ছাড়িয়ে যেত। চিকিৎসা, ওষুধ থেকে শুরু করে খাবার- সবই চলত এই আয়ের ওপর।
কিন্তু গত বুধবার (২৬ নভেম্বর) দুপুরে নিয়মিত গানের আসর চলাকালে কয়েকজন যুবক এসে হেলাল মিয়াকে গান বন্ধ করতে বলেন। তাদের নির্দেশ- গান ছেড়ে ভিক্ষাবৃত্তি করতে হবে, না হলে ভেঙে দেওয়া হবে বাদ্যযন্ত্র। সেই ভয়েই এরপর আর মঞ্চে যাননি তিনি।
হতাশ হেলাল মিয়া বলেন, “ছয় দিন হলো গান বন্ধ। আমাদের সংসার দিন এনে দিন খায়। এই কয়েক দিনে জমানো সামান্য টাকা আর কিছু ধার করে চলছি। কিন্তু এমন চলতে থাকলে না খেয়ে থাকতে হবে।”
তিনি জানান, এর আগে আরও দু’বার একইভাবে বাধা দেওয়া হয়েছিল, তবে এবারের ঘটনা পুরো পরিবারকে আরও আতঙ্কে ফেলেছে। সবারই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হওয়ায় বাইরে বের হওয়াই যেখানে কষ্টসাধ্য, সেখানে গান বন্ধ হওয়ায় তারা সম্পূর্ণ অসহায়। ভিক্ষা নয়, সম্মানের সঙ্গে গান গেয়েই জীবিকা চালাতে চান তারা।
ঘটনা প্রসঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি হাফিজুর রহমান মোল্লা কচি বলেন, এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি জানান, “অন্ধ এই পরিবারটিকে আমি ব্যক্তিগতভাবেও সহায়তা করেছি। তাদের হুমকি দেওয়ার খবর শুনে কষ্ট পেয়েছি। আমি তাদের আবারও মুক্তমঞ্চে গান গাইতে বলেছি।”
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) মো. ওবায়দুর রহমান জানান, এ বিষয়ে পুলিশের কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি। কেউ জানালে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
হেলাল মিয়ার বয়স এখন ৬৫ পার হলেও সংগীতই তার জীবনের একমাত্র নির্ভরতা। ছোটবেলায় স্থানীয় শিল্পী শাহনূর শাহের কাছে গান শেখা শুরু করেছিলেন তিনি, আর হাটবাজারে গান গেয়েই যাত্রা হয়েছিল তার জীবনের। পরে সন্তানরাও গান শিখে গড়ে তোলে নিজস্ব দল। এখন সেই সংগীতযাত্রাই থমকে গেছে হুমকির মুখে।