সম্পত্তির নিলাম ঠেকাতে আদালতে যাচ্ছে এস আলম গ্রুপ
- চট্টগ্রাম প্রতিনিধি
- প্রকাশঃ ০৭:১৩ পিএম, ০৮ জানুয়ারী ২০২৫

খেলাপি ঋণের পৌনে চার হাজার কোটি টাকা আদায়ে এস আলম গ্রুপের দুই কোম্পানির সম্পত্তি নিলামে তোলার যে উদ্যোগ জনতা ব্যাংক নিয়েছে, তা ঠেকাতে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে চট্টগ্রামভিত্তিক এই শিল্পগ্রুপ। এর মধ্যে এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের কাছে জনতা ব্যাংকের পাওনা এক হাজার ৭৭৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। আর এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলস লিমিটেডের কাছে দুই হাজার তিন কোটি ৩৭ লাখ টাকা পাওনা।
ব্যাংকটি বলেছে, ‘শর্তানুযায়ী কিস্তি পরিশোধ না করায় ঋণগুলো খেলাপিতে পরিণত হয়। অসংখ্য বার তলব-তাগাদা দিলেও ঋণ গ্রহীতা পাওনা পরিশোধ করেনি। সে কারণে অর্থঋণ আদালতের আইন অনুযায়ী নিলাম ডেকেছে ব্যাংক।’
এর মধ্যে এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলস পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। বুধবার (৮ জানুয়ারি) ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইটে কোম্পানিটি জানিয়েছে, জনতা ব্যাংকের এমন সিদ্ধান্তের বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নেবে গ্রুপের লিগ্যাল বিভাগ। শিগগিরই পদপেক্ষর বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে।
এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলসের কোম্পানি সচিব আল মামুন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘ডিএসই আমাদের কাছে জানতে চেয়েছিল। আমরা জানিয়েছি, লিগ্যাল বিভাগের আইনজীবীরা দ্রুত জনতা ব্যাংকের এমন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেবেন।’
‘এস আলম গ্রুপের জমি নিলামে তুলেছে জনতা ব্যাংক’ শিরোনামে গত ১ জানুয়ারি প্রতিবেদন প্রকাশ হয় কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমে। এরপর এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলসের কোম্পানির কাছে ব্যাখ্যা চায় ডিএসই। উত্তরে ওই কোম্পানি ডিএসইকে জানায়, কোম্পানি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ, ব্যাংকের বিধি নিষেধের কারণে এলসি খোলা যাচ্ছে না। তাতে কোম্পানি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
‘এ রকম পরিস্থিতিতে ঋণদাতা ব্যাংক বন্ধকী সম্পত্তি নিলামে তুলেছে। এটা হয়েছে সম্প্রতি তৈরি হওয়া দেশের রাজনৈতিক সংকটের কারণে, যা আমাদের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলেছে। আমরা জানাতে চাই, মজুদ থাকা কাঁচামাল দিয়ে উৎপাদন, পণ্য বিপণন ও অন্যান্য ব্যবসায় বাণিজ্য কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এ রকম নিলামের নোটিস কোম্পানির ব্যবসায়িক কার্যক্রমে কোন প্রভাব ফেলবে না।’
কোম্পানির পক্ষ থেকে বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে বলা হয়, ‘ঋণদাতা ব্যাংকের নিলাম নোটিসের বিরুদ্ধে কোম্পানির পক্ষ থেকে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।’
সম্পত্তি নিলামে তোলার বিষয়ে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল জব্বার সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘ব্যাংক টাকা পাবে, এস আলম গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো তো ব্যাংকের টাকা ফেরত দিচ্ছে না। নিয়মানুযায়ী তাদের খেলাপি দেখানো হয়েছে। ব্যাংক এখন খেলাপি ঋণ আদায়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। এছাড়া, তো কোন বিকল্প নেই। আইন মেনেই তাদের সম্পত্তি নিলামে তোলা হয়েছে।’
শিল্পী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের ব্যবসায় রয়েছে চিনি, তেলসহ ভোগ্যপণ্য, ইস্পাত, ব্যাগ, সিমেন্ট, বস্ত্র, জ্বালানী, আমদানি-রপ্তানি, পরিবহন, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিভিন্ন খাতে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের আমলে সুবিধাভোগী ব্যবসায়িক গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত এস আলম গ্রুপ সরকার পতনের পর ব্যবসায় পরিচালনায় অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নামে ও ভিন্ন নামে বিপুল অঙ্কের ঋণ নেওয়া শিল্পগ্রুপটির চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ বিদেশে চলে গেছেন। তার ও পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত শুরু করেছে। বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা শেয়ার হস্তান্তরের উপরও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো। ইতোমধ্যে বেসরকারি আটটি ব্যাংক এস আলমের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়েছে। ঋণের অর্থ আদায়ে বিভিন্ন ব্যাংক তৎপর হয়েছে। এর মধ্যে অনেক ঋণ আগ থেকে খেলাপি হয়ে পড়লেও ব্যাংকগুলো তা আগে দেখায়নি। উল্টো দিন দিন বেড়েছে গ্রুপটির ব্যাংক ঋণের অঙ্ক।
কর ফঁকির অভিযোগ এনে এস আলম গ্রুপের সব প্রতিষ্ঠানের বিন (বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বার বা ব্যবসায় পরিচিতি নম্বর) বন্ধ রেখেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তাতে গ্রুপটির মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন ঋণ না দেওয়ায় অর্থ সংকট দেখা দেওয়ায় এস আলমের কোম্পানিগুলোর কয়েকটি মাত্র চলছে কোনমতে। কাঁচামাল আমদানি করতে না পারা ও মজুদ ফুরিয়ে যাওয়ার কারণ দেখিয়ে গ্রুপের আটটি কোম্পানি গত ২৪ ডিসেম্বর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, যদিও সেগুলো পরে ফের খুলে দেওয়া হয়েছে।
গত ৩০ ডিসেম্বর এসব কোম্পানির ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর মধ্যে সম্পত্তি নিলামে তোলা এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রি ও এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলসও রয়েছে। গত নভেম্বর পর্যন্ত দুইটি কোম্পানির কাছে জনতা ব্যাংকের মোট বকেয়া দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৭৮০ কোটি ৭৫ লাখ টাকার বেশি। জনতা ব্যাংকের চট্টগ্রাম সাধারণ বীমা ভবন শাখা এ দুইটি কোম্পানির ঋণের বিপরীতে বন্ধক রাখা সম্পত্তি বিক্রি করতে ২৩ জানুয়ারি নিলামের তারিখ রেখে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে।
এস আলম রিফাইন্ড সুগার মিলের নামে নেওয়া ঋণের বিপরীতে ঢাকার গাজীপুর ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় দুই হাজার ৬৮৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ জমি বন্ধক রাখা হয়েছে। এর মধ্যে গাজীপুর সদরে রয়েছে ২০১ শতাংশ জমি। এস আলম গ্রুপের এ কোম্পানির দুইটি ইউনিটের দৈনিক দুই হাজার ৪০০ টন চিনি পরিশোধনের সক্ষমতা রয়েছে।
অন্যদিকে, এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলের ঋণের বিপরীতে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা ও গাজীপুরের শ্রীপুর মিলিয়ে দুই হাজার ৯৭১ দশমিক ২৭ শতাংশ জমি বন্ধক রয়েছে ব্যাংকের কাছে। যার মধ্যে গাজীপুরে ২৭৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ রয়েছে। নিলামে সেসব জমি ও তার উপর নির্মিত অবকাঠামো বিক্রি করে অর্থ আদায়ের পরিকল্পনা করেছে জনতা ব্যাংক।
ডিএসইর তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলসের ঋণের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৪১২ কোটি ১২ লাখ টাকা। পরিশোধ না করায় সুদসহ তা দুই হাজার তিন কোটি ৩৭ লাখ টাকায় উন্নীত হয়। এ কোম্পানি ২০২৩ সালে কর পরবর্তী নিট মুনাফা করেছিল চার কোটি ৭৮ লাখ টাকা। সবশেষ ২০২৩ সালে বিনিয়োগকারীদের জন্য ৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগের দিন, ২০২৪ সালের ৪ অগাস্ট ২১ টাকা ৭০ পয়সায় হাত বদল হওয়া এ কোম্পানির শেয়ার এখন অভিহিত মূল্য ১০ টাকায় দাঁড়িয়েছে।