মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ৪৫০ কোটি টাকায় ভবন কেনা নিয়ে লুকোচুরি

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক পিএলসি ২১ তলা একটি ভবনের ১৫ তলা কিনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত ২ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকটির বোর্ড সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে বিনিয়োগকারীদের জানানো হয়েছে। গুলশানে ৪৫০ কোটি টাকায় কিনতে চাওয়া সেই ফ্লোরগুলোর মধ্যে গ্রাউন্ড ফ্লোর ও ফার্স্ট ফ্লোর আগেই ভাড়া নিতে চুক্তি করেছে ঢাকা ব্যাংক। এছাড়া ঢাকা ব্যাংক আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও অনুমোদন নিয়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে এমটিবি’র বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিভ্রান্তির তৈরি হয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা যায়। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ৩ ফেব্রুয়ারি ভবন কেনার সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারৗদের জানিয়েছে। এ ঘোষণার পর ব্যাংকটির শেয়ার দর বেড়েছে ৬০ পয়সা। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে জানা গেছে, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক গুলশান-১ নম্বরের ১৩৮ নম্বর সড়কের ২১ তলা ঐ ভবনের প্রথম ১৫ তলা কিনে নেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানায় গত ৩ ফেব্রুয়ারি। ব্যাংকটি আরও জানায়, গত ২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় প্রধান কার্যালয়ের জন্য ভবন কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গুলশান-১ নম্বরের ১৩৮ নম্বর সড়কে এই বাণিজ্যিক ভবনটি অবস্থিত। ভবনটির নিচতলা থেকে ১৪ তলা পর্যন্ত মোট ১৫ তলা কিনতে নিবন্ধন ফি ও ভ্যাট ছাড়া আনুমানিক খরচ ধরা হয়েছে ৪৫০ কোটি টাকা। প্রতিটি ফ্লোর কিনতে খরচ হবে ৩০ কোটি টাকা। তবে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর অনুমোদন সাপেক্ষে। অপরদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, ২০২৪ সালের ৩ নভেম্বর গুলশান-১ নম্বরের ১৩৮ নম্বর সড়কের ভবনটির গ্রাউন্ড ফ্লোরে ঢাকা ব্যাংকের গুলশান শাখা স্থানন্তরের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন পায় । এছাড়া একই ভবনের দ্বিতীয় ফ্লোরে ঢাকা ব্যাংকের প্রধান কার‌্যালয়ের অল্প কয়েকটি বিভাগের কার‌্যক্রম স্থানান্তরের জন্য অনুমোদন পায়। আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, ভবনটির মালিক কামার সুলতানা একটি সময় পরে ঢাকা ব্যাংকের সঙ্গে গড়িমসি করে। এক পর‌্যায়ে ঢাকা ব্যাংক আদালতের দ্বারস্থ হয়। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, ঢাকা ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি হওয়া ফ্লোর দুটির বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত তা ভাড়া বা বিক্রি করা যাবে না। ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, গত ২ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকটির শেয়ারের দর ছিলো ১২ টাকা ৫০ পয়সা। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ব্যাংকটির প্রতিটি শেয়ারের দর ৬০ পয়সা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ টাক ১০ পয়সা। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, দুই দফায় ঢাকা ব্যাংককে শাখা ও প্রধান কার্যালয়ের কয়েকটি বিভাগ স্থানান্তরের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আর মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক তাদের প্রধান কার্যালয় স্থাপনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আবেদন জানায়নি।

অদৃশ্য হাতের ইশারায় ধরাছোঁয়ার বাইরে ‘ব্যাংক খেকো’ সাবেক তিন গভর্নর

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশের ব্যাংক খাত ধ্বংস করে গেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক তিন গভর্নর আতিউর রহমান, ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদার। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর ব্যাংক খাত সংস্কার করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারকে। ৫ আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত ব্যাংক খেকোরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। খাতটি ধ্বংসের মূল হোতা সাবেক তিন গভর্নরকে এখনো ধরেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অর্থাৎ, তারা অদৃশ্য শক্তিবলে এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। সাবেক এই তিন গভর্নরের মধ্যে রিজার্ভ চুরির মূল হোতা আতিউর রহমান দেশের বাহিরে রয়েছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রউফের তালুকদারী বহাল থাকার অভিযোগ তথ্য গোপন করে আওয়ামী লীগ সরকারকে ৪১ হাজার কোটি টাকানতুন টাকা ছাপিয়ে ঋণ দিয়েছিল ৫ আগস্টের পর পালিয়ে বেড়াচ্ছেন ফজলে কবির রিজার্ভ চুরির মূল হোতা আতিউর রহমান দেশের বাইরে আগের সরকারের সময়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি বলেছে, ‘দেশের ব্যাংক খাতে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ এখন ৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। খাতটি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় সংস্থার সহায়তায় ব্যাংক দখল হয়েছে। একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতেই সাতটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হয়। এই সুযোগে বড় অঙ্কের অর্থ দেশের বাইরে পাচার করা হয়।’ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০০৯ সালে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা। সদ্য সমাপ্ত ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ, আলোচ্য সময়ের মধ্যে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৩ গুণ। এছাড়া, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) তিন মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। ফলে, ব্যাংক থেকে বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশই বর্তমানে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখেগত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার আহসান এইচ মনসুরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদে নিয়োগ দেয়। সম্প্রতি আহসান এইচ মনসুর এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়ে আগামী দিনে মোট ঋণের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশে পৌঁছে যাবে। এসব ঋণের বড় অংশই ২০১৭ সালের পর দেওয়া হয়েছে, যার বড় অংশই পাচার হয়ে গেছে।’ প্রাপ্ত তথ্যমতে, আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি ক্ষমতা নেওয়ার দিনে গভর্নর ছিলেন বর্তমান অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। ওই বছরের ৩০ এপ্রিল তাঁর মেয়াদ শেষ হলে নতুন গভর্নর হন আতিউর রহমান। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার পরে তিনি পদত্যাগ করেন। তাঁর সময় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে নতুন ব্যাংক অনুমোদন ও ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা দিয়ে বিতর্কিত হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপরে ২০১৬ সালে সাবেক অর্থসচিব ফজলে কবির গভর্নর হলে একের পর এক ব্যাংক দখল হতে থাকে। এসব ব্যাংকে নির্বিচার লুটপাট শুরু করে দখলকারীরা। নতুন ব্যাংক অনুমোদন ও ঋণ নীতিমালায় ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণ গোপন করার কৌশলও দেখা যায় তাঁর সময়ে। ২০২২ সালে গভর্নর পদে বসানো হয় আরেক সাবেক অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদারকে। তাঁর আমলেও আগের ধারা অব্যাহত থাকে। অভিযোগ রয়েছে, আমলাদের শক্তিবলেই এখনো ধরা পড়েননি ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদার। কারণ তারাও সাবেক অর্থসচিব অর্থাৎ আমলাই ছিলেন। তাদের দুইজনের সহযোগীরা অনেকে এখনো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল রয়েছে। আর তাদের শক্তি কাজে লাগিয়ে সাবেক এই দুই গভর্নর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জালের বাহিরে রয়েছেন। আব্দুর রউফ তালুকদার সময়ে ব্যাংকিং খাতের লুটপাটের আগের ধারা অব্যাহত থাকে। একদিকে, লুটেরারা ব্যাংক খালি করে বিদেশে পাচার করছিলেন। অন্যদিকে, টাকা ছাপিয়ে ব্যাংকগুলো ভরে দিচ্ছিলেন রউফ তালুকদার। অর্থাৎ, ব্যাংক লুটের আরও সুযোগ করে দিয়েছিলেন সাবেক এই গভর্নর। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর তারও রক্ষা হয়নি। কারণ শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর আব্দুর রউফ তালুকদারো লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান। এই ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি পদত্যাগ করেন। সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের শেষ দিকে অর্থাৎ আতিউর রহমান গভর্নর থাকা অবস্থায় ব্যাংক খাতে তদারকি কমিয়ে দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এমন পরিস্থিতির মধ্যে হলমার্কের জালিয়াতি ফাঁস হয়। এরপরেই বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের পর্ষদে পরিবর্তন আনা হয়। একই গভর্নরের আমলে বেসিক ব্যাংক বড় জালিয়াতি হয়। এছাড়া, ২০১২ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় আওয়ামী লীগ নেতাদের বেশ কয়েকটি ব্যাংক অনুমোদন দেওয়া হয়। এভাবেই ব্যাংক লুটপাটের সূচনা করে গেছে সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান। এরপর ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চুরি হলে আতিউর রহমান পদত্যাগ করেন। ২০১৬ সালের মার্চ মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান ফজলে কবির। এরপর ২০১৭ সালের শুরুতে ইসলামী ব্যাংক ও পরে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল) দখল করতে সহায়তা করেন তিনি। তারপর এসব ব্যাংকে লুটপাটের সুযোগ তৈরি করে দিতে তদারকি ঢিলেঢালা আনেন ফজলে কবির। তার সময়ে ঋণ নীতিমালায় ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণ গোপন করার কৌশল পদ্ধতি আবিষ্কার করা হয়। এছাড়া সুদের হার ৯ শতাংশে আটকে রেখে ব্যবসায়ীদের ব্যাপক সুবিধা দিয়ে নিয়ন্ত্রণহীন করে ফেলা হয় দেশের ব্যাংক খাত। ফজলে কবিরের পর গভর্নরের দায়িত্ব নিয়ে আব্দুর রউফ তালুকদার ব্যাংক খাত লুটপাটে সহযোগীতা করার দায়িত্ব হাতে নেন। আগের দুই গভর্নরের মতোই তার সময়েও ব্যাংক ঋণে জালিয়াতি ও অনিয়ম অব্যাহত থাকে। লুটপাট হওয়া ব্যাংকগুলোতে তিনি ছাপিয়ে তারল্য সুবিধা দিয়েছেন। এছাড়া বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদেরকে রিজার্ভ থেকে ব্যাপক হারে ডলার দেওয়া হয়। এর ফলে দুই বছরের মধ্যে রিজার্ভ তলানিতে নেমেছিল। তাঁর সময়ে আর্থিক তথ্য প্রকাশ সীমিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশও বন্ধ করে দেওয়া হয়। সরকারের পতন ঘটলে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। এরপর কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি পদত্যাগ করেন। সাম্প্রতিক সময়ে গ্রেপ্তার হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার সুর চৌধুরী। এরপর আদালতের অনুমতি নিয়ে দুর্নীতিন দমন কমিশন (দুদক) ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে এসকে শুরের জমা করা তিনটি সিলগালা কৌটা খুলে। এসব কৌটায় ৫৫ হাজার ইউরো, ১ লাখ ৬৯ হাজার ৩০০ মার্কিন ডলার, ১০০৫ দশমিক ৪ গ্রাম স্বর্ণ ও ৭০ লাখ টাকার এফডিআর পাওয়া যায়। জানা যায়, এসব সম্পদ তার নিয়মিত আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করা হয়নি। তল্লাশিকালে রেজিস্ট্রার পরীক্ষা করে দেখা যায়, সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্য কিছু কর্মকর্তাও সিলগালা করে সেফ ডিপোজিট রেখেছেন। এসব সিলগালা কৌটাতেও অপ্রদর্শিত সম্পদ থাকার অবকাশ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগে দুদকের অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে সম্প্রতি দুদকের অনুরোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৩০০ লকার জব্দ করেছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। এসব লকার খুলে দেখার জন্য ইতিমধ্যে আদলতের অনুমতি পেয়েছে দুদক। তবে যে কোনো সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে থাকা এসব লকার খোলা হতে পারে।

চা শ্রমিকদের জীবন ব্যথা দিয়ে গড়া!

পূর্ব পুরুষের দেখানো পথে যুগ যুগ থেকে চা বাগানে শ্রমিক হিসেবে কাটিয়ে দিচ্ছেন জীবন। যেখানে নুন আনতে পান্তা টুকু শেষ হয়ে আসে সেখানে দিনের পর দিন দৈনিক ১৭০ টাকা মজুরিতে কাজ করে যাচ্ছেন সিলেটের হাজার হাজার চা শ্রমিক। তার ব্যাতিক্রম নয় সিলেট শহরের হালুচড়া ও মালনিচড়া চা বাগানের চা শ্রমিকরা। জীবনের মানে যদি হয় যুদ্ধ তবে সেই যুদ্ধের অঘোষিত মুক্তিযোদ্ধা এ সব চা শ্রমিকরা। প্রতিদিন সকালে প্রায় আধা ঘন্টা থেকে এক ঘন্টার দীর্ঘ পথ হেটে আসেন কাজে। দৈনিক এই আয়ের উপর নির্ভর করে তাদের সংসার আর সন্তানদের পড়ালেখার খরচ। তবে, বেশিরভাগই চা শ্রমিকরা তাদের সন্তানদের লেখা পড়ার খরচ যোগাতে হিমশিম খান যার। ফলে, প্রাথমিকের গন্ডি কোন মতে পেরুলেও মাধ্যমিকের শিক্ষাগ্রহণের স্বাদ নেয়া হয়না। এদের মতোই একজন রিনা দাস, দীর্ঘ দিন থেকে হিলুয়াছুড়া চা বাগানে কর্মরত স্বামী অসুস্থ থাকার ফলে স্বামীর সেবা সন্তানদের দেখভাল করে প্রতিদিন ১৭০ টাকা রোজে আধ ঘন্টার দীর্ঘ পথ পায়ে হেটে আসেন কাজে। নুন আনতে পান্তা ফুরোনো রিনা দাস বলেন, ‘আমরা পূর্ব পুরুষদের দেখানো পথ ধরেই বাগানে চা শ্রমিক হিসেবে কাজ করছি। স্বামী অসুস্থ থাকার ফলে সংসারের দায়িত্ব আমার উপর পড়েছে। মাঝেমধ্যে নিজেকে খুব হতাশ মনে হয় ,তার পরেও যেন জীবনে চলতে হয়।’ মাধ্যমিকে ভর্তি হতে না পারা ছোট বোন বাসানি বাউরি ষষ্ঠ শ্রেণীতে টাকার অভাবে ভর্তি হতে পারছে না। সেখানে অসুস্থ বাবা আর ছোট ভাইদের নিয়ে বিপাকে পড়েছেন চা শ্রমিক শিখা বাউরি। তিনি বলেন, ‘সংসারের অভাবের মধ্যে নিজে লেখাপড়া করতে পারিনি। এখন ছোট বোনকেও লেখাপড়া করতে পারব বলে মনে হয় না। প্রতিদিন সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। নিজের কত খারাপ লাগে বুঝাতে পারবো না।’ গত ৫ নভেম্বর টানা ১৫ দিনের কর্মবিরতিরসহ সিলেটে বিক্ষোভ সমাবেশ করে লাক্কাতুরাসহ বেশ কয়েকটি চা বাগানের শ্রমিকরা। যেখানে ন্যাশনাল টি কোম্পানির লাক্কাতুরা, কেওয়াচড়া, দলদলি চা বাগানের শ্রমিকদের উপস্থিতিতে ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষসহ সব বয়সী মানুষ নানা ধরনের প্রতিবাদী স্লোগানে (‘বেতন নিয়ে টালবাহানা, চলবে না, চলবে না’, ‘বেতন-ভাতা না পেলে, রাজপথ ছাড়বো না’, ‘মালিকের দালালেরা, হুঁশিয়ার সাবধান’) চারপাশ মুখরিত করে তুলেন। তবে, বাগান মালিক সূত্রে জানা যায়, প্রতি সপ্তাহে সাড়ে তিন কেজি চালসহ বিভিন্ন সময় সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়ে থাকে এসব বাগান শ্রমিকদের। সিলেটে চায়ের জন্য বিখ্যাত জেলার ১৯ টি চা বাগান থেকে প্রতি বছরই আয় হয় কাড়িকাড়ি টাকা। তবে, দিনের পর দিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটা এসব চা শ্রমিক এভাবেই কাটিয়ে দিচ্ছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। সুযোগ-সুবিধা আর দৈনিক মজুরি বাড়ানোর দাবিতে নানা সময় আন্দোলন করলেও আশানুরুপ ফলাফল পাননি তারা। আক্ষেপ আর হতাশা বুকে চেপে বেশিরভাগ মহিলার ধরেছেন সংসারের হাল; যেখানে অনেকের স্বামী পঙ্গু হয়ে ঘরে পড়ে আছে। আবার কারো বাবা নেই। এ যেন লুকানো এক চাপা কষ্ট নিয়ে বসবাস করছেন তারা। এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেট জেলা শাখার সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘চা বাগানের শ্রমিকদের ১৭০ টাকা মজুরিতে কাজ করার বিষয়টি মানবিক দিক থেকেই অন্য রকম খারাপ লাগা কাজ করে। আমার মনে হয়, নূন্যতম মজুরি ৩০০ টাকা হওয়া উচিত। এ ছাড়া সব শ্রেণীর শ্রমিকদের প্রতি নজর দেয়া উচিত।’

ঢাবি'র সনদ জাল করে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট’র সিইও পদে নিয়োগ পেয়েছেন আবু নাঈম

আবু নাঈম মোঃ ইব্রাহীম স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট এর সিইও হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি ব্যাংকে নিয়োগ এর সময় তার শিক্ষাগত সনদ জাল করে নিয়োগ পেয়েছেন। তার নিয়োগ আবেদনের সনদ অনুযায়ী ঢাবি'র অধীনে ঢাকা সিটি কলেজ থেকে ১৯৯০ সালের ব্যাচেলর অফ কমার্সে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছেন বলে সনদ দাখিল করেন। সেই সনদ অনুযায়ী ২৩ জুন ২০০৭ সালে এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে নিয়োগ লাভ করেন। পরবর্তী ২০১৫ সালে প্রমোশন পেয়ে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট হিসেবে নিয়োগ পান। তার এসব নিয়োগ ক্ষেত্রে সনদ জালিয়াতির আশ্রয় নেন। জানা যায় তিনি ১৯৯০ সালে ঢাকা সিটি কলেজ ব্যাচেলর অফ কমার্স থেকে তৃতীয় শ্রেনীতে উত্তীর্ণ হোন। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক নীতিমালা অনুযায়ী তৃতীয় শ্রেনীতে উত্তীর্ণ কেউ নিয়োগ প্রাপ্তিতে অযোগ্য বলে গণ্য হোন। তিনি তার নিয়োগ প্রাপ্তির জন্য সনদ জালিয়াতির আশ্রয় নেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসে তার সনদ যাচাই করে জানাযায় জমাকৃত সনদটি সঠিক নয় ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিস থেকে ইস্যু করা হয়নি। তিনি ১৯৯০ সালে ব্যাচেলর অফ কমার্স থেকে তৃতীয় শ্রেনীতে উত্তীর্ণ হয়েছেন। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক সূত্রে জানা যায় আবু নাঈম দীর্ঘদিন বিভিন্ন কোম্পানির দুর্বল শেয়ার চড়ামূল্যে কিনে ব্যাংকের আর্থিক ক্ষতি করে আসছে। সনদ জালের বিষয়ে আবু নাইম মোঃ ইব্রাহিমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন তার সনদ সঠিক। তিনি সনদ জাল করেননি। স্টান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ হাবিবুর রহমান বলেন তার বিরুদ্ধে অনিয়মের প্রেক্ষিতে আমরা তাকে সাময়িক প্রত্যাহার করেছি। তদন্তের শেষে আমরা বিস্তারিত জানাবো।

বছরের শুরুতে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তে খরচ বাড়বে সংসারে

অতিরিক্ত পণ্যমূল্যের বাজারে এমনিতেই সংসারে টানাটানি। তার ওপর বছরের শুরুতে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তে খরব বাড়বে সংসারে। তবে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়বে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত্ব আয়ের মানুষ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘আইএমএফ ঋণের শর্তের কারণেই ভাট বাড়ানো হচ্ছে। এতে সবক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’ যেসব পণ্য বা সেবায় ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে, এরমধ্যে ওষুধে দুই দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বাড়ছে ৫ শতাংশ, এলপিজি গ্যাসে পাঁচ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ, তৈরি পোশাকে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ, অভ্যন্তরীণ বিমান টিকিটে ৩০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭০০ টাকা এবং আন্তর্জাতিক বিমান টিকিটে ৩ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪ হাজার টাকা করা হচ্ছে। এ ছাড়া বছরে ৩০ লাখ টাকার বেশি টার্নওভার থাকলে ভ্যাটের খাতায় (টার্নওভার করের তালিকাভুক্তি) নাম লেখাতে হবে। বর্তমানে টার্নওভার করের তালিকাভুক্তির সীমা ৫০ লাখ টাকা। অর্থাৎ, ২০ লাখ টাকা কমানো হয়েছে। এতে ছোট ব্যবসায়ীরাও ভ্যাটের আওতায় চলে আসবে। একইসঙ্গে ভ্যাট নিবন্ধনের সীমা ৩ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৫০ লাখ টাকা করা হয়েছে। এতে পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়ে যাওয়ায় জনজীবনে ও ব্যবসায়ীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ঋণ দিতে আইএমএফ বাংলাদেশকে কর-জিডিপির অনুপাত দশমিক দুই শতাংশ বাড়ানোর শর্ত দিয়েছে, টাকার অঙ্কে যা ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি। বলা হচ্ছে, ‘এই টাকা জনগণের কাছ থেকে আদায় করতেই বাড়ানো হচ্ছে ভ্যাট ও কোনো ক্ষেত্রে আবগারি শুল্ক।’ অর্থনীতিবিদ তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘আইএমএফের শর্তানুযায়ী আমাদের যে পরিমাণ কর হার বাড়ানো দরকার, সেটা বাংলাদেশ পারছে না। এ ছাড়া সাধারণ মানুষ কর দেন, কিন্তু সেটি সরকারের কোষাগারে যায় না।’ অন্যদিকে, অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলছেন, ‘ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তে নিত্যপণ্যের দামের ওপর কোন প্রভাব পড়বে না। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণে নয়, বরং রাজস্ব বাড়ানোর স্বার্থেই বিভিন্ন পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে।’ প্রসঙ্গত, উপদেষ্টা পরিষদ নতুন ভ্যাট হারের বিষয়টি এরইমধ্যে অনুমোদন দিয়েছে। আগামী দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। যা আগামী সপ্তাহ থেকে কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি এখন বাংলাদেশে

সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফলতার মুখ দেখলেও বাংলাদেশ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। অর্থাৎ, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে বাংলাদেশ। এর মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) বাড়ানোর পরিকল্পনা কতটা যৌক্তিক বা যুগোপযোগী হবে তা নিয়ে নীতিনির্ধারকদের ভাবা উচিত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাই, বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে কর বাড়ানোর উদ্যোগ মূল্যস্ফীতিকে আরও উস্কে দিতে পারে। এতে ভ্যাট বৃদ্ধির এ উদ্যোগ থেকে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আয় নাও হতে পারে। ইতিমধ্যেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাংক ঋণের সুদের হার ও নীতি সুদহার প্রায় দ্বিগুণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের এ শর্ত দিয়েছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। কিন্তু মূল্যস্ফীতি না কমে উল্টো ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে এখনো। বেড়েছে মানুষের ভোগান্তি। এ দিকে, আইএমএফের শর্তে ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণে নয়, বরং রাজস্ব বাড়ানোর স্বার্থেই বিভিন্ন পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। তবে ৪৩টি পণ্যের উপরে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তে নিত্যপণ্যের দামের ওপরে প্রভাব পড়বে না।’ বিবিএসের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, গত নভেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। যদিও জুলাইয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ, নভেম্বরে তা কিছুটা কমেছে। তবে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে পৌঁছেছে। এর মানে গত ২০২৩ সালের নভেম্বরে ১০০ টাকায় যা কেনা যেত, ২০২৪ সালের নভেম্বরে সেই একই পণ্য বা সেবা কিনতে ভোক্তাকে ১১১ টাকা ৩৮ পয়সা খরচ করতে হয়েছে। সূত্র জানায়, ডলারসহ অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির দেশগুলোর একটি ছিল শ্রীলঙ্কা। দুই বছর আগে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্রটির মূল্যস্ফীতির হার ঠেকে ৭০ শতাংশে। বৈদেশিক দায় পরিশোধে ব্যর্থতায় নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করা দেশটির মূল্যস্ফীতি এখন ১ শতাংশেরও নিচে। দেশটির গণমাধ্যম বলছে, ‘গত আগস্টে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ০.৫ শতাংশ।’ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতির হার দীর্ঘ দিন ধরেই ছিল দুই অঙ্কের ঘরে। অর্থনৈতিক সংকটে হাবুডুবু খাওয়া দেশটির মূল্যস্ফীতির হারও এরইমধ্যে এক অঙ্কের ঘরে নেমে এসেছে। গত মাসে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ। যদিও এক বছর আগে ২০২৩ সালের আগস্টে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ২৭ শতাংশেরও বেশি। বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে রয়েছে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, নেপাল ও ভুটান। এ সাত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এ অঞ্চলে সবচেয়ে কম মূল্যস্ফীতি এখন শ্রীলঙ্কায়। আগস্টে শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতির হার ছিল মাত্র ০.৫ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বনিম্ন ১ দশমিক ৪ শতাংশ মূল্যস্ফীতি রয়েছে মালদ্বীপে। ভুটানে ২.০৪, নেপালে ৩ দশমিক ৫৭ ও পাকিস্তানে ৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। ইকোনমিক টাইমসের খবর অনুযায়ী, ভারতের সাড়ে ৫ শতাংশের বিরাজ করছে। এরমধ্যে মালদ্বীপ, নেপাল ও ভুটানে মূল্যস্ফীতির তথ্য জুলাই পর্যন্ত হালনাগাদকৃত। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গভর্নর হিসেবে অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর নিয়োগ পান। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তিনি নীতি সুদহার (রেপো রেট) ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯ শতাংশে উন্নীত করেন। এরপরও মূল্যস্ফীতি না কমলে নীতি সুদহার ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর আভাস দিয়েছেন গভর্নর। বর্তমানে দেশের ব্যাংকগুলোয় ঋণের সুদহার ১৬-১৭ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজার কিছুটা স্থিতিশীল হয়ে এসেছে। ব্যাংক খাতের সঙ্গে খুচরা বাজারের বিনিময় হারের ব্যবধান ১ শতাংশে নেমেছে। বর্তমানে দেশের ব্যাংকগুলোয় প্রতি ডলার লেনদেন হচ্ছে সর্বোচ্চ ১২০ টাকায়।

শেখ হাসিনা সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছেন: ড. ইউনূস

বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনী সংশোধনীসহ সাংবিধানিক ও বিচার বিভাগীয় সংস্কারের পর সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। নির্বাচনের আগে দেশের অর্থনীতি, শাসনব্যবস্থা, আমলাতন্ত্র ও বিচার ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন ৮৪ বছর বয়সি নোবেলজয়ী ক্ষুদ্রঋণের এই অগ্রদূত। গেল শনিবার (৩০ নভেম্বর) নিক্কেই এশিয়াকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। সোমবার (২ ডিসেম্বর) সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়।বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনী ব্যবস্থা, সংবিধান ও বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য বেশ কয়েকটি কমিশন গঠন করেছে। জানুয়ারির মধ্যে ওই কমিশনগুলোর সুপারিশ হাতে পাওয়ার পর পূর্ণাঙ্গ সংস্কার বাস্তবায়ন করার কথা জানিয়েছে সরকার। তবে, এই সংস্কার বাস্তবায়নে সময় লাগবে বলে জানান তিনি। বলেন, ‘এই সংস্কার বাস্তবায়নে সময় লাগবে। কেননা ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়তে আমরা একদম গোড়া থেকে কাজ শুরু করেছি।’তবে, নির্বাচন ঠিক কখন হবে, সে বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচনের সময় নির্ভর করছে সংস্কার কাজের ওপর। কাজের ফলাফলই সময় নির্ধারণ করে দেবে।’সাধারণ নির্বাচনে ড. ইউনূস প্রার্থী হবেন কি না তা জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়টি নাকচ করে দেন। বলেন, ‘আমি রাজনীতিবিদ নই। আমি সব সময়ই রাজনীতি থেকে দূরে থেকেছি।’ রাষ্ট্রের যেসব ব্যক্তি নীতিকে সমুন্নত রাখেন, নিয়ম-কানুন অনুসরণ করেন ও নিজেকে দুর্নীতিমুক্ত রাখেন, তাদের নির্বাচনে দাঁড়ানো উচিত বলে মনে করেন ড. ইউনূস।তিনি বলেন, ‘হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে দেশের শাসনকাঠামো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গছে। আমরা এখন তা পুনর্গঠনের গুরুত্বপূর্ণ কাজের মুখোমুখি হয়েছি। গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করা আমাদের কাজ।’ প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘হাসিনার শাসনামলে গণতন্ত্রের মূলনীতি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। টানা তিন মেয়াদে ভোটারবিহীন নির্বাচন করেছিলেন হাসিনা। এর মাধ্যমে তিনি নিজেকে ও তার দলকে বিজয়ী ঘোষণা করেছিলেন। একজন ফ্যাসিবাদী শাসক হিসেবে এসব করেছিলেন হাসিনা। এ বছরের আগস্টে ছাত্রনেতৃত্বাধীন সরকারি চাকরিতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে কয়েক শত শিক্ষার্থী নিহত হন। এরপরই শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন হাসিনার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। শেষ পর্যন্ত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। তিনি হেলিকপ্টারে চড়ে ভারতে পালিয়ে যান। অক্টোবরে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনা এবং তার বেশ কয়েকজন সহযোগীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে।’এই বিচারিক কার্যক্রম শেষে রায় হলে হাসিনার প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে ভারতকে জানানো হবে বলে জানিয়েছেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, ‘বিচার শেষে তার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত রায় এলে আমরা ভারতের কাছে হাসিনার আনুষ্ঠানিক হস্তান্তরের অনুরোধ করব।’ এক্ষেত্রে, উভয় দেশের স্বাক্ষরিত একটি আন্তর্জাতিক আইনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ আইন মানতে ভারত বাধ্য থাকবে।’কূটনৈতিক ফ্রন্টে বাংলাদেশের উচিত ভারতের সঙ্গে শক্তিশালী ও সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা। এক্ষেত্রে ড. ইউনূস দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) পুনরুজ্জীবিত করার প্রস্তাব করেছেন। ভারত ও পাকিস্তানের বৈরি সম্পর্কের ফলে সার্ক কার্যত নিষ্ক্রিয় রয়েছে। সার্কের লক্ষ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোর মত নিজেদের মধ্যে চলাফেরার স্বাধীনতা, আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যকে উৎসাহিত করা। সার্কের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে ভারতেকে পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনা নিরসনের আহ্বান জানিয়েছেন ড. ইউনূস।ওই দিকে, হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে ভারত সরকার। তাদের দাবি বাংলাদেশে হিন্দুদের ঘরবাড়ি, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও মন্দিরে ‘হামলা’ করা হয়েছে। এ বিষয়ে ঢাকাকে অবশ্যই হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে বলে জোর দিয়েছে দিল্লি। তবে ভারত সরকারের এসব ঢালাও বক্তব্য নাকচ করে দিয়েছেন ড. ইউনূস।তিনি বলেন, ‘সংখ্যালঘু ইস্যুতে যা বলা হচ্ছে তার বেশির ভাগই প্রোপাগান্ডা। এগুলো সঠিক তথ্যের উপর ভিত্তি করে বলা হচ্ছে না বলে পাল্টা অভিযোগ করেছেন ড. ইউনূস।’ তিনি ভারতীয় সাংবাদিকদের বাংলাদেশে এসে তদন্ত সাপেক্ষে সঠিক তথ্য তুলে ধরার আহ্বান জানিয়েছেন। মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমরা এসব ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে ভারত সরকারকে ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য কাজ করছি।’রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এই দায় (রোহিঙ্গা) বাংলাদেশ কত দিন বহন করবে? রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য আমাদের একটি সুস্পষ্ট গন্তব্য ঠিক করা দরকার। মিয়ানমারে জাতিসংঘ-শাসিত নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পক্ষে বাংলাদেশ।’তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার অনুমতি দিলে বিপুল পরিমাণ এই রোহিঙ্গা তাদের দেশেই থাকতে পারবে।’ সেখানকার পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে তারা অন্য দেশে স্থানাস্তরিত না হয়েই তাদের নিজ ভূমিতে ফিরে যেতে পারবে বলে উল্লেখ করেন মুহাম্মদ ইউনূস।দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় জাতি সংস্থা-আসিয়ানে বাংলাদেশের যোগ দেয়ার বিষয়ে জোর দিয়েছেন ড. ইউনূস। কেননা বাংলাদেশ আসিয়ানে যোগ দেয়াকে একটি প্রতিশ্রুতিশীল সুযোগ হিসেবে নিতে চায়। বিশেষ করে ২০২৬ সালের মধ্যে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ। আগামী জানুয়ারি থেকে আসিয়ানের সভাপতিত্ব করবে মালয়েশিয়া। ড. ইউনূস বলেন, ‘তিনি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে বাংলাদেশের সদস্যপদ নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বাংলাদেশকে আসিয়ানে যুক্ত করার কথা জানিয়েছেন।’ এক্ষেত্রে বেশ কিছু ধাপ রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা।তিনি বলেন, ‘আসিয়ানে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপটি হবে একটি সর্বসম্মত রেজুলেশন নিশ্চিত করা। আমরা আসিয়ানের মধ্যে একটি সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার হিসেবে স্বীকৃতি অর্জনের আশা করছি।’ আসিয়ানের সদস্য দেশগুলো বাংলাদেশের এই প্রচেষ্টাকে সমর্থন করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন ড. ইউনূস।

বাংলাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করলে ভারত ভাল থাকতে পারবে না

ভারত বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করলে বাংলাদেশের কোন ক্ষতি হবে না, বরং ভারতেরই ক্ষতি হবে বলে মন্তব্য করেছেন নৌ পরিবহন এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) দুপুরে নারায়ণগঞ্জ সিটির কেন্দ্রীয় লঞ্চ টার্মিনাল সংলগ্ন বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে বিআইডব্লিউটিএর নির্মাণাধীন মাল্টিপারপাস প্রকল্প পরিদর্শনে এসে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি এ মন্তব্য করেন। এ সময় সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘ভারত সরকার গায়ে পড়ে বাংলাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করলে তারা ভাল থাকতে পারবে না। মূলত ভারতের কিছু রাজনীতিবিদ নির্বাচনে ভোট পাওয়ার উদ্দেশ্যে এবং সেখানকার কিছু গণমাধ্যম বাংলাদেশে এই অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘ভারত সরকার বাংলাদেশে কোন অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করবে না বলে প্রত্যাশা করি। ভারত একটি বৃহৎ দেশ। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে তাদের ভাল সম্পর্কই রাখা উচিত। ভারত যদি সেটা না করে এটা ভাল লক্ষণ নয়। ভারত সরকার যদি গায়ে পড়ে ১৮ কোটি মানুষের বাংলাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করে তবে তারা ভাল থাকতে পারবে না।’ দেশের গার্মেন্টস খাতে সাম্প্রতিক শ্রমিক অসন্তোষ প্রসঙ্গে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে বিভিন্ন গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পেছনে শ্রমিকদের কোন দোষ নেই। এর পেছনে যারা ষড়যন্ত্র করছে, সরকার তাদের চিহ্নিত করেছে। তবে, অধিকাংশ গার্মেন্টস বিপুল পরিমাণ ব্যাংক ঋণ খেলাপির কারণে বন্ধ হয়েছে। এ ব্যাপারে সরকার আগামী সপ্তাহের মধ্যেই যথাযথ সিদ্ধান্ত নেবে।’

বাড়লো ক্রেডিট কার্ডের সুদহার

ক্রেডিট কার্ডের সুদহার আরও কিছুটা বাড়িয়ে নতুন করে নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে নতুন বছর থেকে কোনো ব্যাংক ক্রেডিট কার্ডে ২৫ শতাংশের বেশি সুদ নিতে পারবে না। এর আগে যেটা ২০ শতাংশ ছিল। আর ক্রেডিট কার্ডে সুদ আরোপ শুরু হবে ঋণ পরিশোধের নির্ধারিত সময়ের পর। রবিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ এ সংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। ক্রেডিট কার্ড নিয়ে নতুন এ নির্দেশনা নতুন বছরের প্রথম দিন থেকে কার্যকর হবে। নতুন নির্দেশনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, ক্রেডিট কার্ড সীমার বিপরীতে ঋণ সুবিধা প্রদানসহ সুদহার যৌক্তিক এবং গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণে ক্রেডিট কার্ডের ওপর সুদহার সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ নির্ধারণের নির্দেশনা আছে। তবে সুষ্ঠু ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতে এবং নীতি সুদহার ও ব্যাংকগুলোর ক্রমবর্ধমান তহবিল ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখার লক্ষ্যে ক্রেডিট কার্ডের ওপর সুদহার সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হলো। ব্যাংকগুলোর ঋণের চাহিদা ও ঋণযোগ্য তহবিলের জোগান সাপেক্ষে এ সীমার মধ্যে ক্রেডিট কার্ডের সুদহার নির্ধারণ করা হবে বলেও জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নির্দেশনায় আরও বলা হয়, ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো তাদের প্রদত্ত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উল্লিখিত নির্দেশনা অনুসরণ করত মুনাফার হার নির্ধারণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। অন্যান্য নির্দেশনা অপরিবর্তিত থাকবে। ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ এর ২৯(২)(চ) ও ৪৫ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এ নির্দেশনা দেওয়া হলো, যা আগামী ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। বর্তমানে দেশের ব্যাংকগুলো ৪৫ দিন পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের সুযোগ দেয়। ক্রেডিট কার্ডে ঋণসীমার বিপরীতে ৫০ শতাংশের বেশি নগদ উত্তোলন করা যায় না। মাসের একটি নির্দিষ্ট দিনে ক্রেডিট কার্ডের স্টেটমেন্ট জেনারেট হয়। যে তারিখে কার্ড বরাদ্দ হয়, সে তারিখেই ওই কার্ডের স্টেটমেন্ট জেনারেট হয়ে থাকে। একবার স্টেটমেন্ট জেনারেট হওয়ার পর পরের স্টেটমেন্ট জেনারেট হওয়া পর্যন্ত অতিরিক্ত দিনসহ ব্যাংক ভেদে প্রায় ৫০ দিনের ইন্টারেস্ট ফ্রি সময় পাওয়া যায়। আর অতিরিক্ত দিনে বিল মিটিয়ে দিলে সুদ গুনতে হয় না। তবে এটিএম থেকে নগদ টাকা তুললে সেক্ষেত্রে এই ইন্টারেস্ট ফ্রি পিরিয়ড প্রযোজ্য হয় না।

আওয়ামী লীগের আমলে বছরে গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে অর্থনীতিতে অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। আওয়ামী লীগে আমলে বছরে গড়ে ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। রোববার (১ ডিসেম্বর) দুপুরে ঢাকার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদনটি জমা দেওয়া হয়। পরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে প্রতি বছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। তিনি বলেন, ‘শ্বেতপত্রের প্রতিবেদনে অর্থনীতির প্রতিটি খাত ধরে ধরে আলাদা বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে, উন্নয়নের গল্প সাজাতে কীভাবে পরিসংখ্যান মেন্যুপুলেট করা হয়েছে। উন্নয়নের গল্প শোনানো হলেও ভেতরে ভেতরে চলছে লুটতরাজের এক মহাযজ্ঞ।’ প্রতিবেদন গ্রহণ করে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘এই প্রতিবেদন আমাদের জন্য একটা ঐতিহাসিক দলিল। আর্থিক খাতে যে ধরনের ঘটনা ঘটেছে, তা ছিল একটা আতঙ্কের বিষয়। আমাদের সামনে এ ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু কেউ এটা নিয়ে কথা বলেননি।’ শ্বেতপত্রটি কাল সোমবার (২ ডিসেম্বর) প্রকাশ করা হবে।

শেষ ৪ বছরে দেশে এইডস রোগীর সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ

দেশে সবশেষ ৪ বছরে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে এইডসে আক্রান্ত রোগী। চলতি বছর এইচআইভি পজিটিভ শনাক্ত রেকর্ড প্রায় দেড় হাজার। সংক্রমিতদের মধ্যে ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ শনাক্ত ৪০৬ জন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে এমন তথ্য। এ বছর এইডসে প্রাণ গেছে ১৯৫ জনের। রোগীর সাথে সেবাকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়লেও উল্টো দিকে বাড়ছে মৃত্যুসংখ্যাও। বিদেশফেরত কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষায় কড়াকড়ি না থাকায় আক্রান্তরা বহুগুণে আক্রান্ত করছে পরিবার ও প্রিয়জনদের। সর্বোপরি ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীসহ সর্বসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমেই এইচআইভি সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব বলে মত বিশেষজ্ঞদের। তবে সমস্যা সমাধানে কয়েকটি মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে কাজ করছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। স্বাস্থ্য অধিদফতরের এইডস নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে নতুন করে রোগটিতে সংক্রমিত হয়েছে ১ হাজার ৪৩৮ জন। তাদের মধ্যে ৪২ শতাংশ সমকামী, ২৪ শতাংশ সাধারণ মানুষ ও ১০ শতাংশ রোহিঙ্গা। এ ছাড়া প্রবাসী শ্রমিক, যৌনকর্মী, মাদকসেবী ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ রয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এদের ৮০ শতাংশই বিদেশফেরত কর্মী। তাই বিদেশফেরত প্রত্যেক কর্মীর এইচআইভি পরীক্ষা বাধ্যতামূলক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আক্রান্তদের ৬৩ শতাংশই ২৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী, ২১ শতাংশের বয়স ২০ থেকে ২৪ বছর। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন অ্যাপসের মাধমে দেশের সমকামী ব্যক্তিরা একজন অন্যজনের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। পরে দেখা-সাক্ষাতের মাধ্যমে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হচ্ছে। এদের এইডস আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে প্রথম এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। দেশে ২০২৪ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত শনাক্ত হয় ১২ হাজার ৪২২ জন। তাদের মধ্যে মারা গেছে দুই হাজার ২৮১ জন। ইউএনএইডসের অনুমিত হিসাবে দেশে এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তির সংখ্যা ১৪ হাজার। সংক্রমিত ব্যক্তির তুলনায় শনাক্তের হার ৮৮.৭২ শতাংশ। সংক্রমিত সাত হাজার ৫০০ মানুষকে চিকিৎসার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। এখনো প্রায় দুই হাজার সংক্রমিত ব্যক্তি চিকিৎসার বাইরে রয়ে গেছে। তাদের ঝুঁকি অনেক বেশি। এইচআইভিতে আক্রান্ত হয়ে প্রথম এক রোগী মারা যায় ২০০০ সালে। সংক্রমণের হার কম হলেও ঘনবসতি, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন এবং অসচেতনতার কারণে এইচআইভির ঝুঁকি রয়েছে। পাশাপাশি পাশের দেশ ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমারসহ থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় এইচআইভি সংক্রমণের হার অনেক বেশি হওয়ায় বাংলাদেশের ঝুঁকি রয়েছে। ইতোমধ্যে সারা দেশের অনেকগুলো কেন্দ্রে সেবা দেয়া হলেও পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসার আশায় ঢাকাতেই ছুটে আসেন অধিকাংশরা। তবে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের সেবায় সন্তুষ্ট নন রোগীরা। এক রোগী বলেন, চোখের সামনে আমরা মারা যাচ্ছি, আমাদের জন্য আইসিইউর ব্যবস্থা করা দরকার। সরকারি তথ্য অনু্যায়ী, যৌনকর্মী, শিরায় মাদক গ্রহণকারীসহ লুকিয়ে থাকা আক্রান্তদের দ্রুত খুঁজে বের করতে না পারলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা বিশ্লেষকদের। চিকিৎসকরা বলেন, এইচআইভি কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। হাঁচি, কাশি বা থুুতুর মাধমে, একই পাত্রে খাবার বা পানি খেলে আক্রান্ত ঝুঁকি নেই। এমনকি একসঙ্গে ওঠাবসা, খেলাধুলা বা স্পর্শ করলে, হাত মেলালে, জড়িয়ে ধরলে রোগটি ছড়ায় না। তবে এইচআইভিতে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত গ্রহণ করলে, আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত সুচ-সিরিঞ্জ ব্যবহার করলে, আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে কনডম ব্যতীত যৌন মিলন করলে এইচআইভি ভাইরাস ছড়ায়। এ ছাড়া মা থেকে গর্ভাবস্থায় প্রসবের সময় অথবা বুকের দুধ খাওয়ানোর মাধ্যমে সন্তান আক্রান্ত হতে পারে।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মামলা হবে: প্রধান উপদেষ্টা

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, শেখ হাসিনা সরকারের ১৬ বছরের শাসনকালে হাজারো গুম ও জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলনে গণহত্যার জন্য মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) মামলা করা হবে। বুধবার (২৭ নভেম্বর) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আইসিসির চীফ প্রসিকিউটর করিম এ খান সাক্ষাৎ করতে এলে তিনি এ কথা বলেন। সাক্ষাতকালে রোহিঙ্গা সংকট, মিয়ানমারের পরিস্থিতি, রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা এবং জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলনে সংঘটিত নৃশংসতার জন্য বিচার ও জবাবদিহিতা নিয়ে আলোচনা হয়। আইসিসির চীফ প্রসিকিউটর প্রধান উপদেষ্টাকে জানান, তার অফিস মিয়ানমারের সামরিক সরকারের প্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেফতারি পরোয়ানা চেয়েছে। করিম খান রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে একটি বিশেষ বৈশ্বিক সম্মেলন আয়োজনের জন্য প্রধান উপদেষ্টার আহ্বানকে সমর্থন করেন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২০২৫ সালে সম্মেলনটি আয়োজনের সম্মতি দিয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে এই সম্মেলন থেকে সংকটের টেকসই সমাধানের নতুন পথ খুঁজে পাওয়া যাবে। সম্মেলনের স্থান, তারিখ ও কার্যপদ্ধতি ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে নির্ধারণ করা হবে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই সম্মেলন আন্তর্জাতিক সব অংশীদারকে একত্রে নিয়ে এসে সংকটের একটি স্থায়ী সমাধানের পথ বের করতে সাহায্য করবে, বিশেষ করে বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরে বসবাসরত রোহিঙ্গা এবং তাদের শিশুদের দুরবস্থার বিষয়ে। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস আরও বলেন, আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে এই সংকট বিস্ফোরিত না হয়। শিবিরে বেড়ে ওঠা হতাশাগ্রস্ত যুবকদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশে আরও কয়েক হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর ঢল এবং মিয়ানমারের সর্বশেষ পরিস্থিতি বাংলাদেশে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। প্রধান উপদেষ্টা রাখাইন রাজ্যে একটি নিরাপদ এলাকা প্রতিষ্ঠার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন, যা বাস্তুচ্যুত মানুষদের সহায়তা ও চলমান মানবিক সংকট মোকাবিলায় সহায়ক হবে। তিনি আরও বলেন, এই এলাকার নিরাপত্তা জাতিসংঘ নিশ্চিত করবে। যুদ্ধ থেমে গেলে এই এলাকায় বসবাসকারী লোকজন সহজেই তাদের নিজ নিজ স্থানে ফিরে যেতে পারবে। প্রধান উপদেষ্টা জানান, শেখ হাসিনা সরকারের ১৬ বছরের শাসনকালে হাজারো গুম ও জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলনে গণহত্যার জন্য মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে আইসিসিতে মামলা করা হবে। আইসিসি প্রসিকিউটর বলেন, তারা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে ইচ্ছুক। এই ট্রাইব্যুনাল এরই মধ্যে শেখ হাসিনা এবং তার রাজনৈতিক দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। রোহিঙ্গা বিষয়ক উচ্চ প্রতিনিধি খলিলুর রহমান, এসডিজি বিষয়ক প্রধান সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রিয়াজ হামিদুল্লাহ এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। এর আগে রোহিঙ্গা বিষয়ক উচ্চ প্রতিনিধি খলিলুর রহমান প্রসিকিউটর করিম খান এবং তার আইসিসি টিমের সদস্যদের জন্য এক মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেন। খলিলুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ আইসিসি প্রতিষ্ঠার রোম স্ট্যাটিউটে সই করা প্রথম এশীয় দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং আমরা আগামী দিনে আমাদের সহযোগিতা আরও গভীর করার প্রত্যাশা করছি।

সায়মা ওয়াজেদসহ সূচনা ফাউন্ডেশনের পাঁচ ট্রাস্টির অ্যাকাউন্ট জব্দ

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সূচনা ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি সায়মা ওয়াজেদের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। একই সাথে চার ট্রাস্টি মাজহারুল মান্নান, মো. শামসুজ্জামান, জাইন বারি রিজভী, নাজমুল হাসানসহ প্রতিষ্ঠানটির অন্যান্য ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা হয়েছে। এসব অ্যাকাউন্টের লেনদেন ৩০ দিন ফ্রিজ রাখতে বলা হয়েছে। একই সাথে এসব হিসাবের লেনদেনসহ যাবতীয় তথ্য আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে বিএফআইইউতে পাঠাতে বলে রোববার (২৪ নভেম্বর) সব ব্যাংকে এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়েছে। এ পাঁচ অ্যাকাউন্টের পাশাপাশি সূচনা ফাউন্ডেশনের সব হিসাবের তথ্যও চাওয়া হয়। এর পূর্বে, গেল ৩০ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের গবেষণা সেল সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) সংশ্লিষ্ট শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা হয়। এ দিকে, সম্প্রতি দশ সাংবাদিকসহ ১১ জনের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করে এসব হিসাবের তথ্য চাওয়া হয়েছে। তাদের ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবও স্থগিত রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গেল ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে অনেকের হিসাব ফ্রিজ করেছে বিএফআইইউ। তালিকায় সাবেক মন্ত্রী, সাংসদ, পুলিশের দুর্নীতিগ্রস্ত বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, ব্যবসায়ীসহ অনেকে রয়েছেন। বিএফআইইউ ছাড়াও দুদক, এনবিআরসহ বিভিন্ন সংস্থা বিগত সরকারের প্রভাবশালীদের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে কাজ করছে।

ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপির তথ্য সিআইবিতে দেওয়ার নির্দেশ বাংলাদেশ ব্যাংকের

ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোতে (সিআইবি) ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি তথ্য দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে জুনের তথ্য জুলাইয়ের ১ তারিখে রিয়েল টাইমে রিপোর্ট করতে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে (এনবিএফআই) নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার ( ২১ মে) বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি থেকে এমন নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এর আগে ১২ মার্চে এক সার্কুলারের মাধ্যমে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের লাগাম টানতে ইচ্ছাকৃত খেলাপি চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তাও নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই সার্কুলারের বলা হয়, কোনো ঋণখেলাপি গ্রাহকের ঋণ বেনামিতে নেওয়া হলে ও সেই ঋণের অপব্যবহার করলে তা ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবে। ইচ্ছাকৃত খেলাপি চিহ্নিত করতে গত ৯ এপ্রিলের মধ্যে ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা শনাক্তকরণ ইউনিট’ গঠন করারও নির্দেশনা দেওয়া হয়। কারা হবেন ইচ্ছাকৃত খেলাপি ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি যে কেউ ইচ্ছাকৃত খেলাপি হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে ব্যাংক কোম্পানি আইনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ না করলে এবং জালিয়াতি, প্রতারণা বা মিথ্যা তথ্য প্রদানের মাধ্যমে কেউ ঋণ নিলে তা ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবে। এছাড়া যে উদ্দেশ্য ঋণ নেওয়া হয়েছে, তার বাইরে অন্য কাজে ঋণের অর্থ ব্যবহার করলেও তা চিহ্নিত হবে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে। ইচ্ছাকৃত খেলাপি চিহ্নিত করতে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দুই ধাপ নিচের কর্মকর্তার অধীনে ৯ এপ্রিলের মধ্যে পৃথক ইউনিট গঠন করতে হবে। এ ইউনিট কোনো খেলাপি গ্রাহক ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি কি না, তা খুঁজে বের করবে। নতুন করে কোনো গ্রাহক খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হলে, ওই গ্রাহক ইচ্ছাকৃত খেলাপি কি না, তা ৩০ দিনের মধ্যে যাচাই করবে। কেউ ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হলে ১৪ দিন সময় দিয়ে তার বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য চিঠি দিতে হবে। ঋণগ্রহীতার বক্তব্য গ্রহণযোগ্য না হলে বা বক্তব্য উপস্থাপন না করলে ব্যাংক এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এরপর ৭ কর্মদিবসের মধ্যে গ্রাহককে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হওয়ার বিষয়টি অবহিত করে চিঠি দিতে হবে। ইচ্ছাকৃত খেলাপি করায় গ্রাহক ক্ষুব্ধ হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আপিল করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হিসেবে গণ্য হবে। এতে আরও বলা হয়েছে, কোন ব্যাংক এই নির্দেশনার শর্ত অমান্য করলে তাকে কমপক্ষে ৫০ লাখ ও সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা জরিমানা করা হবে। তবে শর্ত লঙ্ঘন অব্যাহত থাকলে প্রতিদিন ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে।

নোংরা পরিবেশে তৈরি হচ্ছিল রাফসানের ব্লু ড্রিংকস, নেই নিবন্ধন সনদ

দেশের জনপ্রিয় ইউটিউবার রাফসান দ্য ছোটভাই খ্যাত ইফতেখার রাফসানের ব্লু ড্রিংকস অননুমোদিত একটি কারখানায় নোংরা পরিবেশে তৈরি হচ্ছিল। পরে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কুমিল্লা বিসিক এলাকায় অভিযান চালায় জেলা প্রশাসন ও বিএসটিআইয়ের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এসময় ঘটনার সত্যতা পেয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। গত ২৪ এপ্রিল কুমিল্লা নগরীর বিসিক এলাকায় অবস্থিত মেসার্স ব্লু ড্রিংকসে অভিযান পরিচালনা করা হয়। শুক্রবার (১৭ মে) ওই খবরটি নতুন করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে বিষয়টি নতুন করে সামনে আসে। বিএসটিআই কুমিল্লার উপ-পরিচালক কে এম হানিফ বলেন, নিবন্ধন সনদ না থাকা এবং নোংরা পরিবেশে পণ্য উৎপাদন করে বাজারজাত করছিল ব্লু ড্রিংকস নামের একটি প্রতিষ্ঠান। পরে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফারহানা নাসরিন ও বিএসটিআইয়ের ভ্রাম্যমাণ আদালতে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। প্রসঙ্গত, গত বছরের ৭ ডিসেম্বর ব্লু নামে ইলেক্ট্রোলাইটস ড্রিংক ব্লু বাজারজাত করার ঘোষণা দেন আলোচিত ইউটিউবার ইফতেখার রাফসান। যিনি রাফসান দ্য ছোট ভাই হিসেবে পরিচিত। তখন লিচু ও তরমুজের ফ্লেভার নিয়ে দুই ক্যাটাগরিতে তারা দেশের বিভিন্ন পয়েন্টে পণ্য বাজারজাত শুরু করে। সম্প্রতি ‘ব্লু’ লেবুর ফ্লেভার বাজারজাত করছে প্রতিষ্ঠানটি।

জব্দ ৮০ কোটি টাকা পেতে মরিয়া জুয়াড়ি কোম্পানী মুনফ্রগ ও উল্কা গেমস

সাখাওয়াত সজীবগেমস ডেভলপের নামে অনলাইন জুয়া পরিচালনা করে বিদেশে অর্থপাচারের ঘটনায় জব্দ ৮০ কোটি টাকা ফিরে পেতে সর্বাত্মক চেষ্টা করছে জুয়াড়ি কোম্পানী মুনফ্রগ ও উল্কা গেমস লিমিটেড। উল্কা তিন পাত্তি জুয়াচক্রের মূলহোতা ও উল্কার সিইও জামিলুর রশীদ কয়েকমাস জেল খাটার পর জামিনে বের হয়ে ৮০ কোটি টাকা ফিরে পেতে ভারতীয় জুয়াড়ি মুনফ্রগ ল্যাবের সাথে বিবাদের নাটক সাজান। এরই অংশ হিসেবে তারা জুয়ার টাকাকে বৈধতা দিতে তথ্য গোপন করে কোম্পানী আইনের ম্যাটার (১৬৪/২০২৪) হিসেবে উচ্চ আদালতে নিয়ে আসেন। যদিও তারা অবৈধ জুয়া কোম্পানীর রেজিস্ট্রেশনই নিয়েছেন মিথ্যা তথ্য দিয়ে। এছাড়া বিনিয়োগ বোর্ডেও মিথ্যা তথ্য দিয়ে অনুমোদন নিয়ে দেশ থেকে শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। র‌্যাবের দায়ের করা মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের ৩০ অক্টোবর র‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার হয় জুয়াড়ি কোম্পানি উল্কা গেমসের সিইও জামিলুর রশীদ। গ্রেপ্তার জামিলুর রশিদ এই অনলাইন জুয়া চক্রের মূল হোতা। ২০১৭ সালে প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রতিষ্ঠান মুনফ্রগ ল্যাবসের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। ২০১৮ সালে মুনফ্রগের বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে দেড় লাখ টাকার বেশি বেতনে এতে যুক্ত হন তিনি। মুনফ্রগের অনলাইন জুয়ার অ্যাপ তিনপাত্তি গোল্ডের জনপ্রিয়তা বেড়ে গেলে ২০১৯ সালের শুরুর দিকে জামিলুর উল্কা গেমস নামের একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন। দেশে গেম বানানোর অনুমোদন থাকলেও জুয়ার বৈধতা না থাকায় গেম ডেভলপ করার মিথ্যা তথ্য দিয়ে তিনি উল্কা গেমসের নিবন্ধন নেন। এমনকি মিথ্যা তথ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) কাছ থেকে গেম বানানোর কথা বলে অনুমতি নেয় ‘উল্কা গেমস লিমিটেড’। এরপরে মুনফ্রগ ল্যাবসের মাধ্যমে দেশে অনলাইন জুয়ার কারবার শুরু করে। মুনফ্রগ থেকে কাগজে-কলমে মাত্র সোয়া কোটি টাকার কথিত বিনিয়োগ এনে অনলাইন জুয়া পরিচালনা করে ব্যাংকিং চ্যানেলেই ২০০ কোটি টাকা দেশ থেকে বিদেশে সরিয়ে নিয়েছে চক্রটি। বিনিয়োগ বোর্ড কীভাবে একটি জুয়া কোম্পানীকে অনুমোদন দিয়েছে?২০২২ সালে উল্কা চক্রের গ্রেপ্তারের পর সংবাদমাধ্যমের এমন প্রশ্নের মুখে পড়েছিল বিনিয়োগ বোর্ড। বিডা তখন জানিয়েছিল, বাংলাদেশ সবসময় বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত করে আসছে। বিদেশি বিনিয়োগের অনুমতি দিয়ে থাকে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। গেমিং ডেভেলপমেন্টে ভারতীয় কোম্পানিটি বিনিয়োগ করতে চাইলে বিডা সহজেই তাদের অনুমতি দেয়। তবে গেমিং সেক্টরে ডেভেলপমেন্টের কথা বলে অনলাইন জুয়ার কোনও খেলা তারা চালু করবে তা বুঝতে পারেনি বিডা। বিডার একজন কর্মকর্তা তখন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, বিদেশি বিনিয়োগ সবসময় উৎসাহিত করা হয়। সবাই সব নিয়ম-কানুন মেনেই বিনিয়োগ করেন। তারা বিনিয়োগ করে লাভ নিবেন—এটাই স্বাভাবিক। তবে কোনভাবেই দেশের আইনে অনুমতি দেয় না, এমন বিনিয়োগ কেউ চায় না। উল্কা গেমস একটি বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে আসে। ডিজিটাল বা অনলাইন গেম ডেভেলপমেন্টের বিনিয়োগকে বিডা স্বাগত জানায়। তবে তারা যে এভাবে জুয়া খেলবে, তা বিডার জানা ছিল না। ওই কর্মকর্তা দাবি করেছিলেন, বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিমাসে একটি প্রতিবেদন দেওয়ার কথা। কিন্তু উল্কা গেমস নিয়মিত কোনও প্রতিবেদন দেয়নি। তাদেরকে বারবার বলার পরও তারা কোনও প্রতিবেদন দেয়নি। তারা গেম ডেভেলপমেন্টের কথা বলে বিডা থেকে অনুমতি নিয়েছে। ডেভেলপমেন্টের তারা কী করছে তা বিডাকে জানায়নি, তারা কেবল ভারতের ‘তিন পাত্তি গোল্ড’ গেম বাংলাদেশে শিফট করেছে। নিবন্ধন নেওয়ার সময়ে উল্কা ‘তিন পাত্তি গোল্ডের’ বিষয়ে বিস্তারিত কিছুই জানায়নি বলেও জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘তারা বিনিয়োগের কথা বলে কার্ডের কী গেম ছড়িয়ে দিবে তাতো আমাদের বলেনি।’ বিডার তৎকালীন ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন বিভাগের ডিরেক্টর জেনারেল শাহ মোহাম্মদ মাহবুব সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে উল্কার কাছে তথ্য চেয়েছি। তারা কোন খাতে কী বিনিয়োগ করেছে, তা তাদের জানাতে হবে।’ মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিডার অনুমতি নিয়ে উল্কার মাধ্যমে ব্যাংকিং চ্যানেলে একটি আন্তর্জাতিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে অর্থ নিয়েছে ভারতের জুয়াড়ি কোম্পানি মুনফ্রগ। অনলাইন জুয়া পরিচালনা করে কোম্পানিটি ২০১৯-২০ অর্থ বছরে দেশ থেকে প্রায় ১৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা সরিয়ে নিয়েছে। পরের অর্থ বছরে সরিয়েছে প্রায় ৫৭ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থ বছরে তারা প্রায় ৯৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা সরিয়ে নিয়েছে। বিডার অনুমতি থাকায় অনলাইন জুয়ার কোম্পানিটি টাকা ব্যাংকিং মাধ্যমে দেশ থেকে নিয়ে গেছে। এভাবে অনলাইনে জুয়ার মাধ্যমে গত ৩ বছরে ১৭৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে কোম্পানিটি। ব্যাংকিং চ্যানেল ছাড়াও হুন্ডির মাধ্যমে তারা হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। জুয়া পরিচালনা, মানি লন্ডারিং, তৎকালীন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ একাধিক আইনে ২০২২ সালের ১ নভেম্বর তাদের বিরুদ্ধে রাজধানীর কাফরুল থানায় মামলা হয়। যার নং- ০১/৩১৯। মামলায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা ছিলেন— জুয়াড়ি চক্রের প্রধান জামিলুর রশিদ (৩১), সায়মন হোসেন (২৯), মো. রিদোয়ান আহমেদ (২৯), মো. রাকিবুল আলম (২৯), মো. মুনতাকিম আহমেদ (৩৭) ও কায়েস উদ্দিন আহম্মেদ (৩২)। ৩০ অক্টোবর অভিযান চালিয়ে রাজধানীর মহাখালী ও উত্তরা থেকে র‌্যাব তাদের গ্রেপ্তার করেছিল। গ্রেপ্তার অনেকেই এখন জামিনে রয়েছে বলে জানা গেছে। কোন কোন ব্যাংকে ৮০ কোটি টাকাজুয়াড়ি চক্রের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, উল্কা গেমসের ৪টি ব্যাংক একাউন্টে জুয়ার ৮০ কোটি টাকা রয়েছে। এরমধ্যে ইস্টার্ন ব্যাংকের একাউন্টে রয়েছে দেড় কোটি টাকা। বাকি টাকা ব্র্যাক ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ও ডাচ-বাংলা ব্যাংকে রয়েছে। জুয়ার জব্দ টাকার মধ্যে সবচেয়ে বড় অংক রয়েছে ব্র্যাক ব্যাংকের একাউন্টে। ব্র্যাক ব্যাংকে সেদিন কী হয়েছিলদেশের ব্যাংকিং খাতের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে গত ৩০ এপ্রিল। এদিন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উপপরিচালক তানিয়া সুলতানার সাক্ষরিত আদেশসহ ব্র্যাক ব্যাংকের গুলশান-১ শাখায় যায় এনবিআরের একটি টিম। সেখানে বলা হয়, উল্কা গেমসের কাছ থেকে ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরের বকেয়া কর ও সুদ বাবদ ৫৩,৯৭,৮৩,৬৫২ (তেপ্পান্ন কোটি সাতানব্বই লাখ তিরাশি হাজার ছয়শত বায়ান্ন) টাকা পাওনা রয়েছে। এরমধ্যে ব্র্যাক ব্যাংকে থাকা প্রায় ৫১ কোটি টাকা কর অঞ্চল-১৫ বরাবর পে অর্ডার করে দিতে বলা হয়। কিন্তু উল্কা গেমসের একাউন্টে লেনদেনের বিষয়ে আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় কোর্টের অনুমতি ছাড়া এনবিআরকে টাকা দিতে অপারগতা জানায় ব্র্যাক ব্যাংক। এতে ক্রমেই বড় হতে থাকে বিবাদ। এনবিআর থেকে আরও উচ্চপর্যায়ের টিম আসে ব্র্যাক ব্যাংকের গুলশান-১ শাখায়। ব্র্যাক ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও গুলশান-১ শাখার এ ঘটনার দিকে নজর দেয়। একপর্যায়ে ব্র্যাক ব্যাংকের আইন শাখা বিষয়টি সরাসরি মোকাবেলা করতে থাকে। এতে এনবিআরের টাকা পাওয়ার পথ সংকুচিত হয়ে আসে। তবে এনবিআর কর্মকর্তারাও নাছোড়বান্দা ছিলেন। এই ঘটনায় নজিরবিহীনভাবে ১৩ ঘণ্টা তারা ব্র্যাক ব্যাংকের গুলশান-১ শাখায় ছিলেন। শেষ পর্যন্ত ৫১ কোটি টাকা না পাওয়ায় বিষয়টিকে ‘ব্র্যাক ব্যাংকের অসহযোগিতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ’ বলেও মন্তব্য করেছেন কর অঞ্চল-১৫ এর উপ কর কমিশনার ফারজানুল ইসলাম। তবে ব্র্যাক ব্যাংক শুরু থেকেই অসহযোগিতার কথা খারিজ করে বলে এসেছে, আদালতের আদেশ পেলে এনবিআরকে টাকা দিতে তাদের কোনো আপত্তি নেই। সেজন্য পরদিন মে দিবসের বন্ধের মধ্যেও বিষয়টি হাইকোর্টে নিয়ে গেছে ব্র্যাক ব্যাংক। সেখানে শুনানিতে তারা ৩০ এপ্রিলের সেই নজিরবিহীন ১৩ ঘণ্টার বিষয় আদালতের নজরে আনেন এবং এ বিষয়ে করণীয় কী তা জানতে চান। শুনানি শেষে আদালত ৫ মে’র পূর্বনির্ধারিত শুনানির আগ পর্যন্ত ওই অ্যাকাউন্টের টাকা হস্তান্তর করতে নিষেধাজ্ঞা দেন। এর ফলে এখনও দাবিকৃত টাকা পায়নি এনবিআর। জুয়াড়ি চক্রের নয়া ফন্দির‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তারের পর তিন পাত্তি জুয়াড়ি চক্রের শত শত কোটি টাকা আয় ও পাচারের থলের বিড়াল বের হয়ে আসতে থাকে। এরপর সরকারের বিভিন্ন সংস্থা তাদের ব্যাংক একাউন্ট জব্দের উদ্যোগ নেয়। এতে তাদের শেষ কয়েকদিনের আয়ের কিছু অংশ ৮০ কোটি টাকার বেশি আটকা পড়ে যায়। প্রথমে সেদিকে নজর না দিলেও জামিনে মুক্ত হয়ে আসার পর তারা ওই টাকা আত্মসাতের ফন্দি করতে থাকে। ব্র্যাক ব্যাংকের প্রধান আইন কর্মকর্তার বক্তব্যেও বিষয়টি জানা যায়। তিনি গত ৩০ এপ্রিলের ঘটনায় সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘উল্কা গেমসের পক্ষদ্বয়ের আমাদের ব্যাংকে যে রক্ষিত টাকা আছে সেই টাকার বিষয়ে একটি আদেশ আসে। সেই আদেশটা ছিল, পক্ষদ্বয় ব্র্যাক ব্যাংকে রক্ষিত টাকা অন্য একাউন্টে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু ইতিপূর্বে এই টাকায় এনবিআরের ফ্রিজ আদেশ বা নিষেধাজ্ঞা ছিল। তখন আমরা এনবিআরের স্বার্থ রক্ষার্থে বিষয়টি আদালতকে অবগত করি এবং আমাদের করণীয় জানতে চাই। আদালত তখন আরেকটি আদেশ দেন, ৫ মে সেটি শুনানির জন্য কার্যতালিকায় রয়েছে। এখন এটি যেহেতু বিচারাধীন বিষয়, সুতরাং আমরা আদালতের অনুমতি ছাড়া টাকা দিয়ে দিতে পারি না। এখানে ব্র্যাক ব্যাংকের কোনো স্বার্থ নেই। বরং এনবিআরের স্বার্থ রক্ষার জন্যই আমরা আদালতকে বিষয়টি জানিয়েছি। উচ্চ আদালত শুনানি শেষে যে আদেশ দিবেন আমরা সেই মোতাবেক কাজ করব।’ জানা যায়, বিদেশি জুয়াড়ি কোম্পানী মুনফ্রগের পরামর্শেই জুয়ার বিষয়টি গোপন করে শেয়ার সংক্রান্ত বিবাদের নাটক সাজিয়ে কোম্পানী আইনে উচ্চ আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল- দুই কোম্পানীর মধ্যে বিবাদের মামলা হলে আদালত কোম্পানী আইনে বিবেচনা করে যে কোম্পানীর পক্ষেই রায় দিক, টাকা মূলত তাদের হাতেই যাবে। কেননা দুই কোম্পানী মিলেই অনলাইন জুয়াচক্র পরিচালনা করে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে আসছিল। সূত্র জানায়, প্রথমে এনবিআরকে না জানিয়ে কোর্টের আদেশে টাকা সরিয়ে নিতে চাইলেও ব্র্যাক ব্যাংকের তৎপরতায় সেই চেষ্টা ভেস্তে যায়। এনবিআরের পাওনার বিষয়টিও আদালতের সামনে চলে আসে। এতে হাইকোর্টে ৫ মে’র শুনানিতে জুয়ার বিষয় সামনে চলে আসে কিনা, সেই বিষয়েও জুয়াড়ি চক্র আতঙ্কে ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় দুবাইয়ে কিছুদিন আগে দুই জুয়াড়ি চক্রের একটি বৈঠক হয়। বৈঠকের আলোচনায় তাদের আশঙ্কা ছিল, আদালত যদি কোনভাবে জুয়ার বিষয়টি জেনে সেটি বিবেচনায় নিয়ে পুরো টাকা জব্দ করে সরকারি কোষাগারে নিয়ে নেওয়ার আদেশ দেন, তাহলে পুরোটাই হাতছাড়া হয়ে যাবে। সেজন্য দুই চক্র শেষ পর্যন্ত এনবিআরের করের টাকা পরিশোধে একমত হয়। কোনভাবে এনবিআর যদি করের টাকা নিয়েও যায়, তাহলে বাকিটা ভ্যাট-ট্যাক্স পরিশোধ করা সাদা টাকা হিসেবে বৈধতা পেয়ে যাবে। এতে জুয়াড়ি দুই পক্ষ কথিত বিবাদ মীমাংসানামা দাখিল করে যেকোন এক পক্ষ বা উভয় পক্ষকে বাকি টাকা দিয়ে দেওয়ার আবেদন করবে। পুরোটা হারানোর চেয়ে কিছুটা পাওয়া ভালো, এটাই ছিল সেদিনকার বৈঠকের মূল সিদ্ধান্ত। তিন পাত্তি জুয়া চক্রের পেছনে কারার‌্যাবের অভিযানে ৫ প্রধান সহযোগীসহ উল্কা গেমসের সিইও জামিলুর রশীদ গ্রেপ্তার হওয়ার পর বেরিয়ে এসেছিল মাফিয়া চক্রের পরিচালনায় ভয়ঙ্কর জুয়াড়িদের টাকা পাচারের তথ্য। বাংলাদেশে এর পরিচালনার দায়িত্বে ছিল জামিলুর রশীদ। সে তার সহযোগীদের দিয়ে হাজার কোটি টাকা পাচার করে আসছিল। র‌্যাবের অভিযানে জুয়ার বিষয় উঠে আসলে ভারতের বেঙ্গালুরুতেও জুয়াড়ি কোম্পানী মুনফ্রগের সদর দপ্তরে ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালায়। এর আগেও একাধিকবার মুনফ্রগের বিরুদ্ধে ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়েছিল। সেসময় গোয়েন্দা সূত্রে জানা গিয়েছিল, পাকিস্তান এবং দুবাইভিত্তিক একটি মাফিয়া গোষ্ঠী তিন পাত্তি জুয়া চক্র পরিচালনা করছিল। ওই মাফিয়া গোষ্ঠীর আয়ের মূল উৎস ছিল তিন পাত্তি গোল্ড। ভারতে ধাওয়া খেয়ে গোয়েন্দা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে মুনফ্রগ তখন সুইডেনে আশ্রয় নেয়। সুইডেনের কাগুজে কোম্পানী স্টিলফ্রন্টকে দিয়ে মুনফ্রগ অধিগ্রহণ করে নেওয়া হয়েছে বলে খবর ছড়ানো হয়। সুইডেনের অধিগ্রহণকৃত কোম্পানীর বিরুদ্ধে যেন ভারত সরকার কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারে, সেজন্যই মূলত এই নাটক সাজানো হয়েছিল। পরে ২০২২ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের উল্কা গেমসের বিষয়েও নিজেদের ওয়েবসাইটে বিবৃতি দিয়েছিল জুয়াড়ি কোম্পানী স্টিলফ্রন্ট। বিবৃতিটি দেখুন এখানে মূলত বিভিন্ন দেশের সরকার, আইশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দেওয়ার লক্ষ্যে এসব করে আন্তর্জাতিক মাফিয়াদের জুয়াড়ি চক্র। সেই ধারাবাহিকতায় এখনও অবৈধ জুয়ার জব্দ টাকাকে কোম্পানী আইনের ম্যাটার হিসেবে নিয়ে হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে মুনফ্রগ ও উল্কা গেমস নামক সেই দুই জুয়া কোম্পানী। জুয়ার জব্দ টাকা আসলে কে পাবে?জুয়াকাণ্ডে জব্দ হওয়া পুরো ৮০ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, জুয়া পরিচালনা করা এবং জুয়া পরিচালনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করা অবৈধ কর্মকাণ্ড। কেননা জুয়া খেলার টাকা এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদি সংগ্রহ করতে গিয়ে অনিয়ম ও অপরাধে জড়িয়ে পড়েন জুয়াড়িরা। সেজন্য বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে এর কোনরূপ বৈধতা নেই। সুতরাং অবৈধ জুয়ার টাকায় ভ্যাট-ট্যাক্স আরোপ হওয়ার কথা নয়। অন্যদিকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে কোম্পানীর রেজিস্ট্রেশন নেওয়াটাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এখনও যদি কেউ মিথ্যা তথ্য দিয়ে জব্দ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ফন্দি করে থাকে, তাহলে সেটি ভয়ঙ্কর ব্যাপার। উচ্চ আদালত নিশ্চয়ই সব বিষয় বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। তবে এটুকু বলা যায় যে, জুয়াড়ি কোম্পানী কোনভাবেই জব্দ টাকা ফেরত পাওয়ার অধিকার রাখে না। জব্দ হওয়া টাকার পুরোটাই সরকারি কোষাগারে জমা করা উচিত। এতে দেশের জনগণ লাভবান হবে। ঢাকাওয়াচ/স