অদৃশ্য হাতের ইশারায় ধরাছোঁয়ার বাইরে ‘ব্যাংক খেকো’ সাবেক তিন গভর্নর


Feb 2025/Fazle kabir.jpg

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশের ব্যাংক খাত ধ্বংস করে গেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক তিন গভর্নর আতিউর রহমান, ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদার। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর ব্যাংক খাত সংস্কার করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারকে। ৫ আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত ব্যাংক খেকোরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। খাতটি ধ্বংসের মূল হোতা সাবেক তিন গভর্নরকে এখনো ধরেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অর্থাৎ, তারা অদৃশ্য শক্তিবলে এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। সাবেক এই তিন গভর্নরের মধ্যে রিজার্ভ চুরির মূল হোতা আতিউর রহমান দেশের বাহিরে রয়েছেন। 

  • কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রউফের তালুকদারী বহাল থাকার অভিযোগ
  • তথ্য গোপন করে আওয়ামী লীগ সরকারকে ৪১ হাজার কোটি টাকা নতুন টাকা ছাপিয়ে ঋণ দিয়েছিল
  • ৫ আগস্টের পর পালিয়ে বেড়াচ্ছেন ফজলে কবির
  • রিজার্ভ চুরির মূল হোতা আতিউর রহমান দেশের বাইরে 

আগের সরকারের সময়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি বলেছে, ‘দেশের ব্যাংক খাতে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ এখন ৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। খাতটি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় সংস্থার সহায়তায় ব্যাংক দখল হয়েছে। একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতেই সাতটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হয়। এই সুযোগে বড় অঙ্কের অর্থ দেশের বাইরে পাচার করা হয়।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০০৯ সালে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা। সদ্য সমাপ্ত ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ, আলোচ্য সময়ের মধ্যে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৩ গুণ। এছাড়া, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) তিন মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। ফলে, ব্যাংক থেকে বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশই বর্তমানে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার আহসান এইচ মনসুরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদে নিয়োগ দেয়। সম্প্রতি আহসান এইচ মনসুর এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়ে আগামী দিনে মোট ঋণের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশে পৌঁছে যাবে। এসব ঋণের বড় অংশই ২০১৭ সালের পর দেওয়া হয়েছে, যার বড় অংশই পাচার হয়ে গেছে।’

প্রাপ্ত তথ্যমতে, আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি ক্ষমতা নেওয়ার দিনে গভর্নর ছিলেন বর্তমান অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। ওই বছরের ৩০ এপ্রিল তাঁর মেয়াদ শেষ হলে নতুন গভর্নর হন আতিউর রহমান। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার পরে তিনি পদত্যাগ করেন। তাঁর সময় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে নতুন ব্যাংক অনুমোদন ও ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা দিয়ে বিতর্কিত হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এরপরে ২০১৬ সালে সাবেক অর্থসচিব ফজলে কবির গভর্নর হলে একের পর এক ব্যাংক দখল হতে থাকে। এসব ব্যাংকে নির্বিচার লুটপাট শুরু করে দখলকারীরা। নতুন ব্যাংক অনুমোদন ও ঋণ নীতিমালায় ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণ গোপন করার কৌশলও দেখা যায় তাঁর সময়ে। ২০২২ সালে গভর্নর পদে বসানো হয় আরেক সাবেক অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদারকে। তাঁর আমলেও আগের ধারা অব্যাহত থাকে। 

অভিযোগ রয়েছে, আমলাদের শক্তিবলেই এখনো ধরা পড়েননি ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদার। কারণ তারাও সাবেক অর্থসচিব অর্থাৎ আমলাই ছিলেন। তাদের দুইজনের সহযোগীরা অনেকে এখনো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল রয়েছে। আর তাদের শক্তি কাজে লাগিয়ে সাবেক এই দুই গভর্নর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জালের বাহিরে রয়েছেন। 

আব্দুর রউফ তালুকদার সময়ে ব্যাংকিং খাতের লুটপাটের আগের ধারা অব্যাহত থাকে। একদিকে, লুটেরারা ব্যাংক খালি করে বিদেশে পাচার করছিলেন। অন্যদিকে, টাকা ছাপিয়ে ব্যাংকগুলো ভরে দিচ্ছিলেন রউফ তালুকদার। অর্থাৎ, ব্যাংক লুটের আরও সুযোগ করে দিয়েছিলেন সাবেক এই গভর্নর। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর তারও রক্ষা হয়নি। কারণ শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর  আব্দুর রউফ তালুকদারো লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান। এই ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি পদত্যাগ করেন।

সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের শেষ দিকে অর্থাৎ আতিউর রহমান গভর্নর থাকা অবস্থায় ব্যাংক খাতে তদারকি কমিয়ে দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এমন পরিস্থিতির মধ্যে হলমার্কের জালিয়াতি ফাঁস হয়। এরপরেই বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের পর্ষদে পরিবর্তন আনা হয়। একই গভর্নরের আমলে বেসিক ব্যাংক বড় জালিয়াতি হয়। এছাড়া, ২০১২ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় আওয়ামী লীগ নেতাদের বেশ কয়েকটি ব্যাংক অনুমোদন দেওয়া হয়। এভাবেই ব্যাংক লুটপাটের সূচনা করে গেছে সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান। এরপর ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চুরি হলে আতিউর রহমান পদত্যাগ করেন। 

২০১৬ সালের মার্চ মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান ফজলে কবির। এরপর ২০১৭ সালের শুরুতে ইসলামী ব্যাংক ও পরে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল) দখল করতে সহায়তা করেন তিনি। তারপর এসব ব্যাংকে লুটপাটের সুযোগ তৈরি করে দিতে তদারকি ঢিলেঢালা আনেন ফজলে কবির। তার সময়ে ঋণ নীতিমালায় ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণ গোপন করার কৌশল পদ্ধতি আবিষ্কার করা হয়। এছাড়া সুদের হার ৯ শতাংশে আটকে রেখে ব্যবসায়ীদের ব্যাপক সুবিধা দিয়ে নিয়ন্ত্রণহীন করে ফেলা হয় দেশের ব্যাংক খাত। 

ফজলে কবিরের পর গভর্নরের দায়িত্ব নিয়ে আব্দুর রউফ তালুকদার ব্যাংক খাত লুটপাটে সহযোগীতা করার দায়িত্ব হাতে নেন। আগের দুই গভর্নরের মতোই তার সময়েও ব্যাংক ঋণে জালিয়াতি ও অনিয়ম অব্যাহত থাকে। লুটপাট হওয়া ব্যাংকগুলোতে তিনি ছাপিয়ে তারল্য সুবিধা দিয়েছেন। এছাড়া বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদেরকে রিজার্ভ থেকে ব্যাপক হারে ডলার দেওয়া হয়। এর ফলে দুই বছরের মধ্যে রিজার্ভ তলানিতে নেমেছিল। তাঁর সময়ে আর্থিক তথ্য প্রকাশ সীমিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশও বন্ধ করে দেওয়া হয়। সরকারের পতন ঘটলে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। এরপর কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি পদত্যাগ করেন। 

সাম্প্রতিক সময়ে গ্রেপ্তার হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার সুর চৌধুরী। এরপর আদালতের অনুমতি নিয়ে দুর্নীতিন দমন কমিশন (দুদক) ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে এসকে শুরের জমা করা তিনটি সিলগালা কৌটা খুলে। এসব কৌটায় ৫৫ হাজার ইউরো, ১ লাখ ৬৯ হাজার ৩০০ মার্কিন ডলার, ১০০৫ দশমিক ৪ গ্রাম স্বর্ণ ও ৭০ লাখ টাকার এফডিআর পাওয়া যায়। জানা যায়, এসব সম্পদ তার নিয়মিত আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করা হয়নি।

তল্লাশিকালে রেজিস্ট্রার পরীক্ষা করে দেখা যায়, সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্য কিছু কর্মকর্তাও সিলগালা করে সেফ ডিপোজিট রেখেছেন। এসব সিলগালা কৌটাতেও অপ্রদর্শিত সম্পদ থাকার অবকাশ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগে দুদকের অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে সম্প্রতি দুদকের অনুরোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৩০০ লকার জব্দ করেছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। এসব লকার খুলে দেখার জন্য ইতিমধ্যে আদলতের অনুমতি পেয়েছে দুদক। তবে যে কোনো সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে থাকা এসব লকার খোলা হতে পারে।

ঢাকাওয়াচ২৪ এর খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন ।
ঢাকাওয়াচ২৪ডটকমে লিখতে পারেন আপনিও ফিচার, তথ্যপ্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, ভ্রমণ ও কৃষি বিষয়ে। আপনার তোলা ছবিও পাঠাতে পারেন dhakawatch24@gmail.com ঠিকানায়।
×