থামছে ফিলিস্তিনের কান্না, ফিরে আসবে কি নিহতরা?
- নিউজ ডেস্ক
- প্রকাশঃ ০৯:০৪ পিএম, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫

৪৬ হাজার ফিলিস্তিনির প্রাণহানির পর যুদ্ধবিরতি। থেমেছে ফিলিস্তিনের কান্না। কিন্তু নিহতরা কি ফিরে আসবে? ফিলিস্তিন মুসলমানদের কাছে একটি পবিত্র ভূমি। এটি কেবল ঐতিহাসিক বা রাজনৈতিক ইস্যু নয়; এটি ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কুরআন ও হাদিসে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে মুসলিমদের একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর দায়িত্বের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
পৃথিবীর প্রতিটি কোণে মানুষ ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করেছে। কিন্তু ফিলিস্তিনে যে নির্মম অত্যাচার, নিষ্পেষণ, ও অমানবিক আচরণ চলছে, তা আজও কোন স্থায়ী সমাধান পায়নি। সেই কান্না, সেই আর্তনাদ আজও আমাদের কানে পৌঁছায়, কিন্তু আমরা কি সত্যিই তাদের জন্য কিছু করতে পেরেছি?
ফিলিস্তিন বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন আরব ভূখণ্ড, যা ইতিহাস, সংস্কৃতি ও পবিত্রতার এক অপূর্ব নিদর্শন। এ পবিত্র ভূমির প্রতিটি প্রান্ত জুড়ে ছড়িয়ে আছে আম্বিয়ায়ে কেরামের অজস্র স্মৃতি। ফিলিস্তিনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রায় পাঁচ হাজার নবী ও রাসুল আলাইহিমুস সালাম চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন। এটি এমন এক ভূমি, যা আম্বিয়ায়ে কিরামের দাওয়াত, ত্যাগ ও তাওহিদের বার্তায় পবিত্রতায় ভাস্বর।
তাদের স্মৃতিচিহ্ন আজও ফিলিস্তিনের মাটি ও আকাশকে আলোকিত করে রেখেছে। ফিলিস্তিনের প্রতিটি ধূলিকণা যেন নবিদের পদচিহ্নের সাক্ষী। এখানকার প্রতিটি প্রান্তে লুকিয়ে আছে তাদের দাওয়াহর মর্মবাণী, যা আজও সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে আছে। এটি শুধু একটি ভূখণ্ড নয়; বরং মুসলমানদের জন্য ঈমানের অংশ ও ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের অমূল্য ধন।
ফিলিস্তিনের ভূমি ও ইতিহাস: ফিলিস্তিন এক সময় ছিল শান্তিপূর্ণ এক ভূমি, যেখানে মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদিরা মিলেমিশে একসঙ্গে শান্তিতে বসবাস করত। তবে এই শান্তি দীর্ঘ স্থায়ী হয়নি। ১৯১৭ সালে কুখ্যাত বেলফোর ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার মাধ্যমে ইহুদিবাদী ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভিত্তি স্থাপন হয়। এর কয়েক বছর পর ১৯২৪ সালে খেলাফতের উচ্ছেদ মুসলিম উম্মাহর জন্য এক গভীর সংকটের সূচনা করে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ১৯২৬ সালে সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব মুসলিম সম্মেলন, যেখানে মুসলমানদের সমগ্রিক পরিস্থিতি ও বিশেষত ফিলিস্তিন প্রসঙ্গ গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হয়। এরপর, ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ও ধারাবাহিক ভূমি দখলের ফলে ফিলিস্তিনি জনগণের শান্তির সেই ভূমি এক মৃত্যুপুরীতে রূপান্তরিত হয়। আজ ফিলিস্তিনের অধিকাংশ অঞ্চল দখল হয়ে গেছে। গাজা ও পশ্চিম তীর পরিণত হয়েছে খোলা জেলখানায়, যেখানে ফিলিস্তিনিরা প্রতিনিয়ত নিপীড়ন ও বঞ্চনার শিকার। ফিলিস্তিনের এই করুণ অবস্থা মুসলিম উম্মাহর জন্য এক গভীর ক্ষত, যা অবিলম্বে সমাধানের দাবি রাখে।
গাজার রক্তাক্ত বাস্তবতা: গাজা, বিশ্বের বৃহত্তম খোলা কারাগার, যেখানে প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। ইসরায়েলের আরোপিত কঠোর অবরোধের ফলে পানি, খাদ্য, চিকিৎসা, বিদ্যুৎসহ মৌলিক চাহিদাগুলো চরম সংকটে পড়েছে। এখানে শিশুদের শিক্ষা ও স্বপ্ন বুলেট ও বোমার আঘাতে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গাজার ৮০ শতাংশ মানুষ মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। এই অবস্থা একদিকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রকৃষ্ট উদাহরণ, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতার প্রতীক। অবিলম্বে এই সংকট নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন।
ফিলিস্তিনের শিশুদের কান্না: ফিলিস্তিনের শিশুরা পৃথিবীতে চোখ খুলেই দেখতে পায় যুদ্ধের নির্মমতা। তাদের জন্য শৈশব মানে নয়নাভিরাম রং, কাগজের নৌকা কিংবা মায়ের কোলের স্নেহ; বরং শৈশব তাদের কাছে পরিচিত গোলাগুলি, বোমার শেল আর প্রিয়জনের রক্তে ভেজা মাটি দিয়ে। প্রতিদিন তারা দেখে নিজেদের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যেতে, প্রিয়জনদের লাশ মাটিতে লুটিয়ে পড়তে। যেখানে আমাদের সন্তানেরা খেলনা নিয়ে হাসিমুখে শৈশব কাটায়, সেখানে ফিলিস্তিনের শিশুরা এক মুঠো খাবারের আশায় ক্ষুধার্ত পেটে রাত কাটায়। তাদের জীবন থেকে হাসি, শান্তি, ও নিরাপত্তা যেন চিরতরে হারিয়ে গেছে। আমরা কি পারি এই নিষ্ঠুর বৈষম্য মেনে নিতে? আমরা কি পারি সেই নিষ্পাপ মুখগুলোর আর্তনাদ শুনেও চোখ বুজে থাকতে?
বিশ্বের নীরবতা: ফিলিস্তিনের এই অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের মাঝে, যখন প্রতি মুহূর্তে রক্ত ঝরছে ও নিরীহ মানুষের রাত্রি কাটছে আতঙ্কের মধ্যে, তখনও বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলি তাদের পাশে দাঁড়ানোর সাহস দেখায় না। জাতিসংঘ বারবার প্রস্তাব পাস করলেও, তা বাস্তবায়নে কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না, যেন তাদের জন্য মানবতার কোনো মূল্য নেই। ইসলামি রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে দেখা যায় শুধুমাত্র কিছু শব্দ আর নিন্দার উচ্চারণ,কিন্তু তাতে কি বাস্তবিক পরিবর্তন এসেছে? তাদের প্রকৃত দায়িত্ব পালনে কোনো উদ্যোগ নেই, যেন ফিলিস্তিনের আর্তনাদ তাদের কানে পৌঁছায় না। আমরা কি কেবল শব্দের শক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকব? কেবল নিন্দা জানিয়ে নিজেদের কর্তব্য শেষ করে দেব? না, আমাদের দায়িত্ব অনেক বড়, ও ফিলিস্তিনের প্রতি আমাদের সহানুভূতি শুধু ভাষায় সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়।
আমাদের করণীয়: ফিলিস্তিনের প্রতি আমাদের নীরবতা এক দিন আমাদের জন্য বড় অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে। ইসলামের আলোকে আমাদের করণীয় অনেক কিছুই রয়েছে, ফিলিস্তিন ইস্যুতে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর ঐক্য অত্যন্ত জরুরি। দলাদলি, বিভাজন, ও রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে একত্রিত হওয়া দরকার। কুরআনের নির্দেশনা, তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করো ও বিভক্ত হয়ো না। (সুরা আলে ইমরান, ১০৩) দোয়া করা, ফিলিস্তিনের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা, তাদের মুক্তি ও শান্তির জন্য প্রার্থনা করা আমাদের দায়িত্ব। আল্লাহ বলেন, তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। (সূরা গাফির, ৬০) সাহায্য প্রদান, যারা আর্থিকভাবে সক্ষম, তাদের জন্য মানবিক সহায়তা প্রেরণ করা জরুরি। ধন-সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করো, যাতে তোমরা পরিত্রাণ পেতে পারো।(সুরা বাকারা, ২৬۱) সচেতনতা বৃদ্ধি, সামাজিক মাধ্যমে ফিলিস্তিনের প্রকৃত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা ও সচেতনতা সৃষ্টি করা। আল্লাহ বলেন,তোমরা সত্যের ওপর দাঁড়াও, মিথ্যা থেকে দূরে থাকো। (সুরা আলে ইমরান, ১০৩) ইসরায়েলি পণ্য বর্জন করা, জালিমদের অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করতে তাদের পণ্য বর্জন একটি কার্যকর উপায়। এটি কুরআন ও সুন্নাহর আদর্শ অনুযায়ী। কুরআনের নির্দেশনা,তোমরা সত্যের পক্ষে থাকো, মিথ্যা ও অন্যায়ের পক্ষে কোনোভাবেই সহায়তা করো না। (সুরা নিসা: ১৩৫) ফিলিস্তিনের প্রতি আমাদের এই দায়িত্ব পূরণই ইসলামের শিক্ষা ও মানবতার প্রতি আমাদের অবদান। ফিলিস্তিন আমাদের কাছে শুধুমাত্র একটি ভূখণ্ড নয়, এটি আমাদের ঈমানের অংশ। এখানেই রয়েছে আল-আকসা মসজিদ, যা ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান। কুরআনের নির্দেশনা,পরম পবিত্র সেই সত্তা, যিনি তার বান্দাকে রাত্রিতে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ করিয়েছিলেন। (সুরা ইসরা, ১) ফিলিস্তিন শুধু একটি রাষ্ট্রের নাম নয়, এটি আজ আমাদের ঈমানের একটি অংশ। সেখানে আজ প্রতিটি ঘরে লাশ, প্রতিটি হৃদয়ে বিষাদ, আর প্রতিটি কোণে রক্তের স্রোত। এই কান্না, এই আর্তনাদ আমাদের কানে বাজলেও আমরা যদি নীরব থাকি, তবে আমাদের ঈমানের কোথায় স্থান? আজ যদি আমরা ফিলিস্তিনের কান্না শুনেও নির্বিকার থাকি, তবে আল্লাহর কাছে আমাদের কী জবাব থাকবে? রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোন মুমিনের দুঃখ-কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার দুঃখ-কষ্ট দূর করবেন।’ (মুসলিম, ২৬৯৯)
ফিলিস্তিনের মুক্তি আমাদের ঈমানের দাবিকে পূর্ণতা দেয়। নির্যাতিত মুসলমানদের পাশে দাঁড়ানো কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী ফরজ দায়িত্ব। তাই, আমাদের দোয়া, সহায়তা, ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে তাদের মুক্তির পথে এগিয়ে যেতে হবে।আল্লাহ আমাদের ফিলিস্তিনের এই নিপীড়িত জনগণের পাশে দাঁড়ানোর তাওফিক দান করুন।