খিলগাঁওয়ে গ্যারেজপট্টির আগুনের উৎস নিয়ে রহস্য, ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ‘অর্ধশত’ কোটি


15Feb Naeem/khilgaon-dw.jpg

৩০ বছর আগে রাজধানীর শাহজাহানপুরে হাকিম অটোমোবাইলস নামে গাড়ি মেরামতের একটি ওয়ার্কশপ খুলেছিলেন আব্দুল হাকিম। ১০ বছর পর প্রতিষ্ঠানটি সেখান থেকে স্থানান্তর করে নিয়ে আসেন খিলগাঁওয়ের তালতলা মার্কেট এলাকায়। টানা লেগে থাকার কারণে ব্যবসায় আলোর মুখ দেখেছিলেন তিনি। ৩ বছর আগে হঠাৎ মারা যান তিনি। তখন অর্ধশত কর্মচারী ও প্রতিষ্ঠানটি চালু রাখা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় তার পরিবারের সদস্যরা।

 হাল না ছেড়ে প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব নেন তার স্ত্রী শিরিনা বেগম ও মেয়ে শারমিন আক্তার শিখা। কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে শত বাধা পেরিয়ে স্বামীর প্রতিষ্ঠানটি সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন শিরিনা। দীর্ঘদিনের পরিশ্রমে গড়া প্রতিষ্ঠানটি আকস্মিক অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) রাত সাড়ে ৭টার দিকে রাজধানীর খিলগাঁও তালতলা এলাকার গ্যারেজপট্টিতে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটে। পরে ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিটের চেষ্টায় রাত ৯টা ৩৫ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

এতে শুধু হাকিম অটোমোবাইলসই নয়, পুড়ে গেছে আরও ১৭ থেকে ১৮টি গ্যারেজ। অগ্নিকাণ্ডে ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে অনুমান ক্ষতিগ্রস্ত গ্যারেজ মালিক সমিতির। একই সঙ্গে শুক্রবার বন্ধের দিন ও গ্যারেজ মালিক সমিতির পিকনিক থাকায় এ অগ্নিকাণ্ডকে সন্দেহের চোখে দেখছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।

ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, বাংলাদেশ গ্যারেজ মালিক সমিতির পিকনিক আয়োজনের জন্য ৬ মাস আগে এই দিনটিতে নির্ধারণ করা ছিল। এদিন সারাদেশ থেকে আসা গ্যারেজ মালিক এবং শ্রমিকরা পিকনিকে গাজীপুরে ছিলেন। কেউ গ্যারেজে না থাকায় এবং চারদিক থেকে আগুন লাগায় এ অগ্নিকাণ্ডকে সন্দেহের চোখে দেখছেন তারা।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা জানান, গ্যারেজগুলোতে অক্সিজেনের সিলিন্ডার ছিল। আবার গাড়িতে থাকা গ্যাস সিলিন্ডারও ছিল। আগুনে সেগুলো বিস্ফোরিত হয়েছে বলে তাদের ধারণা।

শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে সরেজমিনে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে গেলে দেখা যায়, চারদিকে বিভিন্ন ধরনের পোড়া গাড়ি পড়ে আছে। দোকানের পোড়া টিন আর বিভিন্ন প্রকারের যন্ত্রাংশ জায়গায় জায়গায় পড়ে আছে। এছাড়া গ্যারেজের পাশে থাকা একটি স’ মিল ও সেখানে থাকা বেশ কিছু কাঠ পুড়ে গেছে আগুনে। আগুন থেকে বাঁচতে পারেনি আশেপাশের গাছপালাও। একের পর এক সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আগুনের স্ফূলিঙ্গ অনেক উপরেও উঠে যায়।

অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রায় ৩০০ কর্মচারী কাজ করতো। দীর্ঘদিন ধরে গ্যারেজগুলোতে কাজ করা কর্মচারীরা এখন বেকার হয়ে পড়েছেন। পোড়া গ্যারেজের সামনে গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখা গেছে তাদের কয়েকজনকে। কম বয়সী কিছু গ্যারেজশ্রমিককেও দেখা গেছে। আলিফ, হানিফ, সজল, রাতুল ও রোমান নামে এ শ্রমিকদের সবার বয়সই ১২ থেকে ১৪ বছর। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে এখানে কাজে এসেছেন তারা। অভাবের সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে অল্প টাকা বেতনে চাকরি করতো তারা। আগুন তাদের স্বপ্নকেও পুড়িয়ে দিয়েছে।

হাকিম অটোমোবাইলসের স্বত্বাধিকারী শারমিন আক্তার শিখা বলেন, আমাদের এই ব্যবসা ৩০ বছরের। আজ আগুন আমাদের সব নিয়ে গেলো। আমরা পথে বসে গেছি। আমাদের গ্যারেজে যে কয়টি গাড়ি ছিল সব মিলিয়ে প্রায় তিন কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কর্মচারীদের বেতন দেবো বলে গতকাল (বৃহস্পতিবার) তিন লাখ টাকা নগদ রেখেছিলাম ক্যাশে। সব ছাই হয়ে গেছে। তিনি বলেন, কীভাবে এত বড় আগুন লাগলো কিছুই বুঝতেছি না। আর সমিতির পিকনিকের দিনেই কেন হবে এ ঘটনা। আমরা মনে করি, এটা পরিকল্পিত। আমরা চাই প্রশাসন যেন তদন্ত করে এর রহস্য বের করে আনে।

বাংলাদেশ অটোমোবাইল মালিক সমিতির সভাপতি (অঞ্চলভিত্তিক) ও মাসুম অটো ওয়ার্কশপের মালিক মো. মাসুম বলেন, ছয় মাস আগে আমাদের পিকনিকের একটা পরিকল্পনা করা হয়। গতকাল এই মার্কেটের এবং সারা বাংলাদেশের যত ওয়ার্কশপ মালিক সমিতি আছে সবাই পিকনিকে ছিলাম। কেউই এখানে ছিল না। প্রতিটা ওয়ার্কশপ বন্ধ ছিল। আমরা সকালে এখান থেকেই গাড়ি নিয়ে পিকনিকে চলে গেছি। সন্ধ্যা ৭টার দিকে গ্যারেজে আগুন লাগার খবর পাই। পরে আমরা সবাই সেখান থেকে দ্রুত যে যার মতো চলে এসেছি। এসে দেখি সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, কিছুই অবশিষ্ট পাইনি।

তিনি বলেন, আমরা গত ২০ বছর যাবত এখানে ব্যবসা করছি। বিভিন্ন সময়ে আমাদের মার্কেট বন্ধ থাকে। কিন্তু তখন কেউ না কেউ এখানে থাকতো। কোনোদিন সমস্যা হয়নি। কিন্তু কাল কেউ ছিল না, ঠিক এদিনটাতেই আগুন লাগলো। তিনি বলেন, এক পাশে প্রথম আগুন লাগে। সেই আগুন এত দ্রুত অন্য পাশে চলে আসাটা আশ্চর্যজনক লাগছে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে সব পুড়ে গেছে। আমাদের সন্দেহ হচ্ছে।

বাংলাদেশ অটোমোবাইল মালিক সমিতির মতিঝিল আঞ্চলিক থানা সভাপতি মো. মুজিবুর রহমান বলেন, এখন পর্যন্ত আমরা জানতে পারিনি যে কোথা থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটছে। এই ওয়ার্কশপ পল্লীর ১৭টা প্রতিষ্ঠান পুড়ে ছাই হয়েছে। সরকার যদি এই অসহায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোর দিকে না তাকায় তাহলে জীবনেও তারা উঠে দাঁড়াতে পারবে না। 

এ প্রসঙ্গে খিলগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. দাউদ হোসেন বলেন, গতকালের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে একটি জিডি করা হয়েছে। অগ্নিকাণ্ড কীভাবে হয়েছে, পরিকল্পিত না দুর্ঘটনা সেটি তদন্তের বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের বাইরে আমরা কোনও কিছু বলতে পারবো না।

রাসায়নিকে ড্রাম বিস্ফোরণের কারণে রাজধানীর খিলগাঁওয়ে একটি স’ মিলে লাগা আগুন চারদিক ছড়িয়ে পড়ে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। আগুনের উৎস নিয়ে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেনেন্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন,  তদন্ত ছাড়া এই মুহূর্তে এ বিষয়ে কিছু বলা যাবে না। সিগারেটের মাধ্যমে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে নাকি সাবোটেজ হয়েছে এই প্রত্যেকটা বিষয়ে আমাদেরকে বিচার করে দেখতে হবে। অনেকগুলো সোর্স থেকে আগুনের সৃষ্টি হতে পারে। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকেও আগুনের সূত্রপাত হতে পারে।

ঢাকাওয়াচ২৪ এর খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন ।
ঢাকাওয়াচ২৪ডটকমে লিখতে পারেন আপনিও ফিচার, তথ্যপ্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, ভ্রমণ ও কৃষি বিষয়ে। আপনার তোলা ছবিও পাঠাতে পারেন dhakawatch24@gmail.com ঠিকানায়।
×