নির্বাচন নিয়ে যা করা উচিত ইউনূস সরকারের
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- প্রকাশঃ ০৪:৩৬ পিএম, ১৭ নভেম্বর ২০২৪
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে গত আগস্টে ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়ে দেশ ছাড়েন স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা। এরপর দেশের নেতৃত্বে আসেন ক্ষুদ্রঋণের প্রবক্তা ও শান্তিতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
পুলিশকে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি ও খুনের নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। প্রাক্তন এই প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে যাওয়ার পর পর্যায়ক্রমে অধিকাংশ পুলিশই তাদের দায়িত্বে ফিরেছেন। এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনীতি, রাষ্ট্রব্যবস্থা, নির্বাচনের মত ইস্যু নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সাময়ীকি দ্য ইকনোমিস্ট।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন আর অবাধ পতনের মুখে নেই। জাতীয় প্রবৃদ্ধির শতকরা পাঁচ ভাগই রেমিট্যান্স। তা সত্ত্বেও সামনে বিশাল চ্যালেঞ্জ ইউনূসের সরকারের। এসব চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবিলা করা হবে তা শুধু ১৭ কোটি ৩০ লাখ জনসংখ্যার মানুষের ওপরই প্রভাব ফেলবে এমন নয়। একই সাথে প্রতিবেশী দেশগুলোও প্রভাবিত হবে। এমনকি ভারত, চীন ও পশ্চিমাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ও এর প্রভাব পড়বে।
ইউনূস এমন একটি সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যার কোন আইনগত ভিত্তি নেই। অন্তর্বর্তী সরকারকে অনুমোদন করে এমন একটি সাংবিধানিক ধারাকে ২০১১ সালে বাতিল করে দেন শেখ হাসিনা। সুতরাং, ইউনূসের বৈধতা নির্ভর করে তার নৈতিক কর্তৃত্ব ও জনপ্রিয়তার ওপর। কারণ, কোন ভোটের মাধ্যমে এর সমর্থন আদায় করা হয়নি। অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকা সত্ত্বেও অক্টোবরের হিসেবে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি হয়েছে শতকরা প্রায় ১৩ ভাগ। বাংলাদেশে বিদ্যুতের শতকরা প্রায় দশ ভাগ সরবরাহ দেয় ভারতের কোম্পানি আদানি গ্রুপ। বকেয়া পাওনার কথা উল্লেখ করে সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া শুরু করেছে কোম্পানিটি।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘ইউনূস জ্ঞানী ব্যক্তি হলেও সরকার পরিচালনার অভিজ্ঞতা নেই তার। দুই পক্ষের চাপে নাজেহাল ইউনূস। এক দিকে যেসব ছাত্র আন্দোলনকারী তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছে, তারাই তার কাছে ক্রমবর্ধমান আকারে চরম সব দাবি তুলে ধরছেন। এর মধ্যে শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি আছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচার করার জন্য ভারতের কাছে শেখ হাসিনাকে ফেরত চাইছে। অপর দিকে, আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি। ইউনূসের কাছে দ্রুত নির্বাচন দাবি করছে দলটি, যতটা সম্ভব আগামী জুনে। আর এই দাবি পূরণ না হলে গণআন্দোলন করতে পারে বিএনপি।
আওয়ামী লীগের প্রতি কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইউনূসের মোটামুটি সহনশীলতা দেখে হতাশ আন্দোলনকারীরা। তারা ফের রাজপথকে বেছে নিতে পারে। আর এই আন্দোলনে সহিংসতার আশঙ্কা আছে। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ইতিহাস আছে যে দেশে, সেখানে এ ব্যাপারটি ভয়াবহ দুশ্চিন্তার। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা আট ভাগ হিন্দু সম্প্রদায়ের। তাদের অনেকে আওয়ামী লীগের সমর্থক। এরই মধ্যে তাদের ওপর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠরা হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ উঠছে।
আরো একটি উদ্বেগ হল, ভয়ানক নাজুক বিচার ব্যবস্থাকে সংস্কার করার জন্য যে সময় প্রয়োজন, তা করার প্রয়োজনীয় সময়ের পূর্বেই বিএনপির দাবির কাছে ইউনূসকে আত্মসমর্পণ করতে হতে পারে। একইসাথে নিশ্চিত করতে হবে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। বিএনপি যদি একটি ত্রুটিপূর্ণ ও তড়িৎ নির্বাচনে জয়ী হতে পারে তাহলে এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সেই অতীতের বাজে ধারার ক্ষমতাকাঠামো ফিরতে পারে। দুর্নীতিবাজ ও প্রভাবশালীদের মধ্যেই ক্ষমতার পালাবদল হতে পারে।
করণীয় কী? এখন তবে ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের কী করা উচিত? ইকনোমিস্টের মতে, পৃথিবী যখন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, তখন বাংলাদেশ যে কোন সরকারের খুব কমই অগ্রাধিকার। যেখানে বাংলাদেশ একটি রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে আর্থিক সংকট এড়ানোর চেষ্টা করছে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এক দশমিক দুই বিলিয়ন সহায়তা প্যাকেজ, আইএমএফের কাছ থেকে বেইল-আউট হিসেবে চার দশমিক সাত বিলিয়ন ডলারের প্যাকেজ পেয়েছে। কিন্তু, বাংলাদেশের প্রয়োজন হবে আরও বহু বেশি। শেখ হাসিনার শাসনামলে বিদেশে পাচার হওয়া প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলারের কিছুটা উদ্ধারে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সহায়তা করছে যুক্তরাষ্ট্রেওর সরকার। যদি বাংলাদেশকে সহায়তায় পশ্চিমা ঋণদাতারা ও ভারত ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে চীনের কাছে ঋণী হয়ে উঠতে পারে দেশ।
তাই, ইউনূসের জন্য এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে নির্বাচনে মনোযোগী হওয়া। ক্ষমতার তিন মাস পর এখন নির্বাচনের একটি টাইমটেবিল ঘোষণা করা উচিত। সেটি হতে পারে এক বছর কিংবা এর কাছাকাছি সময়ে। আইন ও নির্বাচন বিষয়ক সংস্কারের জন্য এ সময় নেওয়া গণতন্ত্রকে কীভাবে সমৃদ্ধ করবে এবং কেন সময় প্রয়োজন, তা আরো ভালভাবে ব্যাখ্যা দিতে হবে তাকে।
ইউনূস দেশের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ায় বহু মানুষ উল্লাস করেছে। কিন্তু, কীভাবে তিনি দেশ পরিচালনা করবেন ও ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন, তার একটি পরিষ্কার পরিকল্পনা জানানো উচিত। এই দুই ব্যাপারে অনেক দেরি হলে ছাত্র-জনতার বিপ্লব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে।