
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কমিশন জানিয়েছে, নির্বাচনী নিরাপত্তা থেকে শুরু করে প্রযুক্তি ব্যবহার, গুজব প্রতিরোধ এবং সশস্ত্র বাহিনীর সমন্বয়; সব ক্ষেত্রেই এবার থাকবে কঠোর তদারকি ও পরিকল্পিত পদক্ষেপ।
গত ২০ অক্টোবর নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও প্রস্তুতিমূলক সভায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, “নির্বাচন পরিচালনা একটি সাংবিধানিক দায়িত্ব। অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য সবার সম্মিলিত সহযোগিতা অপরিহার্য।”
রোববার (৯ নভেম্বর) কমিশনের উপসচিব মো. মনির হোসেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভার কার্যবিবরণীতে এসব তথ্য তুলে ধরেন। সিইসি জানান, আগামী জাতীয় নির্বাচন দেশের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
একদিনে সারাদেশে এ বিশাল কর্মযজ্ঞ সফল করতে সমন্বিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য জানিয়ে তিনি বলেন, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংখ্যা নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো তারা কতটা পেশাদারিত্ব ও আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। নির্বাচনী এলাকায় নিরাপত্তা জোরদারে কমিশন রেড, ইয়েলো ও গ্রিন জোনে ভাগ করে নিরাপত্তা পরিকল্পনা তৈরি করবে।
তিনি আরও বলেন, “স্টেট অ্যাসেসমেন্ট করে ডেপ্লয়মেন্ট প্ল্যান করতে হবে। অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।”
সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি জানান, নির্বাচনের আগে ও পরে মোট আট দিন সারা দেশে সেনা মোতায়েনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ৬২টি জেলায় সেনাবাহিনী থাকবে, প্রয়োজন অনুযায়ী আর্মি এভিয়েশন ও কমান্ডো ইউনিট প্রস্তুত থাকবে। এছাড়া ৯০ হাজার থেকে এক লাখ সেনা সদস্য নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত হতে পারেন।
তিনি আরও জানান, “বিদেশি সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকদের নিরাপত্তায় বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাগুলোতেও বিশেষ নজর থাকবে। সেনাবাহিনী নির্বাচনী মালামাল পরিবহনের জন্য হেলিপ্যাড প্রস্তুত রাখবে এবং ড্রোন ব্যবহারের অনুমতি চেয়েছে। সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা।
সশস্ত্রবাহিনী বিভাগ জানায়, তারা নির্বাচনে সেনা ও নৌবাহিনীর মোতায়েন সমন্বয় করবে। নৌবাহিনীর প্রতিনিধি জানান, উপকূলীয় ১১টি আসনে পরিবহন সমস্যা থাকায় নৌবাহিনীর নিজস্ব ও বেসরকারি জলযান ব্যবহার করা হতে পারে।
আনসার ও ভিডিপি মহাপরিচালক বলেন, “গতবারের নির্বাচনের চেয়ে এবারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এবার অভিজ্ঞ সদস্যদের বাছাই করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে ১ লাখ ৫৫ হাজার নতুন সদস্য নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। আনসার সদস্যদের জন্য কিউআর কোডযুক্ত পরিচয়পত্র চালুর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আট দিনের জন্য আনসার মোতায়েন করা হতে পারে এবং তাদের ভাতা অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেওয়া হবে।
বিমানবাহিনী প্রধান জানান, সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় রেখে পরিবহন বিমান প্রস্তুত থাকবে। স্বরাষ্ট্র সচিব ভোটকেন্দ্রে বডিওর্ন ক্যামেরা স্থাপন ও আশপাশের দোকানেও রেকর্ডিং ব্যবস্থার প্রস্তাব দেন।
আইজিপি জানান, “নির্বাচনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করবে। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রস্তুতি শেষ হবে। এনটিএমসি নির্বাচনী গুজব প্রতিরোধে বিশেষ অ্যাপ তৈরির প্রস্তাব দিয়েছে। কোস্টগার্ডও ১৭টি উপকূলীয় উপজেলায় প্রশিক্ষণ ও মোতায়েন পরিকল্পনা নিয়েছে।
ডিজিএফআই জানায়, মাঠপর্যায়ের গোয়েন্দা তথ্য দ্রুত কমিশনে পাঠানো হবে। গুজব মোকাবিলায় দ্রুত তথ্য সরবরাহ ও সাংবাদিকদের জন্য ‘মিডিয়া পলিসি’ প্রণয়নের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বিজিবি জানায়, ৪৯২টি উপজেলায় ১১ হাজার ৬০ প্লাটুন মোতায়েন করা সম্ভব। সীমান্তে সেনাবাহিনী ও বিজিবির দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হবে।
এনএসআই জানায়, ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র চিহ্নিত করে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে এবং কমিশনের সঙ্গে তথ্য বিনিময় জোরদার করা হবে।
র্যাব, সিআইডি ও এসবির পরিকল্পনা
র্যাব জানায়, নির্বাচনে ৫ হাজার ৫০০ সদস্য মোতায়েন থাকবে। সিআইডি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ও ভুয়া কনটেন্ট শনাক্তে কাজ করছে। এসবি ইতোমধ্যে ৮ হাজারের বেশি উচ্চঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্র চিহ্নিত করেছে।
নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, “সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হবে। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে কোনো বাধা থাকবে না।”
কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, বাহিনী প্রধানদের লিখিত মতামত নিয়ে কমিশন কাজ করবে এবং কোনো নির্দেশনা গোপনে দেওয়া হবে না।
কমিশনার বেগম তাহমিদা আহমদ বলেন, “সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে আস্থার জায়গায় ফিরিয়ে আনতে হবে।”
শেষে কমিশনার আব্দুর রহমান মাছউদ বলেন, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা যেন নিজেকে কমিশনের অংশ হিসেবে মনে করে কাজ করেন। নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্বই হবে সবচেয়ে বড় শক্তি। নির্বাচন হবে নির্ধারিত সময়ে, কঠোর নিরাপত্তা ও সর্বোচ্চ সমন্বয়ের মাধ্যমে। অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোট আয়োজনেই এখন তাদের প্রধান লক্ষ্য।