জুলাই শ্রেণি সংগ্রামে মওলানা ভাসানী
- নিউজ ডেস্ক
- প্রকাশঃ ১০:৩৩ পিএম, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪
উপমহাদেশের নানা ঘটনা প্রবাহের বাঁক বদলের ইতিহাসে বারবার আলোচনায় এসেছেন যেকজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন মানুষ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। মওলানা ভাসানী ছিলেন শ্রেণি বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। আমাদের শ্রেণি সংগ্রামের আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
কিন্তু দুঃখজনক এই যে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে সব থেকে উপেক্ষার শিকার হয়েছেন সেই তিনিই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যাদের অগ্রগণ্য ভূমিকা ছিল, যাঁরা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহযোদ্ধা তাঁদের প্রত্যেককেই স্বার্থান্বেষী কায়েমি রাজনৈতিক শক্তি ইতিহাস থেকে দূরে সরে রেখেছে বারবার। বিশেষত একাত্তর পরবর্তী জিয়াউর রহমান, মুহাম্মদ এরশাদ, বেগম খালেদা থেকে শেখ হাসিনা পর্যন্ত যে কটি সরকার গঠিত হয়েছে, তাদের সবার হাতেই আমাদের জাতীয় ইতিহাস কুক্ষিগত হয়েছে, কাটছাঁট করা হয়েছে আমাদের জাতীয়তার ভিত্তিপুরুষদের অবদানকে। এর প্রধানভাগজুড়েই ইতিহাসের আড়ালে ফেলে দেওয়া হয়েছিল মওলানা ভাসানীকে।
সব শাসকই নিজেদের রাজনৈতিক তত্ত্ব ও বয়ান নির্মাণ করতে গিয়ে ‘থোড় বড়ি খাড়া/খাড়া বড়ি থোড়’ টাইপের রাজনৈতিক দর্শনের বিকাশ ঘটিয়েছে। একাত্তর কেন্দ্রিক তাদের রাজনৈতিক অর্জনের বায়াসটা বহুমুখী না হয়ে একমুখী হয়ে উঠেছিল। যেখানে আমরা সব মানি, কিন্তু ‘তালগাছটা আমারই’ প্রতিপাদ্যের ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এর মধ্যে আমাদের ইতিহাস পাঠে প্রজন্মকে মওলানা ভাসানী থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও বিএনপি জেনারেল জিয়াউর রহমানকে অতিরঞ্জিতভাবে মহিমান্বিত করতে গিয়ে আমাদের ইতিহাসের অনেক প্রবাদপ্রতিম মানুষকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। যার ফলে আমরা পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস পাঠ থেকে বঞ্চিত থেকেছি এবং খণ্ডিত ইতিহাস পাঠ করে হয়ে উঠেছি ইতিহাস মূর্খ। আমাদের মূর্খামিতা আমাদেরকে অসহিষ্ণু এবং কায়েমি সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির দিকে ঠেলে দিয়েছে।
তারপরও বারবার স্বমহিমায় উজ্জ্বল তারকার মতো ইতিহাসের কাঠগড়ায় হাজির হয়েছেন শ্রেণি সংগ্রামের মহানায়ক মওলানা ভাসানী। ভাসানীর জীবন সংগ্রামের পুরোভাগজুড়েই বাংলার খেটে খাওয়া মানুষেরা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল। আমাদের তথাকথিত সভ্য সমাজে যারা নিম্ন শ্রেণির মানুষ বলে আখ্যায়িত, বিশেষত কৃষক শ্রমিক ক্ষেতমজুর রিকশা চালক কামার কুমার জেলে তাঁতি মুদি দোকানীসহ নান শ্রেণি পেশার মানুষ তারাই ছিলেন মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক লড়াইয়ের বড় শক্তি। রাজনৈতিক শহুরে কেন্দ্র থেকে দূরে থাকা এসব মানুষের মাঝেই তিনি সময় অতিবাহিত করেছেন এবং খেটে খাওয়া মানুষের মাঝে রাজনৈতিক চিন্তাবোধের বিকাশ ঘটিয়েছেন ক্রমাগত।
তাঁর রাজনৈতিক জীবনে পুঁজিপতিরা কখনোই মিত্র হয়ে ওঠেনি কিংবা তাঁর সখ্যতাও তাদের সঙ্গে ছিল না। তাঁর সকল সম্পর্কের কেন্দ্রই ছিল এইসব গ্রামীণ হারজিরজিরে নিরন্ন মানুষেরা। তিনি তাদের কাছেই হয়ে উঠেছিলেন একাধারে অবিসংবাদিত রাজনৈতিক নেতা অন্যদিকে বাংলার সহজীয়া ধারার আলেম, পীর। মানুষ তাঁকে নেতা ও পীর জ্ঞান করত এবং তাঁর জীবন যাপনে আকৃষ্ট হয়ে তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের দীক্ষা গ্রহণ করত। এটা ছিল শ্রেণি সংগ্রামে মওলানা ভাসানীর সবচেয়ে বড় অর্জন। মানুষের আস্থা অর্জন এবং তা বহাল রেখে রাজনৈতিক কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের। এক্ষেত্রে মওলানা ভাসানী আমাদের জন্য রোল মডেল। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ মাত্রই এজন্য পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে ভাসানীতেই তাড়িত।
আমরা যদি এই জুলাই আন্দোলনের কথা বলি, তবে ভাসানীর কথা আগে বলতে হয়। এই আন্দোলনে ভাসানীর উত্তরসূরীরাই অগ্রগণ্য ভূমিকা রেখেছে এবং এই আন্দোলনকে সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। এই আন্দোলনে সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল একদম সাধারণ ঘরের শিক্ষার্থী, যাদের বংশ বা পরিবার পরম্পরায় কোনো দলীয় রাজনীতি সম্পৃক্ততা নেই, নেই রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ বা উচ্চাকাঙ্ক্ষা। এই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বড় শক্তি ছিল পেটের দায়ে গ্রাম থেকে ছুটে আসা শহুরে রিকশা চালক, পরিবহন শ্রমিক, ফুটপাতের নিরন্ন দোকানি, বাদাম বিক্রেতা, গ্রাম থেকে উঠে আসা সদ্য শহুরে মধ্যবিত্ত এবং কেরানি টাইপ কতিপয় চাকুরে। মোটাদাগে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে এরাই ছিল আমাদের সব চেয়ে বড় শক্তি। এই শক্তিকে কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দল মাঠে নামাতে পারেনি, তারা নেমেছে অগোচরে বেড়ে ওঠা তাদের শ্রেণি সংগ্রামের চেতনাগত বিবেক ও বোধের তাড়না থেকে।
এসব মানুষের ভেতর পূর্ব পুরুষদের শ্রেণি সংগ্রামের মৌখিক বয়ান তাদের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে দৈনন্দিন নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়েই। এই শ্রেণি চেতনা মওলানা ভাসানীর চেতনারই ধারাবাহিকতা। মজলুম এই জননেতা মওলানা ভাসানী ব্রিটিশ শাসনের অধীন বাংলা ও আসাম প্রদেশে ১৯২৭-এর দশকে জমিদার-মহারাজা বিরোধী কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার মাধ্যমে নিজের সংগ্রামী জীবনের যাত্রা শুরু করেছিলেন। এই সংগ্রাম বৃটিশ ও বৃটিশ পূর্ব থেকে- রাজা শিবচন্দ্র রায় ও দেবি চৌধুরাণীদের কৃষক প্রজা বিদ্রোহ, নূরুল দ্বীন ও আদিবাসী কানুদের সংগ্রাম থেকে, ইলা মিত্রদের তেভাগা আন্দোলন থেকে, কমরেড মণি সিংহ ও কুমুদিনী হাজংদের টংক আন্দোলনসহ ছোট বড় নানা রকম আন্দোলন সংগ্রাম থেকে উৎসারিত চেতনা। ধাপে ধাপে তা আমাদের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির রক্তে রন্ধ্রে সঞ্চারিত হয়ে আসছে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ এবং আমাদের তথাকথিত রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কাঁদা ছোড়াছুড়ির সংস্কৃতির মধ্যে থেকেই রাজনৈতিক সংস্কৃতির উপাদানগুলো সাধারণ মানুষ ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে নিজেদের মাঝে তুলে নিয়েছে। যার ফলে শাসনের নামে যখনই শোসনের খড়গটা তিব্র হয়েছে তখনই জন বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে সাধারণ জনতা। এই সংগ্রামী জীবনবৃত্তে আপনাআপনি ভাসানী দর্শন মূর্ত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতার বিস্ফোরণ আমরা জুলাই আগস্টে দেখেছি।
মানুষের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে যখন প্রতারণা করা হয় তখনই কিন্তু আমাদের অগোচরেই শ্রেণি শোষণের চিত্র সুস্পষ্ট হয় এবং শ্রেণি সংগ্রাম বিপ্লব বা লড়াইয়ে গড়ায়। মওলানা ভাসানী তাঁর এক বক্তৃতায় বলেছিলেন ‘বহু রক্তের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা এসেছে। কোন ব্যক্তিবিশেষ, কোন বিশেষ দল দেশ স্বাধীন করেনি। এই দেশের কামার, কুমার, শ্রমিক, চাষি, জেলে, মধ্যবিত্ত, ছাত্র, যুবক বুকের রক্ত দিয়া বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছে। লক্ষ মানুষের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতাকে কোন বিশেষ দল কোন ব্যক্তিবিশেষের সম্পত্তিতে পরিণত করা যাবে না। গণতন্ত্রের নাম নিয়া গণতন্ত্রের টুটি টিপে ধরা চলবে না। অপরাধী যারা তাদের বিচার করে শাস্তি দাও। কিন্তু বাঙ্গালির নামে বিনা বিচারে কাউকে আটক করে রাখা যাবে না। কোন প্রকার জুলুমকে বাংলার মানুষ বরদাস্ত করবে না। তোমরা যদি ক্ষমতার অহংকারে বাংলার মজলুম মানুষের দাবীকে অস্বীকার করতে চাও, তবে মনে রেখো ঝড় আসছে। যে ঝড় আসছে সে ঝড় বিপ্লবের ঝড়। এই দুর্যোগ বিপ্লবের নমুনা, ‘এই দুর্যোগ আল্লাহর রহমত’।
মওলানা ভাসানীর এই কথাগুলো আমাদের জাতীয় জীবনে বারবার সত্য হয়ে ফিরে এসেছে। পঁচাত্তর পরবর্তী সময় থেকে আজ অদ্যাবধি এই কথাগুলো চরম সত্য হিসেবেই প্রমাণিত। আমরা নব্বইয়ের এরশাদের বিরুদ্ধে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন দেখেছি, বিএনপির অপশাসনে বিরুদ্ধে আন্দোলন দেখেছি, সর্বশেষ আমরা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সাক্ষ্য হলাম। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এসব ঘটনার মূল কারণ কিন্তু মানুষের অবমূল্যায়ন, অগণতান্ত্রিকতা এবং শ্রেণি শোষণ। যা মওলানা ভাসানী বারবার বলে গিয়েছেন এবং রাজনৈতিক নেতাদের সতর্ক করে দিয়েছেন। তারপরও তারা এর থেকে কোনো শিক্ষা নেয়নি। ফলে বারবার আমাদের জীবন দিতে হয়েছে, রাজপথে রক্ত ঢালতে হয়েছে। এর মধ্য দিয়েই এখানে মওলানা ভাসানী পুনর্বার ফিরে আসছেন মুক্তির বারতা নিয়ে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানেও তিনি ছিলেন আমাদের অদৃশ্য শক্তি ও প্রতিবাদী মানসকাঠামোর কেন্দ্রবিন্দু। যে জন্য আমরা নতুন প্রজন্মের দেয়াল চিত্র ও গ্রাফিতির মধ্য দিয়েই মওলানা ভাসানীকে চিত্রায়িত হতে দেখেছি অসাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষায়।
লেখক: কবি ও সমাজচিন্তক।