সাম্প্রদায়িক প্রোপাগান্ডা চালানো অ্যাকাউন্টের ৭২ শতাংশই ভারতীয়
- নিউজ ডেস্ক
- প্রকাশঃ ০৭:০৯ পিএম, ১৮ আগস্ট ২০২৪
ঢাকা: শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু সংখ্যালঘু সংক্রান্ত সহিংসতাও হয়েছে।
হয়েছে বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুরও। তবে এ সহিংসতার খবরকে প্রচারের ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত রকমের সাম্প্রদায়িক রঙ মাখিয়ে ভয়াবহ প্রোপাগান্ডা চলছে। ভারতের মূলধারার কিছু গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা যেন প্রোপাগান্ডার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছেন।
ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানার বলছে, গত এক সপ্তাহ পর্যবেক্ষণ করে এক্সে (সাবেক টুইটার) ৫০টি অ্যাকাউন্ট খুঁজে বের করা হয়েছে, যেগুলোতে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির বিভিন্ন ছবি, ভিডিও এবং তথ্যকে সাম্প্রদায়িক রূপ দিয়ে প্রচার করা হচ্ছে। ভুয়া এবং অপতথ্য ছড়ানো এসব অ্যাকাউন্টধারীর ৭২ শতাংশই ভারতে থাকেন বলে উল্লেখ করেছেন। অ্যাকাউন্টধারীদের মধ্যে দায়িত্বশীল অনেক ব্যক্তিও রয়েছেন। এমনকি ভারতের একাধিক মূল ধারার গণমাধ্যমেও এসব ভুয়া তথ্য প্রচার করা হয়েছে।
শনিবার (১৭ আগস্ট) ‘বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতার পটপরিবর্তনকে কেন্দ্র করে এক্সে সাম্প্রদায়িক অপতথ্যের ভয়াবহতা’ শিরোনামে ওই প্রতিবেদনে জানানো হয়, উল্লিখিত অ্যাকাউন্টের প্রতিটির অন্তত একটি পোস্টে সাম্প্রদায়িক অপতথ্য ও ভুল তথ্য প্রচারের প্রমাণ পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার। এসব অ্যাকাউন্টে গত ৫ থেকে ১৩ আগস্টের মধ্যে প্রচারিত ওই পোস্টগুলো ১ কোটি ৫৪ লাখের বেশি বার দেখা হয়েছে।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, গত ৭ জুলাই বগুড়ায় জগন্নাথ দেবের রথযাত্রায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পাঁচজনের মৃত্যুর একটি ভিডিওকে সাম্প্রতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সাম্প্রদায়িক রূপ দিয়ে প্রচার করা হয়েছে। গত ৯ আগস্ট ভারতের ‘দীপক শর্মা’ নামে একটি এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে ওই ভিডিও পোস্ট করে দাবি করা হয়, ‘বাংলাদেশের হিন্দু নারী ও শিশুদের একটি ক্যাম্পে জিহাদিরা বোমা দিয়ে হামলা চালিয়ে শত শত নারীকে হত্যা করার দৃশ্য। ’
রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট যে ৫০টি অ্যাকাউন্টের একটি করে পোস্টকে এই গবেষণায় নমুনা হিসেবে গ্রহণ করেছে, তার মধ্যে ১৩টি পোস্টেই ভিন্ন ঘটনাকে এমন সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়া হয়েছে।
তবে সবচেয়ে বেশি ঘটেছে মুসলিম ব্যক্তিকে হিন্দু দাবিতে প্রচারের ঘটনা। নন্দিত অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধনকেও এক্ষেত্রে হিন্দু বলে প্রচার করা হয়েছে। ছাত্র আন্দোলনে বাঁধনের বক্তব্যের ভিডিওকে ‘বিক্রম প্রতাপ সিং’ নামে একটি এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে প্রচার করা হয়, ‘বাংলাদেশে হিন্দু নারীর কান্না করে বক্তৃতা দেওয়ার দৃশ্য’ শিরোনামে। বাঁধন নিজেই বিষয়টির প্রতিবাদ জানান। এমন আরও ১৭টি ঘটনার প্রমাণ পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট, যা ধরন অনুযায়ী সর্বোচ্চ (৩৬ শতাংশ)।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ভিন্ন ঘটনার পুরোনো ভিডিও, মুসলিমদের স্থাপনায় সাম্প্রতিক হামলাকে হিন্দুদের স্থাপনায় হামলা দাবি, ভিন্ন স্থাপনায় অগ্নিসংযোগের ঘটনাকে হিন্দুদের স্থাপনায় হামলার দাবি, রাজনৈতিক স্লোগানের বক্তব্যকে ভিন্ন দাবি, স্ক্রিনশট বিকৃতি, ভুয়া বক্তব্য, বিএনপির নামে ভুয়া টেলিগ্রাম অ্যাকাউন্টের বরাতে ভুল তথ্য এবং হিন্দু নিহতের সংখ্যা নিয়ে ভুয়া দাবির মাধ্যমে এসব অর্ধশতাধিক ভুয়া তথ্যের ব্যাপক প্রচার লক্ষ্য করেছে রিউমর স্ক্যানার।
ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠানটি বলছে, প্রচারিত পোস্টগুলোর ক্ষেত্রে ভুয়া তথ্যের প্রচারে ৮০ শতাংশ (৪০টি) ক্ষেত্রেই ব্যবহার হয়েছে ভিডিও ফুটেজ। এসব ভিডিও ফুটেজের মধ্যে ১৫টি ৫ আগস্টের পূর্বের ভিন্ন ঘটনার। বাকিগুলো সরকার পতন পরবর্তী সময়ে ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার হলেও এসব ফুটেজকে সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক ভুয়া তথ্যের প্রচারে ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া ১৬ শতাংশ ক্ষেত্রে ছবি ও স্ক্রিনশট এবং বাকি চার শতাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়েছে ছবি/ভিডিও বিহীন স্ট্যাটাস।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, বাংলাদেশ নিয়ে সাম্প্রদায়িক ভুল এবং অপতথ্য যে ৫০টি এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে প্রচার করা হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে ৩৬টি অ্যাকাউন্টেরই লোকেশন হিসেবে ভারতের নাম উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া লোকেশন হিসেবে হাঙ্গেরি, যুক্তরাজ্য, ফিনল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, কাতার, সুইডেন, সোমালিয়া, থাইল্যান্ড এবং বাংলাদেশ উল্লেখ রয়েছে একটি করে অ্যাকাউন্টে। এর বাইরে কোনো লোকেশনই উল্লেখ করেনি এমন অ্যাকাউন্টের সংখ্যা পাঁচটি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সম্প্রতি এক হিন্দু ব্যক্তি তার নিখোঁজ পুত্রের সন্ধান দাবিতে মানববন্ধন করছে এমন দৃশ্য দাবি করে একটি ভিডিও ভারতের মূলধারার অন্তত তিন গণমাধ্যম এশিয়ান নিউজ ইন্টারন্যাশনাল (ANI), এনডিটিভি, মিরর নাউ এর এক্স অ্যাকাউন্টে প্রচার করা হয়। তবে রিউমর স্ক্যানার যাচাই করে দেখেছে, ওই ব্যক্তি মুসলিম। বাবুল হাওলাদার নামে এই ব্যক্তি ২০১৩ সাল থেকে নিখোঁজ থাকা তার ছেলের সন্ধান দাবিতে এই মানববন্ধনে অংশ নিয়েছিলেন৷ সাম্প্রদায়িক অপতথ্যের এমন প্রচারে ভারতীয় আরও একাধিক গণমাধ্যম এবং গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার৷ এই তালিকায় আরও আছে জি নিউজ মধ্যপ্রদেশ এবং নিউজ টুয়েন্টিফোর নামে গণমাধ্যমের এক্স অ্যাকাউন্ট।
ভারতের পরিচিত গণমাধ্যম ‘অপিইন্ডিয়া’র প্রধান সম্পাদক নুপুর শর্মাকেও তার এক্স অ্যাকাউন্টে নিয়মিত বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির প্রেক্ষিতে সাম্প্রদায়িক অপতথ্য ছড়াতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট। ১১ আগস্ট প্রকাশিত তার একটি এক্স পোস্টকে ভুয়া তথ্য হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে জানানোর পর তিনি রিউমর স্ক্যানারের একজন টিম মেম্বারকে এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে ব্লক করেন৷
রিউমর স্ক্যানারের তথ্য মতে, সাম্প্রদায়িক গুজব প্রচারে ভারতের বাইরের বিভিন্ন দেশের একাধিক দায়িত্বশীল ব্যক্তিদেরও ভূমিকা থাকার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। ইরাকি বংশোদ্ভূত সালওয়ান মোমিকা একাধিকবার প্রকাশ্যে ইসলাম ধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ কোরআন পুড়িয়ে বিতর্ক ও সমালোচনার সৃষ্টি করেন, হয়েছেন গণমাধ্যমের শিরোনাম। এই ব্যক্তিকে তার এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে নিয়মিত বাংলাদেশকে জড়িয়ে সাম্প্রদায়িক অপতথ্য প্রচারের প্রমাণ মিলেছে। এছাড়া, পাকিস্তান জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক লেগ স্পিনার দানিশ কানেরিয়াকে তার এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে ক্রিকেটার লিটন দাসের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে দাবিতে একটি ভিডিও ফুটেজ শেয়ার করতে দেখা গেছে। আদতে এটি ছিল মাশরাফির বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ফুটেজ। লিটনের বাড়িতে কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি।
ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠানটি বলছে, এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে সাম্প্রদায়িক কোনো মৃত্যুর খবর বিশ্বস্ত সূত্রে পাওয়া যায়নি। তবে এটা সত্যি যে, সাম্প্রদায়িক হামলার বেশ কিছু ঘটনা দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটেছে।
ভারতের ফ্যাক্ট-চেকার অন্কিতা দেশকার সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে সাম্প্রদায়িক প্রচারের হার বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক ভুল তথ্য পোস্ট করার মাধ্যমে অ্যাকাউন্টগুলো তাদের ফলোয়ারদের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য সাড়া পেয়ে থাকে। অনেকেই তাই নিজেদের এনগেজমেন্ট বা রিটুইট সংখ্যা বাড়াতে এসব অপতথ্য এক্সে শেয়ার করছেন। ’
দেশটির আরেক ফ্যাক্ট-চেকার ইয়ুশা রহমান বলেন, এই অপতথ্যগুলো প্রচার করছে মূলত ধর্মীয় উগ্রবাদীরা। তাদের মাধ্যমে এসব অপপ্রচার বাড়ছে। তারা সাম্প্রদায়িক প্রচারকে মুসলিম বিরোধী আখ্যান প্রচারের উপায় হিসেবে দেখছে।