
জুলাই সনদের বাস্তবায়ন ও গণভোটের সময়সূচি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চলমান দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে এবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যেও ভিন্নমত প্রকাশিত হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উপস্থিত ২২ জন উপদেষ্টার প্রায় সবাই একই দিনে গণভোট এবং নির্বাচন করার পক্ষে মত ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু সোমবারের জরুরি বৈঠকে কয়েকজন উপদেষ্টা তাদের পূর্বের অবস্থান থেকে সরে যান।
অন্তত তিনজন উপদেষ্টা মত দিয়েছেন, নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা থাকলে জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজন সম্ভব। তারা প্রশ্ন তুলেছেন, “গণভোট না হলে সংস্কার কীভাবে বাস্তবায়ন হবে?” বিশেষ করে পিআর পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের বিষয়টি সমাধান করতে নির্বাচন শুরুর আগে গণভোট করা প্রয়োজন। তারা মনে করছেন, ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচন নিশ্চিত হওয়ার আগে গণভোটের আয়োজন সম্ভব কিনা তা যাচাই করা উচিত।
বৈঠক শেষে এক উপদেষ্টা জানান, “অধিকাংশ উপদেষ্টা জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোটের পরামর্শ দিয়েছেন। কয়েকজন আগে করার কথা বলেছেন।”
ঐকমত্য কমিশনের প্রথম খসড়া আদেশ অনুযায়ী, আগামী সংসদের সংবিধান সংস্কার পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হলে সংবিধান সংশোধনের খসড়া বিল পাশ ধরা হবে। গণভোট হবে আদেশ ও খসড়া বিলের ওপর। গতকালের বৈঠকে একাধিক উপদেষ্টা অভিমত দিয়েছেন, দ্বিতীয় খসড়া গ্রহণ করা উচিত, যেখানে পরিষদের জন্য জুলাই সনদ অনুযায়ী সংস্কার নির্দেশনামূলক রাখা হয়েছে।
রাজনৈতিক দিক থেকে বিএনপি আদেশ জারির বিরোধী। অন্যদিকে জামায়াত ও এনসিপি প্রথম খসড়া অনুযায়ী সংস্কারের বাধ্যবাধকতা চান। উভয় দলই চায় না রাষ্ট্রপতি; আদেশ হবে গণঅভ্যুত্থানে গঠিত সরকারের মাধ্যমে। একাধিক উপদেষ্টা জানিয়েছেন, এসব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। এক সপ্তাহের মধ্যে সমঝোতা না হলে সরকার একতরফা সিদ্ধান্ত নেবে।
সোমবার জরুরি বৈঠক শেষে জানানো হয়, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধের কারণে সরকার মধ্যস্থতা করবে না। “রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজ উদ্যোগে আলোচনায় সমঝোতার পথ বের করতে হবে। এক সপ্তাহের মধ্যে না পারলে সরকার সনদ ও গণভোটের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।”
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে তেজগাঁওয়ে তাঁর কার্যালয়ে বৈঠকের পর দুই উপদেষ্টা জানান, সমঝোতার জন্য পরিষদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এক সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবারের বৈঠকে প্রায় সব উপদেষ্টা একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট আয়োজনের পক্ষে হলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব প্রধান উপদেষ্টার ওপর রাখা হয়েছিল।
দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টারা বৃহস্পতিবার থেকে চার দিন বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির সঙ্গে আলোচনা করেছেন, কিন্তু সমঝোতা সম্ভব হয়নি। পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠনের নোট অব ডিসেন্ট প্রত্যাহারে বিএনপিকে রাজি করানো যায়নি। উচ্চকক্ষে পিআরের দাবি পূরণ হলে নিম্নকক্ষে জামায়াতের পক্ষ থেকে রাজি হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও ঘোষণা দিতে তারা সম্মত হয়নি। তাই সোমবার বৈঠকে এক সপ্তাহ সময় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকেও অনুমোদিত।
আলোচনার জন্য এক সপ্তাহ সময়ের সিদ্ধান্তকে জামায়াতসহ আটটি দল স্বাগত জানিয়েছে, তবে তারা প্রধান উপদেষ্টার কাছে মধ্যস্থতার আহ্বান জানিয়েছে। এনসিপি অভিযোগ করেছে, সরকারের কিছু পক্ষ ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশের বাইরে গিয়ে নিজেদের মতো সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছে। তারা বলেছে, “সরকার সংস্কার নিয়ে সাপ-লুডু খেলছে।” বিএনপি এখনও আলোচনায় কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়নি।
সাত মাসের সংলাপের পর গত ১৭ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষরিত জুলাই সনদে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত ছিল। পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠনসহ ১৫ প্রস্তাবে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। দলের দাবি অনুযায়ী স্বাক্ষরের এক দিন আগে তা সনদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বলা হয়েছে, যে দল কোন বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, ক্ষমতায় এলে সেই সংস্কারের এখতিয়ার রাখবে। ২৮ অক্টোবর ঐকমত্য কমিশন সরকারের কাছে সুপারিশ করলে, নোট অব ডিসেন্ট থাকলেও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশে তা প্রযোজ্য হবে না।
দ্বিতীয় খসড়ায় সংবিধান সংশোধন-সংক্রান্ত ৪৮টি সংস্কার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই খসড়া অনুযায়ী গণভোট হবে আদেশ ও তপশিলের ওপর, নোট অব ডিসেন্ট থাকবেনা। বিএনপি এটিকে প্রতারণা বলেছে ও নির্বাচনের দিন গণভোট চেয়েছে। জামায়াত নোট অব ডিসেন্টমুক্ত তপশিলের ওপর নভেম্বর মাসে গণভোট করতে চায়। এনসিপিও নোট অব ডিসেন্ট অন্তর্ভুক্ত না করার পক্ষে। দলগুলোর মধ্যে এই ইস্যুতে বিরোধ রয়েছে।
বিরোধ কমাতে বৃহস্পতিবারের বৈঠকের পর পাঁচজন উপদেষ্টাকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। সোমবারের বৈঠকের পর একাধিক উপদেষ্টা জানিয়েছেন, একাধিক আলোচনার পরও সমঝোতা হয়নি। কিছু বিষয়ে দলগুলো রাজি হলেও কিছু বিষয়ে ছাড় দিতে তারা প্রস্তুত নয়। তাই আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দলগুলোর ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
একজন উপদেষ্টা বলেন, “জুলাই সনদের অংশীদার প্রতিটি দল ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ের অগ্রসৈনিক। তারা জেদের কারণে ছাড় দিতে পারছে না। দলগুলো মনে করছে, ছাড় দিলে রাজনৈতিক অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়াও পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সন্দেহ আছে। তাই এক সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছে জেদের মাত্রা কমানোর জন্য।”