
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখনো আধিপত্য, দখল এবং চাঁদাবাজির সংস্কৃতি জিইয়ে রাখা হয়েছে—এমন মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
রোববার রাজধানীর ধানমন্ডিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ‘নতুন বাংলাদেশ: কর্তৃত্ববাদী সরকার পতন-পরবর্তী এক বছর’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে এই মন্তব্য জানায় সংস্থাটি।
প্রতিবেদনে বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক সহিংসতা, দখল ও চাঁদাবাজির সংস্কৃতি, এবং জাতীয় সংস্কার প্রচেষ্টার অগ্রগতি নিয়ে বিশদ বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে।
টিআইবি বলছে, “রাজনৈতিক দলগুলো আধিপত্য, চাঁদাবাজি, দখলবাজির সংস্কৃতি অব্যাহত রেখেছে।”
প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়, রাজধানী ঢাকার ৫৩টি পরিবহন স্ট্যান্ড ও টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন আনুমানিক ২ কোটি ২১ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। টিআইবির ভাষায়, এটি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পরিচালিত দখলদারি সংস্কৃতির সরাসরি উদাহরণ।
বিচার ব্যবস্থার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, কাঙ্ক্ষিত সংস্কার আজও অধরা। বিচারকদের নিয়োগে রাজনৈতিক বিবেচনা মুখ্য হয়ে উঠেছে, যেখানে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ঘাটতি স্পষ্ট। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তড়িঘড়ি করে রায় দেওয়া হচ্ছে। আদালত এলাকায় বিশৃঙ্খলা এবং আইনজীবীদের হয়রানির ঘটনাও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিষয়ে টিআইবি মন্তব্য করে, পেশাদারিত্বের অভাব এবং দায়িত্ব পালনে অনাগ্রহ প্রকট। সংস্থাটি বলেছে, বাহিনীর মধ্যে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ ও জবাবদিহির ঘাটতি জনগণের আস্থায় চির ধরাচ্ছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কার্যক্রমেও রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এতে করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যাঘাত ঘটছে এবং সুশাসনের অভাব গোটা প্রক্রিয়াকে দুর্বল করছে।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে টিআইবি। তারা জানায়, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে মিডিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর হয়েছে। এই সময়ে আটটি সংবাদপত্রের সম্পাদক, ১১টি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের বার্তা প্রধান এবং ১৫০ জন সাংবাদিক চাকরি হারিয়েছেন।
রাজনৈতিক সহিংসতার চিত্রও ভয়াবহ। প্রতিবেদনে জানানো হয়, আগস্ট ২০২৪ থেকে জুন ২০২৫ পর্যন্ত সময়ে দেশে মোট ৪৭১টি রাজনৈতিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে প্রাণ হারান ১২১ জন এবং আহত হন ৫,১৮৯ জন। সংঘর্ষে বিএনপি জড়িত ৯২ শতাংশ ঘটনায়, আওয়ামী লীগ ২২ শতাংশ, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ৫ শতাংশ এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ১ শতাংশ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ছিল।
রাজনৈতিক সংলাপ নিয়েও হতাশা প্রকাশ করেছে টিআইবি। তাদের মতে, “রাজনৈতিক সংলাপে অংশগ্রহণকারী দলগুলো নিজেদের দলীয় স্বার্থে অনড় থেকেছে। জাতীয় স্বার্থ ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের বিষয়ে তারা কার্যকর ভূমিকা রাখেনি।”
এছাড়া, সংস্থাটি সতর্ক করে জানায়, কয়েকটি দলের চাপে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়াটি একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যা ভবিষ্যতে বিরোধী মত দমনে ব্যবহৃত হতে পারে।
প্রতিবেদনের শেষাংশে বলা হয়, ঘোষিত ১১টি জাতীয় সংস্কার কমিশনের মধ্যে অগ্রাধিকার বৈষম্য রয়েছে। প্রথম দফার ছয়টি কমিশন—যেমন বিচার, সংবিধান ও নির্বাচন কমিশন—তুলনামূলকভাবে বেশি গুরুত্ব পেলেও বাকি বিষয়গুলোকে প্রায় উপেক্ষা করা হয়েছে।