
টানা বৃষ্টির অজুহাতে রাজধানীর বাজারে এক সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজ, ডিম ও মুরগির দাম বেড়েছে হঠাৎ করেই। অন্যদিকে সবজির বাজারও চড়া, যা নিত্যপণ্যের লাগামছাড়া দামে দিশেহারা করে তুলছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষকে।
ঢাকার খিলক্ষেত, কারওয়ান বাজার, শাহজাদপুর, বাড্ডা, নতুন বাজার ও রামপুরা ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে হঠাৎ করেই বেড়েছে পেঁয়াজ ও ফার্মের ডিমের দাম। খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দাম প্রতি কেজিতে ১৫–২০ টাকা বেড়ে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ডিমের দাম প্রতি ডজনে বেড়েছে ১০ টাকা।
ইসলামি ব্যাংকের কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান জানান, “গত শনিবার খিলক্ষেত বাজার থেকে দেশি পেঁয়াজ কিনেছিলাম ৫৫ টাকায়। আজ একই বাজারে এসে দেখি, সেটিই বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকায়।” তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, “এখনই দেশি পেঁয়াজের মজুত শেষ হওয়ার কথা নয়। নতুন মৌসুম আসতে তো আরও চার মাস বাকি।”
সপ্তাহজুড়ে ডিম, মুরগি, মসুর ডাল, টমেটোসহ বেশ কিছু খাদ্যপণ্যের দামও ঊর্ধ্বমুখী। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন দিনমজুর ও খেটে খাওয়া মানুষ, যারা একদিকে কাজের অভাবে আয়হীন, অপরদিকে পণ্যের দামে নাভিশ্বাসে।
ব্যবসায়ীদের দাবি, টানা বৃষ্টির ফলে সরবরাহব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটেছে। পাইকারি বাজারে ঘাটতি থাকায় খুচরা পর্যায়েও তার প্রভাব পড়ছে।
কারওয়ান বাজারের পাইকারি বিক্রেতারা জানান, এক সপ্তাহ আগে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৫৫-৫৭ টাকায়, যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০-৭২ টাকায়। পাইকারি মোকামে প্রতি মণ পেঁয়াজের দাম বেড়েছে প্রায় ৪০০ টাকা। বিশেষ করে পাবনা ও ফরিদপুর থেকে স্বাভাবিক সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না বলেই মূল্যবৃদ্ধি।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত এক মাসে দেশে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। আগে যে পেঁয়াজ বিক্রি হতো ৫৫-৬০ টাকায়, তা এখন ৮০ টাকা ছাড়িয়েছে।
শুধু পেঁয়াজ নয়, টিসিবির দৈনিক বাজার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত সপ্তাহে ১২টি পণ্যের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পেঁয়াজ, রসুন, ডিম, মসুর ডাল, পাম তেল ইত্যাদি। শুধু আলু ও আটার দাম কিছুটা কমেছে।
শুক্রবার ডিমের বাজারেও দেখা গেছে বাড়তি চাপ। ফার্মের মুরগির ডিম প্রতি ডজনে বিক্রি হয়েছে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায়, যা এক মাস আগেও ছিল ১২০ টাকা। ডিম বিক্রেতা রাফি বলেন, “দীর্ঘদিন ডিমের বাজারে মন্দাভাব ছিল, ফলে অনেক খামারি উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছেন। এতে সরবরাহ কমেছে।”
পাইকারি পর্যায়ে ১০০ লাল ডিমের দাম দাঁড়িয়েছে ১,০৪০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগেও ছিল ৮৫০-৯১০ টাকা।
এছাড়া ব্রয়লার মুরগির দামও বেড়েছে কেজিপ্রতি ১০ টাকা। বর্তমানে খুচরা বাজারে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ১৬০-১৭০ টাকা।
মসুর ডালের বাজারেও দেখা গেছে উর্ধ্বগতি। মাঝারি মানের ডাল ১৩৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে, যা আগে ছিল ১২০ টাকা। ছোট দানার মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১৪৫–১৫৫ টাকা কেজিতে।
সবজির বাজারেও পরিস্থিতি ভিন্ন নয়। ভালো মানের আলু কিছুটা কমে ২৫–৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও, অন্য সবজি আকাশছোঁয়া দামে। টমেটো বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা কেজিতে, গাজর ১৬০ টাকা, আর কাঁচা মরিচের দাম ২৪০–২৮০ টাকা পর্যন্ত।
এই অবস্থায় পেঁপে ছাড়া কোনো সবজি পাওয়া যাচ্ছে না ৬০ টাকার নিচে। সবচেয়ে সস্তা সবজি হিসেবে এক কেজি পেঁপে বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকায়।
মাছের বাজারেও স্বস্তি নেই। ইলিশের মৌসুম হলেও দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এক কেজির ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২,৬০০ থেকে ২,৯০০ টাকায়। তুলনায় ছোট আকারের ইলিশও ১,৪০০ থেকে ২,২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।
এই বাজার পরিস্থিতি নিয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, “বাজারের মৌলিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে। সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হচ্ছে। এমন অবস্থায় কেবল সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।”
তিনি পরামর্শ দেন, “চাহিদা ও জোগানে ভারস্যমূলক নীতি না থাকলে সামনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। এখনই সরকারের প্রস্তুতি নেওয়া দরকার।”