
এক বছর আগে ক্ষমতা হারানোর পর আবারও রাজনীতির ময়দানে ফেরার কৌশল নিয়ে সক্রিয় হচ্ছে আওয়ামী লীগ। দলটি সরকার পতনের ঘটনাকে ‘দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের ফল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিতে চাইছে।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, শেখ হাসিনার সরকারকে এককভাবে টার্গেট করে একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে সরানো হয়েছে। পাশাপাশি, অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন ব্যর্থতাকে তুলে ধরে দলটি তাদের রাজনৈতিক অবস্থান পুনর্গঠনের পথ খুঁজছে।
তবে গত বছরের জুলাই-অগাস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন এবং এর জেরে সংঘটিত সহিংসতার বিষয়ে দলটির পক্ষ থেকে এখনও কোনো অনুশোচনার প্রকাশ ঘটেনি, যা রাজনৈতিক অঙ্গনে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনকালে আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি এবং জনগণের একটি বড় অংশের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেছিল। এই প্রেক্ষাপটে আন্দোলন দমনকৌশল আরও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।
বর্তমানে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি সহ একাধিক দল, যাদের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারও আওয়ামী লীগ-বিরোধী অবস্থানে রয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ৭৬ বছরের পুরোনো আওয়ামী লীগ বর্তমানে সবচেয়ে গভীর সংকটে পড়েছে। এর শীর্ষ নেতাদের অনেকেই এখন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন।
সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং নেতা-কর্মীদের বড় একটি অংশ মানবতাবিরোধী অপরাধ ও সহিংসতার মামলায় গ্রেফতার হয়ে বিচারের মুখোমুখি। দেশের ভেতরে অবস্থানরত নেতা-কর্মীদের অনেকেই এখনও আত্মগোপনে রয়েছেন, কেউই এখনো প্রকাশ্যে দলকে সংগঠিত করার সাহস দেখাতে পারেননি।
এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে—কোনো ভুল স্বীকার না করে, কেবল ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এবং প্রতিপক্ষ সরকারের ব্যর্থতার ওপর নির্ভর করে আওয়ামী লীগের ঘুরে দাঁড়ানো আদৌ সম্ভব কি না।
দলের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, শেখ হাসিনা এখনো দলীয় সিদ্ধান্তের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন। তার নেতৃত্বেই দল পুনর্গঠনের চেষ্টা চলছে। এ ছাড়া, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বর্তমানে দলীয় রাজনীতিতে অনেক বেশি সক্রিয়। অনেক নেতার ধারণা, ভবিষ্যতের পরিকল্পনায় তাকে সামনে রেখেই কৌশল সাজানো হচ্ছে।
অন্যদিকে, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী দলগুলো এই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবে না—এই আশঙ্কায় দলটি দেশের ভেতর এবং আন্তর্জাতিক মহলে জনমত তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে।
তাদের বক্তব্য, আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক যথেষ্ট শক্তিশালী, ফলে তাদের বাইরে রেখে নির্বাচন হলে তা একটি বড় ইস্যুতে পরিণত হবে।
তবে বাস্তবতা হলো, আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী এখন সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় হলেও রাজপথে উপস্থিতি নেই। বিশ্লেষকেরা বলছেন, নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে তারা মাঠে জায়গা করে নিতে পারবে কিনা, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
কেন এত জোর ষড়যন্ত্র তত্ত্বে?
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের জন্য আন্দোলনের কৃতিত্ব দাবি করছে বিএনপি, জামায়াত এবং ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বাধীন সংগঠনগুলো। এসব পক্ষের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে যে বিভাজন তৈরি হয়েছে, তা আওয়ামী লীগ নিজেদের ষড়যন্ত্র তত্ত্বের পক্ষে যুক্তি হিসেবে তুলে ধরছে।
জুলাই-অগাস্টের আন্দোলন দমনের সময়ও জামায়াত-শিবিরসহ একাধিক পক্ষের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলেছিল দলটি। এখন সেই আন্দোলনের অভ্যন্তরীণ বিভক্তিকে সামনে এনে দলটি মনে করছে, তাদের বিরুদ্ধে গঠিত নেতিবাচক জনমতের কিছুটা হলেও পরিবর্তনের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
দেশের অন্তত পাঁচটি জেলার বেশ কয়েকজন তৃণমূল নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা এখনো বিশ্বাস করেন শেখ হাসিনার সরকার একটি সুপরিকল্পিত দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হঠানো হয়েছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, আওয়ামী লীগ গত বছরের আন্দোলনে দমনপীড়নের দায় স্বীকার করতে চাচ্ছে না। কারণ তা করলে ভেতরের হতাশা আরও বাড়তে পারে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণত ভুল স্বীকার করে না। যেমন, ১৯৭১ সালের যুদ্ধপরাধের জন্য জামায়াত ইসলামী তাদের ভূমিকার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেনি, যা প্রেক্ষাপট হিসেবে আলোচনায় উঠে আসে।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাও বলেছেন, দেশের পরিস্থিতি পাল্টে না গেলে বা নতুন করে রাজনীতির সুযোগ না এলে দলটি আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো অনুশোচনা প্রকাশ করবে না। তারা মনে করেন, অনুশোচনা দলের মনোবলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
যদিও দলের নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ স্বীকার করেছেন যে, আন্দোলন সামাল দিতে গিয়ে দলটি একের পর এক রাজনৈতিক ভুল করেছে, কিন্তু সেগুলো এখনও প্রকাশ্যে আনতে প্রস্তুত নয় দলীয় নেতৃত্ব।
লেখক ও বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, ষড়যন্ত্র তত্ত্বে ভর করে এবং অনুশোচনা ছাড়া আওয়ামী লীগ জনআস্থা ফিরে পাবে না।
তিনি বলেন, "বাস্তবতা বিবেচনা নিয়ে আওয়ামী লীগের কৌশল ঠিক করা প্রয়োজন।"
অন্যদের ব্যর্থতায় সুযোগ দেখছে আওয়ামী লীগ?
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বাড়ছে। আওয়ামী লীগ মনে করছে, এই ব্যর্থতা তাদের মাঠে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে।
দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, "বাংলাদেশে মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের ব্যর্থতাই আওয়ামী লীগের জন্য জনগণের সমর্থনের দিক থেকে নতুন আশার আলো সঞ্চার করেছে – এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।"
তবে বিশ্লেষকদের মত, অন্যের ব্যর্থতা রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ফিরে আসার জন্য যথেষ্ট নয়। কারণ আওয়ামী লীগের শাসনে বিরোধীদল এবং নির্বাচন ব্যবস্থা ছিল চরমভাবে সংকুচিত। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও দলীয় রূপ পেয়েছিল।
এছাড়া, দলটির অঙ্গসংগঠনগুলোও দুর্বল হয়ে পড়েছিল, যেখানে প্রভাব বিস্তার করেছিল সুবিধাবাদীরা। এমনকি ছাত্রলীগের অনেক সাবেক নেতারাও এখন নিজেদের ইসলামী ছাত্রশিবিরের সঙ্গে যুক্ত বলে পরিচয় দিচ্ছেন, যা নেতৃত্বের জন্য ছিল বিস্ময়ের।
কীভাবে ফিরে আসতে চায় আওয়ামী লীগ?
দেশের বাইরে থেকে রাজনীতি পরিচালনার চেষ্টায় থাকা আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই ঢাকার রাজনীতিতে সংগঠনের খোঁজে ছিল। কিন্তু কেউ তেমনভাবে সামনে আসেননি।
দলের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, শেখ হাসিনা গত এক বছরে ভারতে অবস্থান করেও জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত টেলিফোন ও ভার্চুয়াল মাধ্যমে যোগাযোগ রেখেছেন। সম্প্রতি সেই যোগাযোগ আরও বেড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রিত আওয়ামী লীগ নেতা মাহাম্মদ আলী আরাফাত বলেন, "আমাদের শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত যোগাযোগ বেড়েছে।" তিনি দাবি করেন, দলটি এখন অনেক বেশি সংগঠিত।
তবে গেল মাসে এনসিপির কর্মসূচিকে ঘিরে গোপালগঞ্জে সহিংস ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও পরে সেখানেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১৩টি মামলায় ১৫ হাজারের বেশি ব্যক্তির নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়।
দলটি এখন গোপালগঞ্জের বাইরে কোথাও তেমন সাংগঠনিক শক্তি দেখাতে পারছে না। নেতারা বলছেন, তারা এখন শক্তি সঞ্চয় করে সময় বুঝে রাজনৈতিক মাঠে ফেরার কৌশল নিচ্ছেন।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পেতে দলটি সক্রিয় রয়েছে।
জয়ের ভূমিকায় ফেরার গুঞ্জন
আওয়ামী লীগের নেতারা জানাচ্ছেন, শেখ হাসিনা এখনও তৃণমূল পর্যন্ত দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন এবং সম্প্রতি ভারতে আশ্রিত ছয়জন শীর্ষ নেতার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এরপর দলের নির্বাহী কমিটির সদস্যদের সঙ্গেও ধারাবাহিক বৈঠকের পরিকল্পনা রয়েছে।
এদিকে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বর্তমানে রাজনীতিতে আগের চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয়। তিনি আন্তর্জাতিক মহলে যোগাযোগ এবং দলের সংগঠনে ভূমিকা রাখছেন।
দলীয় নেতাদের বিশ্বাস, জয়কে সামনে আনা হলেও নিয়ন্ত্রণ থাকবে শেখ হাসিনার হাতেই। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব শেখ পরিবারের কাছেই থাকবে—তা না হলে দলের মধ্যে বিভাজন তৈরি হতে পারে।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অচলাবস্থা
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হয়েছে। এই কারণে দলের রাজনৈতিক কার্যক্রম ও নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন স্থগিত এবং ‘নৌকা’ প্রতীক বাতিল করা হয়েছে।
সাবেক সচিব ও বিশ্লেষক আবু আলম শহীদ খান মনে করেন, সরকার আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেবে না, তা স্পষ্ট। এমনকি দলটির কেউ স্বতন্ত্রভাবে প্রার্থী হতে চাইলে বাধার সম্মুখীন হতে পারেন।
সরকার এবং দেশের সক্রিয় রাজনৈতিক শক্তিগুলো আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের বাইরে রেখে নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু করেছে বলে অভিযোগ দলটির।
আবু আলম শহীদ খান বলেন, “আওয়ামী লীগের ব্যাপারে মানুষের মনে ক্ষোভ আছে, প্রশ্ন আছে। সে বিষয় বিবেচনায় অবস্থান স্পষ্ট না করলে দলটির সহসাই রাজনীতিতে ফেরা বেশ কঠিন।”
সূত্র: বিবিসি নিউজ বাংলা