
রাজধানীর রামপুরায় ছাদের কার্নিশে ঝুলে থাকা আমির হোসেনকে গুলি করে হত্যাচেষ্টাসহ দুজনকে হত্যার অভিযোগে দায়ের করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আজ চতুর্থ দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ মামলার আসামিদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আরও চারজন।
মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চে সাক্ষ্য পেশের কার্যক্রম শুরু হবে। আজ দুইজন সাক্ষীর জবানবন্দি গ্রহণের কথা রয়েছে।
গতকাল সোমবার তৃতীয় ও চতুর্থ সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন শহীদ মো. নাদিম মিজানের স্ত্রী তাবাসসুম আক্তার নিহা এবং প্রত্যক্ষদর্শী মো. ইয়াকুব। তারা ট্রাইব্যুনালে ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই রামপুরার বনশ্রী এলাকায় পুলিশ ও বিজিবির যৌথ অভিযানে সংঘটিত নৃশংস ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দেন এবং দায়ীদের কঠোর শাস্তির দাবি জানান। এরপর পলাতক তিন আসামির রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন এবং গ্রেপ্তার এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকারের পক্ষে আইনজীবী সারওয়ার জাহান তাদের জেরা করেন।
প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানিতে নেতৃত্ব দেন গাজী এমএইচ তামিম। তার সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ, আবদুস সোবহান তরফদার, সাইমুম রেজা তালুকদার, আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অন্যান্যরা।
গত ২৭ অক্টোবর দ্বিতীয় সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত হন গুলিবিদ্ধ শিশু বাসিত খান মুসার বাবা মো. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি ১৯ জুলাইয়ের ভয়াবহ ঘটনার কথা ট্রাইব্যুনালের সামনে তুলে ধরে জানান, “নিজের চোখের সামনে আমার একমাত্র ছেলে মুসা গুলিবিদ্ধ হয়। একই বুলেটে শহীদ হন মা মায়া ইসলাম।” তিনি আরও জানান, সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিলেও ছোট্ট মুসা এখনো কথা বলতে পারে না।
২৩ অক্টোবর প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্যের মাধ্যমে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। প্রথম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন গুলিবিদ্ধ ভুক্তভোগী আমির হোসেন, যিনি ঘটনার দিন ছাদের কার্নিশে ঝুলে ছিলেন।
এর আগে, ১৮ সেপ্টেম্বর হাবিবুর রহমানসহ পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১। ওইদিন এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকারের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী সারওয়ার জাহান। অভিযোগ পাঠের পর চঞ্চল নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। ১৬ সেপ্টেম্বর পলাতক চার আসামির পক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন।
এ মামলায় গ্রেপ্তার রয়েছেন রামপুরা ফাঁড়ির সাবেক এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকার। অন্য আসামিরা হলেন ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, খিলগাঁও জোনের সাবেক এডিসি মো. রাশেদুল ইসলাম, রামপুরা থানার সাবেক ওসি মো. মশিউর রহমান ও সাবেক এসআই তারিকুল ইসলাম ভূঁইয়া। গত ১০ আগস্ট তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
১ সেপ্টেম্বর পলাতক আসামিদের জন্য রাষ্ট্রনিযুক্ত ডিফেন্স আইনজীবী নিয়োগ দেয় ট্রাইব্যুনাল। এর আগে ২৫ আগস্ট তাদের হাজিরার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেওয়া হয়। ৭ আগস্ট প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন এবং ৩১ জুলাই তদন্ত সংস্থা চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।
তদন্তে জানা যায়, গত বছরের ১৯ জুলাই বিকেলে কর্মস্থল থেকে ফুফুর বাসায় ফিরছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তরুণ আমির হোসেন। রামপুরার বনশ্রী-মেরাদিয়া সড়কে পুলিশ ও বিজিবির উপস্থিতি দেখে আতঙ্কে তিনি একটি নির্মাণাধীন ভবনের ছাদে আশ্রয় নেন। পুলিশের তাড়া খেয়ে ছাদের কার্নিশের রড ধরে ঝুলে ছিলেন তিনি। তখন এক পুলিশ সদস্য তাকে লক্ষ্য করে ছয় রাউন্ড গুলি ছোড়েন। গুলিতে আহত হয়ে তিনি তিনতলায় পড়ে যান। স্থানীয়রা উদ্ধার করে প্রথমে বনশ্রীর একটি হাসপাতালে, পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। দীর্ঘ চিকিৎসার পর তিনি বেঁচে ফেরেন।
একই দিন ওই এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন নাদিম ও মায়া ইসলাম। গুলিবিদ্ধ হয় ছয় বছর বয়সী শিশু বাসিত খান মুসা, যিনি এখনো স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারেন না।
এর আগে ২৬ জানুয়ারি রাতে মামলার অন্যতম আসামি সাবেক এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকারকে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থেকে গ্রেপ্তার করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তানভীর হাসান জোহার নেতৃত্বাধীন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একটি দল।