
ইসরায়েলের সামরিক অভিযান গাজায় নতুন মাত্রা পেয়েছে, এক দিনে প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৫০ জন ফিলিস্তিনি। নিহতদের অনেকে ছিলেন দক্ষিণ গাজায় ত্রাণ সহায়তার আশায় জড়ো হওয়া সাধারণ মানুষ।
মঙ্গলবারের এই হামলার তথ্য প্রকাশ করেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা, যা বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর) তাদের এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, হামাস নেতাদের ওপর কাতারের দোহায় ইসরায়েলি হামলার দিকে বিশ্ববাসীর মনোযোগ থাকলেও, একই সময়ে গাজায় হামলা চালিয়ে কমপক্ষে ৫০ জনকে হত্যা করে ইসরায়েলি বাহিনী।
দক্ষিণ গাজায় যারা মানবিক সহায়তা পাওয়ার আশায় জড়ো হয়েছিলেন, তাদের মধ্যেও অন্তত ৯ জন নিহত হয়েছেন। অথচ ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু গাজাবাসীদের দক্ষিণে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন—সেই দক্ষিণেই হামলা তীব্র হয়েছে।
ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ওয়াফা জানিয়েছে, গাজার বন্দর এলাকায় বাস্তুচ্যুতদের একটি অস্থায়ী তাঁবুতে ড্রোন হামলায় দুই বেসামরিক নিহত হয়েছেন এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন।
এছাড়া যুদ্ধবিমান থেকে একাধিক আবাসিক ভবন এবং আল-মুখাবারাত এলাকার চারটি বাড়িতে বোমা বর্ষণ করা হয়। গাজার উত্তর-পশ্চিমে জিদান নামের একটি ভবনেও হামলা চালানো হয়েছে।
দেইর আল-বালাহ এলাকার তালবানি পাড়ায় একটি বাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে বলে জানা গেছে। তুফাহ অঞ্চলের আজ-জারকা এলাকায় সাধারণ মানুষের ওপর পরিচালিত আরেক হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন দুই তরুণ।
আল জাজিরার ফ্যাক্টচেকিং বিভাগ 'সানাদ' একটি ভিডিও বিশ্লেষণ করে জানায়, দেইর আল-বালাহ এলাকায় ইবন তাইমিয়্যাহ মসজিদে ইসরায়েলি হামলার সময় প্রবল আলোর ঝলক দেখা যায় এবং কিছুক্ষণের মধ্যে মসজিদের মিনার ধোঁয়ায় ঢেকে যায়। তবে বিস্ফোরণের পরেও মিনারটি অক্ষত থাকতে দেখা গেছে।
এর আগে সোমবার ইসরায়েল ঘোষণা দেয়, গাজার জামাল আবদেল নাসের সড়কের একটি ভবন ও পার্শ্ববর্তী তাবু এলাকায় অবস্থানকারীরা সরে না গেলে মৃত্যু ঝুঁকির মুখে পড়বেন। বাসিন্দাদের আল-মাওয়াসি এলাকায় যেতে নির্দেশ দেওয়া হয়, যেটিকে ‘মানবিক এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ইসরায়েল ওই আল-মাওয়াসি এলাকাতেও একের পর এক বোমা বর্ষণ করে যাচ্ছে। যেখানে বছরের শুরুতে ১ লাখ ১৫ হাজারের মতো মানুষ ছিলেন, এখন সেখানে আট লাখের বেশি বাস্তুচ্যুত মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন অস্থায়ী তাঁবুতে।
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএর প্রধান ফিলিপ লাজারিনি এই পরিস্থিতিকে বর্ণনা করেছেন “ক্ষুধার্ত ও হতাশ ফিলিস্তিনিদের এক বিশাল শিবির” হিসেবে। তার ভাষায়, “গাজায় কোথাও নিরাপদ নয়, এমনকি কথিত মানবিক অঞ্চলেও নয়। দুর্ভিক্ষের সতর্কতা শোনা হচ্ছে না।”
ফিলিস্তিনি সিভিল ডিফেন্সের ভাষায়, “গাজা সিটি জ্বলছে, মানবতা নিশ্চিহ্ন হচ্ছে।” সংস্থাটি জানায়, গত ৭২ ঘণ্টায় ৫টি উঁচু ভবন সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়েছে, যেখানে ২০০টির বেশি অ্যাপার্টমেন্ট ছিল। এতে হাজারো মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছেন।
এছাড়া ৩৫০টিরও বেশি তাবু মাটির সঙ্গে মিশে গেছে, ফলে প্রায় ৭ হাজার ৬০০ মানুষ এখন খোলা আকাশের নিচে ক্ষুধা, আতঙ্ক ও প্রচণ্ড গরমে দিন কাটাচ্ছেন।
চলমান এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা ৬৪ হাজার ছাড়িয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ২০ হাজারই শিশু।
একাধিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও গবেষকের মতে, এ ঘটনাপ্রবাহ একটি ‘গণহত্যা’র রূপ নিয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ইতোমধ্যেই ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।