
স্বাধীনতাকামী মানুষের সহস্র বছরের দীর্ঘ ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা 'দ্যা রিভোনিয়া ট্রায়াল'। ১৯৬৪ সালে এই বিচারের মুখোমুখি হয়ে নেলসন মেন্ডেলা শ্বেতাঙ্গ শাসকদের উদ্দেশ্যে বলেন, 'আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তত।' এরপর শুরু হয় তাঁর দীর্ঘ ২৭ বছরের কারাবাস। আজ ৫ ডিসেম্বর, কালো এবং নিপীড়িত মানুষের কন্ঠস্বর এই মহান ব্যক্তির ১২তম প্রয়াণ দিবস।
দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের উপকন্ঠে অবস্থিত রিভোনিয়া এলাকা। এখানে শ্বেতাঙ্গ শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (ANC)- এর গোপন সশস্ত্র শাখার সদর দপ্তর ছিল। ১৯৬৪ সালে নেলসন মেন্ডেলা এবং তাঁর সহযোগীদের এই সশস্ত্র সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ততা, রাষ্ট্রদ্রোহ, নাশকতা, বিদেশী সামরিক শক্তির সহায়তা গ্রহণসহ বিভিন্ন অভিযোগে রিভোনিয়া ট্রায়ালের মুখোমুখি করা হয়।
শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের যুগে এই অভিযোগের চূড়ান্ত শাস্তি ছিল মৃত্যদন্ড। আদালতের জবানবন্দিতে মেন্ডেলা বলেন, “আমার সারা জীবন আমি আফ্রিকার মানুষের সংগ্রামের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছি। আমি শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়েছি, এবং কৃষ্ণাঙ্গ আধিপত্যের বিরুদ্ধেও লড়েছি। আমি এমন এক আদর্শকে বুকে ধারণ করে এসেছি- যেখানে একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক সমাজে সকল মানুষ মিলেমিশে বাস করবে, সমতা, মর্যাদা ও সুযোগের সমান অধিকার নিয়ে। এই আদর্শের জন্য আমি বাঁচতে চাই, এবং সম্ভব হলে এই আদর্শ বাস্তবায়ন করতেও চাই। কিন্তু প্রয়োজন হলে এই আদর্শের জন্য আমি মরতেও প্রস্তুত।
১২ তম প্রয়াণ দিবসে মেন্ডেলার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো তুলে ধরা হল-
জন্ম ও প্রাথমিক জীবন
নেলসন মেন্ডেলা ১৮ জুলাই ১৯১৮-এ দক্ষিণ আফ্রিকার এমভেজো অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি থেম্বু রাজবংশের এক শাখার সন্তান ছিলেন এবং ছাত্রজীবনে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। শিক্ষা জীবনে তিনি 'কলেজ অফ ফোর্ট হেয়ার (College of Fort Hare)'- এ ভর্তি হন, কিন্তু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে সেখানে থেকে বহিষ্কৃত হন। পরবর্তীতে তিনি আইন শাস্ত্রে অধ্যয়ন করে একটি আইন অফিসে কাজ শুরু করেন।
বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে যাত্রা
১৯৪০-এর দশকে মেন্ডেলা আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (ANC)-এ যোগ দেন এবং বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সক্রিয় সংগ্রাম শুরু করেন। প্রাথমিকভাবে তিনি অহিংস প্রতিরোধে বিশ্বাসী হলেও, ১৯৬১-এ তিনি এবং তাঁর সঙ্গীরা “উমখোন্টো ওয়ে সিজও” (Umkhonto we Sizwe বা “জাতির নিক্ষেপ”) নামে একটি সশস্ত্র সংগঠন গঠন করেন, যা তখনকার দমনমূলক শ্বেতাঙ্গ শাসনের বিরুদ্ধে অস্ত্রসহ সংগ্রাম শুরু করে।
গ্রেফতার, রিভোনিয়া বিচার ও কারাগার জীবন
১৯৬২ সালে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং পরবর্তীতে ১৯৬৪-এ 'রিভোনিয়া ট্রায়াল'- এ অভিযোগ স্বীকারের সময় তিনি তার বিখ্যাত বক্তৃতায় বলেন, “আমি গণতন্ত্রের মতো এক আদর্শের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত। (Democracy is an ideal for which I am prepared to die)”। এ কারণে তাঁকে আজীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়, মৃত্যুদণ্ড থেকে খুব কম ব্যবধানে বাঁচেন। পরবর্তী ২৭ বছর তিনি রাবেন দ্বীপের কঠোর কারাগারে বন্দি থাকেন, যেখানে তাঁর সংগ্রাম ও সহিংসতার বিরুদ্ধে অটল মনোবল আন্তর্জাতিক সম্মান অর্জন করে।
মুক্তি, নেতৃত্ব ও রাষ্ট্রপতি হওয়ার যাত্রা
১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি দীর্ঘ কারাবাসের পর মেন্ডেলা মুক্ত হন। তাঁর মুক্তি দক্ষিণ আফ্রিকার অভ্যুত্থান ও বর্ণবাদী শাসনের পতনের শুরু ছিল। ১৯৯১-এ তিনি ANC-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং ১৯৯৩-এ ফ্রান্স ডি কেলার্কের সঙ্গে মিলে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৪-এ দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম বহুঁজাতিক নির্বাচনে ANC বড় জয় করে, এবং মেন্ডেলা দেশটির প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। তিনি সত্য ও পুনর্মিলন কমিশন (Truth and Reconciliation Commission) গঠন করেন, যা বর্ণবাদ (Apartheid)- এর ত্রুটিগুলো তদন্ত করে এবং দেশকে healed (চিকিৎসা) ও পুনর্গঠনে সহায়তা করে।
রাষ্ট্রপতি জীবনের অবদান
১৯৯৪-১৯৯৯: প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেন্ডেলা শিক্ষা, আবাসন ও আর্থিক উন্নয়নে উদ্যোগ নেন, দেশের সংবিধানকে ন্যায়পরায়ণভাবে পুনঃগঠন করেন এবং বর্ণবাদভিত্তিক বিভাজন ধ্বংস করে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ন্যায্যতার পথ সুগম করেন। সমঝোতা, ক্ষমা, এবং পুনর্মিলনের বার্তা দিয়ে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকাকে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিণত করার চেষ্টা করেন।
ব্যক্তিগত জীবন ও মৃত্যু
মেন্টেলাইনের জীবনে প্রেম ও ব্যক্তিগত সংগ্রামেও ছিল উত্থান-পতন। তিনি প্রাথমিকভাবে উইনি মাদিকিজেলা-মেন্ডেলার সঙ্গে বিবাহ করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে তাদের সম্পর্ক বিচ্ছেদ হয়। ১৯৯৮-এ তিনি গ্রাসা মাশেলের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
৫ ডিসেম্বর ২০১৩-এ জোহানেসবার্গে ৯৫ বছর বয়সে দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনাবসান হয় এই কিংবদন্তির। তাঁর মৃত্যুতে সমগ্র বিশ্বে শোকের ছায়া নেমে আসে।