
ভারতের কেরালা রাজ্যে বাংলাদেশি বলে সন্দেহ করে এক ভারতীয় হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনায় নিন্দার ঝড় উঠেছে।
রামনারায়ণ বাঘেল নামে ৩১ বছর বয়সি ওই মৃত ব্যক্তি ছত্তিশগড়ের বাসিন্দা ছিলেন এবং কাজের খোঁজে কেরালার পালাক্কাডে গিয়েছিলেন। তিনি দলিত শ্রেণীর মানুষ ছিলেন।
ঘটনায় জড়িত সন্দেহে এখন পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং বাকিদের খোঁজ চলছে বলে জানিয়েছে কেরালা পুলিশ। ঘটনাটি গত সপ্তাহের, তবে সপ্তাহান্তে বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
সেরাজ্যের ক্ষমতাসীন সিপিআইএম দল যদিও ওই ব্যক্তিকে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনাটি "আরএসএসের ঘৃণার রাজনীতি ছড়ানোর ফল" বলে বর্ণনা করছে; তবে বিজেপি বলছে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের মধ্যে একজন সিপিআইএম, একজন কংগ্রেস সমর্থক আছেন এবং "কয়েকজন বিজেপির সমর্থকও থাকতে পারে"।
এ ধরনের ঘটনা "কেরালার মতো একটা সভ্য সমাজের ভাবমূর্তি নষ্ট করে" বলে সোমবার মন্তব্য করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন।
কেরালার পুলিশ জানিয়েছে যে ছত্তিশগড় থেকে মাত্র গত সপ্তাহের গোড়ার দিকেই পালাক্কাডের ওয়ালাইয়ারে কাজে খোঁজে এসেছিলেন রামনারায়ণ বাঘেল। তার এক ভাই সেখানে একটি নির্মাণ সংস্থায় কাজ করেন।
এক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, "তাকে বাংলাদেশি বলে সন্দেহ করে কয়েকজন তাকে ঘিরে ধরে মারতে থাকে। তবে কয়েকজন আবার বলছে যে তাকে চোর বলে সন্দেহ করে মারা হয়।"
তার ভাই শশীকান্ত বাঘেল ১৭ই ডিসেম্বর ওয়ালাইয়ারের পুলিশের কাছ থেকে একটি ফোন পান, তাকে জানানো হয় যে রামনারায়ণকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাকে লাঠি, পাইপ এবং আরও কিছু মারাত্মক জিনিস দিয়ে মেরেছে একদল ব্যক্তি।
রামনারায়ণ বাঘেলের হত্যার বিচারের দাবিতে গঠিত 'রামনারায়ণ অ্যাকশন কাউন্সিল'-এর সদস্য আনিস বলেছেন, "তিনি কাজের খোঁজেই এসেছিলেন, কিন্তু গ্রামে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। তাকে মাঝপথে আটকানো হয় এবং বাংলাদেশি বলে সন্দেহ করে মারা হয়। মারধরের যে ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানেই সবটা দেখা যাচ্ছে।"
একজন ডেপুটি পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে বিশেষ তদন্তকারী দল গঠিত হয়েছে।
শশীকান্ত বাঘেল বলছিলেন, "রাজস্ব মন্ত্রী আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন যে ছত্তিশগড়ের রাজধানী রায়পুরে মরদেহ নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবে সরকার। মন্ত্রিসভা ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে, এই আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে আমাদের।"
কারা অভিযুক্ত?
এই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে এখনও পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে কেরালা পুলিশ।
ধৃতদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে ক্ষমতাসীন সিপিআইএম এবং বিজেপি একে অপরের দিকে আঙুল তুলেছে।
স্থানীয় প্রশাসন মন্ত্রী এমবি রাজেশ বলছেন যে আরএসএস-বিজেপির রাজনীতিই এই ঘটনার জন্য দায়ী।
তার কথায়, "যতজন গ্রেফতার হয়েছেন, প্রত্যেকেই আরএসএসের শাখায় যেত। একজন সিপিআইএম সদস্যকে হত্যা করা ছাড়াও এরা নানা ঘটনায় জড়িত ছিল। আরএসএস যে ঘৃণার রাজনীতির প্রচার করে, এই ঘটনা তারই ফলাফল।"
তবে কেরালা বিজেপির মুখপাত্র শ্রীপদ্মনাভন বলেছেন, "প্রথম অভিযুক্ত সিপিআইএমের একজন বুথ স্তরের কর্মী ছিলেন আগে। দ্বিতীয়জন কংগ্রেসের সমর্থক আর অন্য দুজন বিজেপির সমর্থক হতে পারেন। এটা রাজনৈতিক ইস্যু নয়। স্থানীয় ও বহিরাগতদের মধ্যে বিরোধের জন্য এই ঘটনা হয়েছে।"
কী বলছেন মুখ্যমন্ত্রী?
কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন বলেছেন, "পালাক্কাডের ওয়ালাইয়ারে গণপিটুনিতে নিহত রামনরায়ণ বাঘেলের পরিবার যাতে ন্যায্য বিচার পায়, তা নিশ্চিত করা হবে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"
"পালাক্কাডের পুলিশ সুপারের নজরদারিতে একটি বিশেষ তদন্তকারী দল গঠিত হয়েছে। ঘটনার সম্পূর্ণ বিবরণ পরীক্ষা করে দেখে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের জন্য সব তথ্য জোগাড় করছে," বলেছেন মি. বিজয়ন।
তার কথায়, "এ ধরনের ঘটনা কেরালারর মতো একটা সভ্য সমাজের ভাবমূর্তি নষ্ট করে। এ ঘটনা কখনই মেনে নেওয়া যায় না। ভবিষ্যতে যাতে এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়, তার জন্য সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।"
মুখ্যমন্ত্রীর সোমবার এই বিবৃতি দেওয়ার আগেই সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক কেসি ভেনুগোপাল সামাজিক মাধ্যমে এক পোস্ট করে বলেছিলেন যে রামনারায়ণ বাঘেলের মৃত্যু "হতবাক করে দেওয়ার মতো ঘটনা"।
"এরকম কোনো সহিংস শক্তি বিনা বাধায় ঘুরে বেড়াবে, সেটা কখনই মেনে নেওয়া যায় না। এর আগে ২০১৮ সালে মধু নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে কী ঘটেছিল, সেই স্মৃতি এখনো তাজা রয়েছে সবার মনে। এখন এই ঘটনা। যে কেরালায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটা গর্বিত ইতিহাস আছে, সেখানে বার বার মব সহিংসতার মতো নিন্দনীয় ঘটনা কেন হবে?" বলেন কেসি ভেনুগোপাল।
পরিযায়ী শ্রমিকদের গণপিটুনি আগেও হয়েছে
আসাম থেকে শ্রমিকের কাজ করতে এসেছিলেন এমন এক শ্রমিক কৈলাশজ্যোতি বেহরা ২০১৬ সালের মে মাসে আরও তিন বন্ধুর সঙ্গে কোট্টায়ামের চিংগাভনমে এসেছিলেন। ভিড়ের মধ্যে বন্ধুদের থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে যান।
তিনি যখন বন্ধুদের খোঁজ করছিলেন, সেই সময়ে একদল ব্যক্তি তাকে চোর সন্দেহে মারতে থাকেন। পরে তারা মি. বেহরাকে বেঁধে রেখে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে প্রায় এক ঘণ্টা ফেলে রাখেন। পুলিশ তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানেই তার মৃত্যু হয়।
ওই ঘটনার ঠিক আগেই এরণাকুলামের পেরুমবাভুরের এক আইন ছাত্রীকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়, যে ঘটনায় জড়িত ছিলেন উত্তরপূর্ব ভারতেরই এক ব্যক্তি।
বছর দুয়েক পরে পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা, ৫০ বছর বয়সি মানিক রায়কে মুরগি চোর সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। তিনি মুরগিটি অবশ্য দোকান থেকে কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। দুই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
রাজেশ মাঝি নামে এক ব্যক্তিকে ২০২৩ সালের মে মাসে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় শুধু তিনি একটি বাড়ির কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করছিলেন বলে।
এর প্রায় ১১ মাস পরে অরুণাচল প্রদেশের বাসিন্দা অশোক দাসকে এরণাকুলামে তাড়া করে ধরে ফেলে একদল ব্যক্তি এবং তাকেও পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। একটি খাবারের দোকানে তারই সহকর্মী ছিলেন, এমন একজন নারীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন তিনি।
সেন্টার ফর মাইগ্রেশন অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্টের কার্যনির্বাহী পরিচালক বিনয় পিটার রামনারায়ণ বাঘেলের হত্যার ঘটনাকে স্পষ্টতই গণপিটুনির ঘটনা বলে মনে করেন।
তার কথায়, "একেবারেই গণপিটুনির ঘটনা। খুবই নৃশংস। কিন্তু কেরালায় গণপিটুনির ইতিহাস যদি দেখেন তাহলে এটা খুবই উদ্বেগজনক, কারণ একেকটি ঘটনার মধ্যে সময়ের ফারাকটা বছর-বছর ক্রমশ কমছে।"
প্রোগ্রেসিভ ওয়ার্কার্স অর্গানাইজেশনের জর্জ ম্যথু বলছিলেন, "সমস্যাটা শুধু গণপিটুনিতে মৃত্যুর নয়। পরিযায়ী শ্রমিকদের হেনস্তা এবং মারধর করার অসংখ্য অভিযোগ আছে। এমন ঘটনাও আছে যেখানে এক সহকর্মী পরিযায়ী শ্রমিককে মারধর করার ছবি তুলেছিলেন বলে এক নারীকে বাধ্য করা হয় তার বাসাবাড়ি ছেড়ে দিতে।"
কেরালার ২১ থেকে ৩৫ বছর বয়সি মানুষরা দেশের বাইরে কাজ করতে চলে যান। বিদেশ থেকে কেরালায় ২০২৩-২৪ সালে রেমিট্যান্স এসেছে দুই লাখ কোটি ভারতীয় টাকা। বিদেশে গিয়ে কেরালার মানুষরা যে-সব কাজ করেন, সেই একই কাজ করতে আনুমানিক ৩০ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকে কেরালায় আসেন।
'আমি একটি বাড়ি করতে চেয়েছিলাম'
ছত্তিশগড়ে সংবাদদাতা আলোক পুতুলের সঙ্গে কথা বলেছেন রামনারায়ণ বাঘেলের পরিবারের সদস্যরা। তারা জানান, মি. বাঘেল কয়েক বছর ধরে কাজের জন্য রাজ্যের বাইরে যাতায়াত করছিলেন।
সতনামী সম্প্রদায়ভুক্ত বাঘেল পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করলেও, সঞ্চিত অর্থ দিয়ে তারা গ্রামে একটি ছোট বাড়ি নির্মাণের চেষ্টা করেছিলেন।
রামনারায়ণ বাঘেল তার দুই ছেলে (বয়স আট ও দশ), মা এবং স্ত্রীকে নিয়ে ভাইয়ের বাড়িতে থাকতেন। তিনি শ্রমিকের কাজ করে উপার্জিত অর্থ দিয়ে এবার বাড়িটি সম্পূর্ণ করতে চেয়েছিলেন।
পরিবারের কাছে তিনি বলেছিলেন, টাকা নিয়ে ফিরলেই ছাদ তৈরি হবে এবং ভাইয়ের কাঁচা বাড়িতে আর থাকতে হবে না।
গ্রামের কয়েকজন ইতোমধ্যেই পালাক্কাডে কাজ করছিলেন। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তিনি সেখানে যান।
রামনারায়ণ বাঘেলের চাচা কিশন বাঘেল জানান, "রামনারায়ণ এই মাসের ১৩ তারিখে কেরালার উদ্দেশে রওনা দেন এবং ১৫ ডিসেম্বর পালাক্কাডে পৌঁছে তিনি মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলে জানান যে তিনি নিরাপদে পৌঁছেছেন।"
পরিবারের সদস্যরা বলেন, তার নিজের মোবাইল ফোন ছিল না, তবে পরিবারের নম্বর একটি কাগজে লিখে রেখেছিলেন। সেই নম্বর দেখে পুলিশ পরিবারকে ফোন করে মৃত্যুর খবর জানায়।
পালাক্কাডের শশিকান্ত বাঘেল জানান, রামনারায়ণের সেখানে কাজ পছন্দ হয় নি এবং ১৭ ডিসেম্বর বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। কিন্তু তিনি পথ হারিয়ে এমন জায়গায় পৌঁছান যেখানে যুবকদের হাতে গণপিটুনিতে নিহত হন।
শশিকান্ত বাঘেল ত্রিশূর মেডিকেল কলেজে রামনারায়ণের মরদেহ নিতে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, "ওয়ালাইয়ার থানার পক্ষ থেকে আমাকে ফোন করে জানানো হয় যে রামনারায়ণ বাঘেল থানায় আছে এবং আমাকে সেখানে যেতে হবে। পৌঁছানোর পর আমাদের কাছ থেকে সব তথ্য নেওয়া হয়। এরপর জানানো হয় যে রামনারায়ণ মারা গেছেন। ভিডিওতে আমি দেখেছি আমার ভাইকে ঘিরে নির্মমভাবে মারধর করা হচ্ছে এবং তাকে 'বাংলাদেশি-বাংলাদেশি' বলে ডাকা হচ্ছে।"
রামনারায়ণের স্ত্রী ললিতা দুই সন্তানকে নিয়ে কেরালায় গিয়েছেন স্বামীর মরদেহ নিতে, আর তার বৃদ্ধা মা রয়েছেন করাহী গ্রামে।
সংবাদমাধ্যমকে রামনারায়ণের মা বলেন, তার ছেলের আয়ই ছিল পরিবারের একমাত্র ভরসা। আরেক ছেলে রায়পুরে শ্রমিকের কাজ করেন, কিন্তু তার আয় দিয়ে সংসারের খরচ মেটে না। তিনি বলেন, ছেলের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার সব স্বপ্ন ভেঙে গেছে।
এদিকে রাজ্য বিধানসভায় বিরোধী দলীয় নেতা চরনদাস মহন্ত মুখ্যমন্ত্রী বিষ্ণুদেব সাইকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন, রামনারায়ণ বাঘেলকে শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে গণপিটুনিতে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। এই ঘটনা শুধু মানবতাকে লজ্জায় ফেলেনি, বরং দেশের বিভিন্ন স্থানে কাজ করা অভিবাসী শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।
তিনি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পুরো ঘটনার হস্তক্ষেপ এবং নিহতের পরিবারকে অবিলম্বে সহায়তা প্রদানের দাবি জানিয়েছেন।
কংগ্রেসের মুখপাত্র সুশীল আনন্দ শুক্লা বলেছেন, এ ধরনের ঘটনা দেশে ছড়িয়ে পড়া ঘৃণার ফল। তিনি অভিযোগ করেছেন, সরকার এখনো বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি এবং কেরালা সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদও জানায়নি।
এদিকে জেলা কালেক্টর জানিয়েছেন, তিনি পরিবার এবং কেরালা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। মরদেহ ছত্তিশগড়ে আনার প্রস্তুতি চলছে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা