
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন সরকার গাজা শহর পুরোপুরি দখলের পরিকল্পনায় এগিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে এই উদ্যোগে অনুমোদন দিয়েছে দেশটির নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। জাতিসংঘ, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া সহ বেশ কয়েকটি দেশ এই সিদ্ধান্তের সমালোচনায় মুখর হয়েছে। এমনকি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায় থেকেও এসেছে বিরোধিতা।
শুক্রবার (৮ আগস্ট) নেতানিয়াহুর দপ্তর থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে জানানো হয়, গাজায় হামাসকে পরাজিত করতে প্রধানমন্ত্রী যে পরিকল্পনা পেশ করেছেন, তা মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেয়েছে। সেইসঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরের বেসামরিক জনগণের জন্য মানবিক সহায়তা জোরদার করার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, হামাসের সঙ্গে যুদ্ধে সমাপ্তি আনতে ইসরায়েল যে পাঁচটি প্রধান শর্ত দেবে, তার মধ্যে রয়েছে হামাসকে সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ, এখনও বন্দি থাকা ৫০ জন ইসরায়েলিকে মুক্ত করা (ধারণা করা হচ্ছে, এর মধ্যে অন্তত ২০ জন জীবিত), গাজা উপত্যকার সামরিকীকরণ বন্ধ করা, সেখানে ইসরায়েলি নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং হামাস বা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ছাড়া বিকল্প একটি বেসামরিক প্রশাসনের হাতে গাজা শাসনের ভার তুলে দেওয়া।
জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ফলকার তুর্ক ইসরায়েল সরকারের এই পদক্ষেপকে তীব্র সমালোচনা করে বলেন, এটি আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের রায়ের পরিপন্থী। ইসরায়েলকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার দখলদারিত্বের অবসান ঘটাতে হবে। দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান বাস্তবায়ন করতে হবে এবং ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
এই উদ্যোগকে গভীর রাজনৈতিক ভুল” হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমার। তিনি কড়া ভাষায় ইসরায়েলি সরকারকে এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়ে বলেন, এই পদক্ষেপ এই সংঘাতের অবসান ঘটাতে বা জিম্মিদের মুক্তি নিশ্চিত করতে কোনও সাহায্য করবে না। এটি কেবল আরও রক্তপাত ডেকে আনবে।
স্টারমার আরও উল্লেখ করেন, গাজায় প্রতিদিন মানবিক সংকট আরও তীব্র হচ্ছে এবং হামাসের হাতে আটক ব্যক্তিদের অবস্থা মানবিকতার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তিনি বলেন, এখনই যুদ্ধবিরতি দরকার, বাড়ানো দরকার মানবিক সহায়তা এবং প্রয়োজন আলোচনার মাধ্যমে একটি টেকসই সমাধান।
এদিকে অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি ওং ইসরায়েলকে এ ধরনের পদক্ষেপ না নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন,
“এই পদক্ষেপ গাজার মানবিক বিপর্যয়কে আরও ভয়াবহ করে তুলবে। একটি স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করার একমাত্র পথ হলো দুই-রাষ্ট্রীয় সমাধান।”
ইসরায়েলের ভেতরেও এই সিদ্ধান্ত ঘিরে দেখা দিয়েছে গভীর মতপার্থক্য। বিরোধীদলীয় নেতা ইয়ার ল্যাপিড সতর্ক করে বলেছেন, গাজা দখলের এই সিদ্ধান্ত বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তিনি বলেন, এতে করে জিম্মিদের প্রাণহানি হতে পারে এবং ইসরায়েলি সেনাদেরও মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে।
ল্যাপিড অভিযোগ করেন, নেতানিয়াহু অতি-ডানপন্থী মন্ত্রীরা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করায় এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন। সরকারের জোট স্থিতিশীল রাখতে তিনি এই চরম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হলো, ইসরায়েলি সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াল জমিরও এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছেন। দেশটির গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে জানা যায়, গাজা দখলের বিষয়ে নেতানিয়াহুর সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি এটিকে সেনাদের জন্য ফাঁদে পা দেওয়ার মতো পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করেন।
সেনাপ্রধান আরও সতর্ক করে বলেন, এই অভিযান গাজায় এখনও জীবিত জিম্মিদের জীবন আরও বিপন্ন করে তুলবে।
গাজা নিয়ে ইসরায়েলি নেতৃত্বের এই সিদ্ধান্ত এমন এক সময়ে এসেছে, যখন অঞ্চলটিতে মানবিক বিপর্যয় চরমে পৌঁছেছে, আন্তর্জাতিক সমাজ যুদ্ধবিরতির দাবি তুলেছে, এবং দেশটির ভেতরেই বাড়ছে রাজনৈতিক ও সামরিক বিভাজন।