
শেখ হাসিনার শাসনামলে আট বছর ধরে গোপন কারগার ‘আয়নাঘরে’ বন্দি ছিলেন ব্যারিস্টার মীর আহমেদ বিন কাসেম, যিনি ব্যারিস্টার আরমান নামে অধিক পরিচিত। তিনি ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেছেন, ‘ব্রিটিশ সাংবাদিকরা শেখ হাসিনার ভাগ্নি যুক্তরাজ্যের সিটি মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিককে তার দুর্দশাজনক পরিস্থিতি নিয়ে জিজ্ঞাসা করার পর ঢাকায় তার পরিবারের বাসায় অভিযান চালিয়েছিল পুলিশ।’ সংবাদ ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের।
মীর আহমাদ ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তার স্ত্রীকে ‘চুপ থাকতে’ বলেছিলেন। একইসঙ্গে তারা চ্যানেল ৪ নিউজের সাংবাদিকদের টিউলিপ সিদ্দিককে প্রশ্ন করার ফুটেজ সম্প্রচার বন্ধের চেষ্টা করার জন্য বলেছিলেন।’
আরমানকে ২০১৬-২০২৪ সালের পর্যন্ত বিনা বিচারে বাংলাদেশের একটি গোপন কারাগারে রাখা হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘টিউলিপ সিদ্দিক এই ইস্যুতে মুখোমুখি হওয়ায় তা স্পষ্টতই শাসক শেখ পরিবারের কোথাও একটি ধাক্কা লাগে। সুতরাং, আমি নিশ্চিত এতেই প্রশাসনের কাছ থেকে এ ধরনের প্রতিক্রিয়া এসেছে।’
চ্যানেল ৪ নিউজের সাংবাদিকরা ২০১৭ সালের ২৫ নভেম্বর (শনিবার) সকালে লন্ডনে টিউলিপ সিদ্দিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাদের ভাষ্য ছিল, বাংলাদেশি নাগরিক মীর আহমেদ কাসেমের বিষয়ে আপনি একটি ফোন কলের মাধ্যমে বিশাল পার্থক্য গড়ে দিতে পারেন।
ওই সময়ের ফুটেজে দেখা যায়, টিউলিপ সিদ্দিক সাংবাদিকদেরকে সতর্ক করেন, তাকে বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ হিসেবে না দেখার জন্য। তিনি বলেন, ‘আপনি যা বলছেন, খুব সতর্ক থাকুন, আমি একজন ব্রিটিশ এমপি।’
এই ফুটেজটি তিন দিন পর অর্থাৎ ২৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় সম্প্রচার করা হয়।
আরমান জানান, এটি সম্প্রচারের কয়েক ঘণ্টা আগে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সদস্যসহ নিরাপত্তাকর্মীরা ঢাকায় তার পরিবারের বাড়ি ঘেরাও করে। প্রায় ১২ জন সশস্ত্র ব্যক্তি বাড়িতে ঢুকেছিল বলে জানান তিনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তার স্ত্রীর বিদেশে যোগাযোগের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চান।
‘এতে মনে হচ্ছিল যেন তারা একজন সন্ত্রাসীকে ধরেছে’
আরমান তার বাবা বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামীর নেতা মীর কাসেমের আইনজীবী দলের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় তাকে ২০১৬ সালে প্রথম আটক করা হয়। শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়ার ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে গত বছরের ৬ আগস্ট তিনি মুক্ত হন।
ব্রিটেনে একজন আইনজীবী হিসেবে প্রশিক্ষিত মীর আহমেদ বিন কাসেম অর্থাৎ আরমান ‘আয়নাঘরে’ বন্দি শতাধিক ব্যক্তির মধ্যে একজন। গোপন কারাগারের এই নাম হওয়ার কারণ বন্দিরা সেখানে বছরের পর বছর ধরে অন্য কাউকে দেখতে পেতেন না। আরমান এটিকে মৃত্যুর চেয়ে ভয়াবহ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি জানান, তার হাতে সব সময় হাতকড়া লাগানো থাকত এবং তিনি সূর্যের আলো দেখতে পেতেন না।
আরমানের যুক্তরাজ্যভিত্তিক আইনজীবী মাইকেল পোলোক মনে করেন, অভিযানটি তার পরিবারকে চ্যানেল ৪ নিউজকে ফুটেজ সম্প্রচার না করার জন্য চাপ দেওয়ার একটি প্রচেষ্টা।’
পোলোক বলেন, ‘একজন পার্লামেন্ট সদস্যকে সঠিকভাবে কিছু সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল এবং এ জন্য একটি নিরাপত্তা সংস্থা (র্যাব) থেকে হুমকি এসেছিল, যারা মানুষকে গুম, নির্যাতন ও হত্যার জন্য পরিচিত।’
টিউলিপ সিদ্দিকের লন্ডনে একটি সম্পত্তি রয়েছে, যা তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একজন বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে বিনামূল্যেই পেয়েছিলেন।
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গত সোমবার (৬ জানুয়ারি) বলপূর্বক গুমের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে শেখ হাসিনা ও তার ১১ শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে।
টিউলিপ সিদ্দিকের খালা শেখ হাসিনা হাজার হাজার লোককে গুমের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে গত মাসে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত একটি তদন্ত কমিশন প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
আরমান অভিযোগ করেন, তাকে বন্দিশালায় ‘শারীরিকভাবে দুর্বল ও মানসিকভাবে আঘাতগ্রস্ত’ করে রাখা হয়েছিল। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমারকে ‘তিনি (টিউলিপ) তার ওপর অর্পিত দায়িত্বের জন্য উপযুক্ত কিনা তা গুরুত্বসহ পুনর্বিবেচনা করার জন্য’ আহ্বান জানিয়েছেন।
চ্যানেল ৪ নিউজের প্রতিবেদন প্রচারের পর একজন সাংবাদিকের প্রতি নিজের আচরণের জন্য টিউলিপ সিদ্দিক ক্ষমা চেয়েছিলেন। ফিন্যান্সিয়াল টাইমস মন্তব্যের জন্য টিউলিপ সিদ্দিক ও লেবার পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তিনি অনুরোধে সাড়া দেননি এবং তার দল লেবার পার্টি এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানায়।