
বাংলাদেশ নারী ফুটবলের দীর্ঘদিনের অর্জনের ওপর পড়েছে অশুভ ছায়া- এমন অভিযোগই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে ফুটবল অঙ্গনে। বছরের পর বছর নিরলস পরিশ্রমে গড়ে ওঠা সাফল্য ও ইমেজকে পুঁজি করে একটি পক্ষ বাণিজ্যিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। মাঠের সাফল্য যেখানে হওয়া উচিত মূল চালিকাশক্তি, সেখানে খেলাধুলার চেয়ে বাণিজ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রবণতা নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক।
এই প্রেক্ষাপটে ফেডারেশনের ভেতরেই সংগঠকদের সম্পর্কের টানাপোড়েন অনেক আগেই শুরু হয়েছে। ‘ঘরের কথা’ আর গোপনে নেই—স্পষ্ট হয়ে উঠছে বিভাজন, কর্মকর্তাদের মধ্যে বাড়ছে দূরত্ব, আর নেপথ্যে থাকা কিছু মুখও প্রকাশ্যে আসছে।
আগামী ২৯ ডিসেম্বর নারী ফুটবল লিগ শুরুর কথা। তবে জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের নিয়ে ‘পুল’ গঠন হবে কি না—এ নিয়ে বিপরীত বক্তব্যে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। নারী ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ, যিনি এক যুগেরও বেশি সময় ধরে নারী ফুটবলের দেখভাল করে আসছেন, এ বিষয়ে পরিষ্কার অবস্থান জানিয়েছেন। পরশু দুপুরে তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘যা শুনেছেন কীভাবে শুনেছেন জানি না। আমি বলতে পারি পুল হবে না।’
এবারের লিগ এক মাসের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কিরণ। বছরের বেশির ভাগ সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ করে স্বল্প সময়ে লিগ আয়োজনের যৌক্তিকতা নিয়ে তিনি সন্দিহান। ১১ দল নিয়ে এক রাউন্ডে, একটি মাঠে লিগ আয়োজন খুব বেশি সুফল দেবে না—এমনটাই তাঁর মত। কিরণ বলেন, ‘এক মাঠে শুধু কি মেয়েরা খেলবে? ছেলেদের ফুটবল আছে না। মেয়েদের লিগ-ই হবে একটা। এটা আরও বেশি সময় নিয়ে হতে পারত। লিগটা এখন করতে হচ্ছে কম সময়ের মধ্যে। যাই হোক, এখন সামনে এশিয়া কাপ খেলতে যাবে বাংলাদেশ। সেই প্রস্তুতি হিসাবেই হবে এই লিগ।’
লিগে বয়সভিত্তিক খেলোয়াড়দের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করাতেও আপত্তি ছিল তাঁর। কিরণের ভাষায়, ‘বয়সভিত্তিক ফুটবলারদের নিয়ে আলাদা লিগ হওয়া ভালো। এখন এটা করা হয়েছে তারাও এশিয়া কাপে খেলবে যেন খেলার মধ্যে থাকে।’
লিগ কাঠামো নিয়েও নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেন তিনি। কিরণ বলেন, ‘এভাবে প্রপার লিগ হয় না। অনূর্ধ্ব-২০ এবং সিনিয়রদের প্রিপারেশনের জন্য ঠিক আছে। আর যদি প্রপার লিগ করতে চাই তাহলে আমি কখনোই অনূর্ধ্ব-১৭, অনূর্ধ্ব-২০ ফুটবলারদের নিয়ে লিগ আয়োজন করব না। আমি কেন অনূর্ধ্ব-১৭, অনূর্ধ্ব-২০ ফুটবলারদের নিয়ে কম্বিনেশন করব। তাদের জন্য প্রয়োজনে আলাদা লিগ করব। আমি চাই, ফরেন ফুটবলার হতে পারে দুই জন। একজন খেলবে। এখানে দেশি ফুটবলারদের সুযোগটা বেশি দিতে হবে। যেহেতু মার্চে সিনিয়র ফুটবলারদের এশিয়া কাপ, এপ্রিলে অনূর্ধ্ব-২০ এশিয়া কাপে খেলবে। তাই এবার কম্বিনেশন করা হয়েছে। আপাতত চলুক। কিন্তু এভাবে তো লিগ হয় না।’
তিনি আরও যোগ করেন, ‘নারী ফুটবলটা আমার হাতে তুলেছি। আমার হাত দিয়ে ধ্বংস করতে পারব না।’
বাফুফের কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম বাচ্চুর মৃত্যুর পর নারী ফুটবলকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। কাজী সালাহউদ্দিন ও মাহফুজা আক্তার কিরণের হাত ধরেই মূলত নারী ফুটবলের বর্তমান সাফল্যের ভিত্তি গড়ে ওঠে। নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার জন্য নারী দলের আবাসিক ক্যাম্প ফুটবল ভবনে স্থাপন করা হয়—যা নিয়ে শুরুতে সমালোচনা হলেও তারা পিছু হটেননি।
শুরুর দিকে বাফুফের ভেতর থেকেই নারী ফুটবল বন্ধের দাবি উঠেছিল। নানা কটূক্তি ও বাধা উপেক্ষা করেই ক্যাম্প চালু রাখা হয়। খেলোয়াড়দের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা, পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস, শিক্ষা ও ভাষা শেখা, দেশি-বিদেশি কোচিং—সব মিলিয়ে ধাপে ধাপে উন্নয়ন ঘটানো হয়। ফিফার সঙ্গে সমন্বয় করে খেলোয়াড়দের বেতন কাঠামোয় আনা হয়। বয়সভিত্তিক পর্যায়ে সাফল্যের ধারাবাহিকতায় সিনিয়র পর্যায়েও আসে অর্জন—নারী সাফে বাংলাদেশ টানা দুইবার চ্যাম্পিয়ন হয়।
বাফুফেতে নতুন সভাপতি হিসেবে তাবিথ আউয়ালের আগমনে নারী ফুটবলে নতুন দিগন্তের প্রত্যাশা তৈরি হলেও গুঞ্জন রয়েছে—তাঁর নাম ব্যবহার করে একটি পক্ষ পরিকল্পনা নিয়ে টানাটানি করছে। দ্বিমুখী উদ্যোগে ক্লাবগুলোও বিরক্ত। একেকজন একেক পরিকল্পনার কথা বলায় ফেডারেশন পড়ছে সমালোচনার মুখে—এমন অভিযোগই এখন শোনা যাচ্ছে ফুটবল অঙ্গনে।