
বাংলাদেশিদের জন্য ভারতীয় ভিসা কার্যত বন্ধ হয়ে পড়ায় কলকাতার পর্যটনকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে মারাত্মক বিপর্যয় নেমে এসেছে। রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও ভিসা জটিলতার কারণে সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছে নিউ মার্কেট, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট এবং মারকুইস স্ট্রিট এলাকা—যা স্থানীয়ভাবে ‘মিনি বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত। শুধু এই অঞ্চলেই ক্ষতির অঙ্ক ছাড়িয়েছে ১ হাজার কোটি রুপি। আর পুরো কলকাতাজুড়ে ব্যবসায়ীদের সম্মিলিত ক্ষতি প্রায় ৫ হাজার কোটি রুপি ছাড়িয়েছে বলে জানিয়েছে টাইমস অব ইন্ডিয়া।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের জুলাই মাসে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্কে উত্তেজনা শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় নয়াদিল্লি বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা কার্যক্রম কার্যত স্থগিত করে দেয়। বর্তমানে কেবল অল্প সংখ্যক জরুরি ভিসা দেওয়া হলেও সেটি একেবারেই সীমিত।
করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে ওঠার সময় যখন পর্যটন খাত কিছুটা প্রাণ ফিরে পাচ্ছিল, তখন এই ভিসা নিষেধাজ্ঞা নতুন করে আরেকটি বড় ধাক্কা হয়ে আসে। আগে যেসব রাস্তাঘাট বাংলাদেশি পর্যটকে মুখর ছিল, এখন সেখানে জনশূন্যতা নেমে এসেছে। কম খরচে থাকা, দেশি খাবারের স্বাদ এবং স্বাস্থ্যসেবার জন্য জনপ্রিয় এই এলাকাগুলোতে এখন কার্যত নীরবতা।
কলকাতার ব্যবসায়ীদের সংগঠন ফ্রি স্কুল স্ট্রিট ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, এই অঞ্চলজুড়ে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩ কোটি রুপির লেনদেন হতো পর্যটন, হোটেল, রেস্তোরাঁ, মানি এক্সচেঞ্জ, চিকিৎসা ও পরিবহনসেবায়। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হায়দার আলী খান বলেন, “শুধু নিউ মার্কেট ও বড়বাজার এলাকাকে ধরলেই এই অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ৫ হাজার কোটি রুপি ছাড়িয়ে যাবে।”
বিভিন্ন ট্র্যাভেল কোম্পানি, রেস্তোরাঁ এবং এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো এখন বন্ধ হওয়ার মুখে। স্থানীয় একটি ট্র্যাভেল প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক প্রবীর বিশ্বাস বলেন, “আগে দিনে দিনে একাধিক বাস ভর্তি বাংলাদেশি পর্যটক আসত, এখন অনেক দিনেও একটি বাস আসে না।”
মারকুইস স্ট্রিটের কারেন্সি এক্সচেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক মোহাম্মদ ইন্তেজার বলেন, “আমরা পুরোপুরি বাংলাদেশি পর্যটকদের ওপর নির্ভর করতাম। এখন ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে।”
ছোট ও মাঝারি অনেক রেস্তোরাঁ ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। যেগুলো এখনো চালু আছে, তাদের আয়ও প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। রাঁধুনি রেস্তোরাঁর মালিক এন সি ভৌমিক বলেন, “আমাদের আয় ২০ শতাংশে এসে ঠেকেছে। এই ধারা চলতে থাকলে হয়তো টিকে থাকাটাই আর সম্ভব হবে না।”
এ সংকট কেবল ব্যবসা নয়, পর্যটননির্ভর অসংখ্য আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক পেশাজীবীর জীবিকাকেও হুমকির মুখে ফেলেছে। হোটেল কর্মচারী, রাঁধুনি, ট্যুর গাইড, ড্রাইভার এমনকি হোম-স্টে অপারেটরদেরও রোজগার প্রায় বন্ধ। এলিয়ট রোডের বাসিন্দা ফারহান রসুল বলেন, “কোভিড পরবর্তী চাহিদা দেখে আমি দুটি গাড়ি কিনেছিলাম। এখন মাসে পাঁচ-ছয়টির বেশি বুকিং পাই না। অথচ প্রতি মাসে দেড় লাখ রুপি কিস্তি দিতে হয়।”
ব্যবসায়ীরা বলছেন, মহামারির ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই এই সংকট তাদের অস্তিত্বের ওপরই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। তারা আশা করছেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক দ্রুত স্বাভাবিক হবে এবং ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড আবার সচল হবে।