
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির অপব্যবহার ঠেকাতে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এআই-র (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করছে নির্বাচন কমিশন।
ভোটারদের বিভ্রান্ত করতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ডিপফেইক, মিথ্যা তথ্য, পক্ষপাতমূলক কনটেন্ট, অপপ্রচারমূলক ভিডিও-অডিও কিংবা কোনো রকম মানহানিকর বা বিকৃত প্রচার চালানো নিষিদ্ধ থাকবে। প্রার্থীদের বা রাজনৈতিক নেতাদের ছবি বিকৃত করে তৈরি করা কোনো প্রচারণাও চলবে না। এসব নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে সাইবার নিরাপত্তা আইন বা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই বিধিনিষেধগুলো যুক্ত করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রার্থীদের আচরণ বিধিমালার খসড়া চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়। বৃহস্পতিবার কমিশনের নিয়মিত সভায় এ খসড়া বিধিমালাটি অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হচ্ছে বলে ইসি সূত্রে জানা গেছে।
নতুন আচরণবিধিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা চালাতে হলে নির্ধারিত নিয়ম-কানুন কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে। তবে এআই-ভিত্তিক বিভ্রান্তিকর তথ্য, ঘৃণাত্মক বক্তব্য, ব্যক্তিগত আক্রমণ কিংবা ধর্মীয়-জাতিগত অনুভূতির অপব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
কমিশনের সূত্র জানায়, এ বছর ঘোষিত খসড়া আচরণবিধি ২৯ জুন প্রকাশিত প্রাথমিক খসড়ার তুলনায় অনেক বেশি কঠোর। সেই খসড়ায় শুধুমাত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের কথা থাকলেও নতুন সংশোধিত খসড়ায় এআই অপব্যবহার নিয়ে সুস্পষ্ট ও কঠোর নিষেধাজ্ঞা যুক্ত করা হয়েছে, যা বিএনপিসহ বিভিন্ন পক্ষের সুপারিশের ভিত্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
নির্বাচনি প্রচারণা এবং ভোটগ্রহণের দিনে ড্রোন, কোয়াডকপ্টার বা এ ধরনের যন্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকবে। নির্বাচনের দিন প্রার্থীর অনুমোদিত প্রতিনিধি ছাড়া কেউ মোটরসাইকেল বা যেকোনো যান্ত্রিক যান ব্যবহার করতে পারবে না।
এছাড়া নির্বাচনি প্রচারে কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করাও নিষিদ্ধ। অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রেও নতুন নিয়ম প্রবর্তিত হয়েছে। রাজনৈতিক দল ২০ হাজার এবং প্রার্থী ১০ হাজার টাকার বেশি নগদ লেনদেন করতে পারবেন না—ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমেই এসব লেনদেন করতে হবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিন বুধবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, “এআই ব্যবহার করে ভুল তথ্য ও বিভ্রান্তি মোকাবিলার পরিকল্পনা রয়েছে। মিসইনফরমেশন ও ডিসইনফরমেশন উন্নত দেশগুলোও পুরোপুরি ঠেকাতে পারেনি। আমাদেরও বড় চ্যালেঞ্জ হবে। তবে গণমাধ্যমের সহযোগিতায় এটি মোকাবিলা করব।”
এই সংক্রান্ত বৈঠকটি আজ বৃহস্পতিবার নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সভাপতিত্বে চার কমিশনার, ইসির সিনিয়র সচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন। বৈঠকে গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ (আরপিও) সংশোধনের খসড়াও আলোচনায় উঠবে।
সংবিধিবদ্ধ নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা যেন অন্য কোনো বৈধ দলের হয়ে নির্বাচন করতে না পারেন—এ লক্ষ্যে আচরণবিধিতে নতুন একটি অঙ্গীকার সংযোজন করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে অঙ্গীকার করতে হবে যে, “আমার দলের মনোনীত প্রার্থী কখনোই কোনো নিষিদ্ধ বা নিষেধাজ্ঞার আওতাধীন কোনো রাজনৈতিক দল/সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না বা এখনো নেই।”
একই রকম অঙ্গীকার প্রার্থীদের কাছ থেকেও নেওয়া হবে।
ইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই নতুন শর্ত যুক্ত করা হয়েছে যেন নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলের নেতারা অন্য দলের হয়ে মনোনয়ন না পেতে পারেন। বর্তমানে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ রয়েছে বলে ইসি জানিয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি জানান, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকলেও “আওয়ামী লীগের সমর্থকরা ভোট দিতে পারবেন।”
নতুন আচরণবিধি অনুসারে, প্রচারণায় রঙিন ব্যানার, লিফলেট, হ্যান্ডবিল বা ফেস্টুন ব্যবহারের অনুমতি থাকছে না। এগুলো সাদা-কালোতেই তৈরি করতে হবে। ব্যানারের সর্বোচ্চ আকার হতে পারবে ১০ ফুট বাই ৪ ফুট, লিফলেট বা হ্যান্ডবিল হবে এ-ফোর সাইজে এবং ফেস্টুনের মাপ নির্ধারিত থাকবে ১৮ বাই ২৪ ইঞ্চির মধ্যে।
এছাড়া, দলীয় প্রধানের পাশাপাশি এবার দলের সাধারণ সম্পাদকও হেলিকপ্টার ব্যবহার করে প্রচারণা চালাতে পারবেন—যা আগের বিধিমালায় শুধুমাত্র দলপ্রধানের জন্য অনুমোদিত ছিল।
প্রস্তাবিত ১৫ ধারায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো রকম প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তফসিল ঘোষণার পর কোনো প্রার্থী সংশ্লিষ্ট নির্বাচনি এলাকার কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি বা সদস্য পদে থাকতে পারবেন না। যদিও আগের খসড়ায় এ নিষেধাজ্ঞা পুরো দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর আরোপ করা হয়েছিল, বিএনপির মতামতের ভিত্তিতে তা সংশোধন করে সংশ্লিষ্ট আসনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
অন্যদিকে, আচরণবিধির ১৮ ধারায় বলা হয়েছে, তফসিল ঘোষণার পর কোনো প্রার্থী বা প্রার্থীদের কোনো সংগঠন থেকে সংবর্ধনা গ্রহণ করতে পারবে না।